No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    শতবর্ষে কাইফি আজমি-কে স্মরণ

    শতবর্ষে কাইফি আজমি-কে স্মরণ

    Story image

    কবিতার নাম ‘লাখনৌ শহর’। ছোট্ট কবিতা। “বেদনায় এখানে অশ্রুপাত হয় কিন্তু রক্ত ঝরে না,/সেটা কি অন্য কোন শহর নাকি লাখনৌ শহর?/এখানে মানুষের জবানের চেয়ে দ্রুত চলে ছুরি/সেটা কি মীর, আনিস অথবা আতিমের কবিতা?/দুই সম্প্রদায়ের ক্ষত থেকে যে রক্ত ঝরছে,/সতর্কভাবে পরীক্ষা করুন সেটা কি মুসলমানের রক্ত?/তাকে তুমি যে নামেই ডাকো?/রক্তের গঙ্গা বইয়ে যা ঘটিয়েছে,/তাকে কি পাপ মোচন বলা যায়?/নিজের পোশাকের নিচে নিজেকে আড়াল করো,/তা তোমার আগামী দিনের স্বপ্নে স্ফুলিঙ্গ হতে পারে।/যা কিছু ব্যক্তিগত মনে করে লুণ্ঠন করেছ,/তা কি তোমার প্রতিবেশীর মান ইজ্জত নয়?”

    আজকের দিনে যখন ভারতে চলছে গেরুয়া তাণ্ডব, তখন ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে এই কবিতাটি। মূল কবিতা উর্দুতে। বাংলায় অনুবাদ কার জানি না, প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকার বিপুল জনপ্রিয় প্রভাতী দৈনিক ‘প্রথম আলো’য়। কবির নাম কাইফি আজমি। আসল নাম আতহার হোসাইন রিজভি। উইকিপিডিয়া মতে, তাঁর জন্মশতবর্ষ শুরু হ’ল আজ, কিন্তু গত ১৪ জানুয়ারি ‘একদিন’ দৈনিকে কলকাতার উপকন্ঠে সল্টলেক বাসিন্দা বিশ্বনাথ বিশ্বাস একটি চিঠিতে (চিঠিটি মূল্যবান, যদিও কিছু ভুলভ্রান্তি আছে) লিখেছেন তাঁর জন্ম ১৪ জানুয়ারি ১৯১৯। আবার আরেক জায়গায় পড়লাম তাঁর জন্ম ১৯১৮ সালের ১০ মে। তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে উত্তর প্রদেশের আজমগড়ে মিজওয়ান-এর জমিদার পরিবারে তাঁর জন্ম, কিন্তু জমিদারির গন্ধ ঝেড়ে ফেলে ও খেদে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ১৯৪২ সালে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে । তার পরের বছর যোগ দিলেন অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই)তে। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ অব্দি পার্টি কার্ড সযত্নে ও সক্রিয়ভাবে রেখে দিয়েছিলেন। আলি সরদার জাফরি সম্পাদিত পার্টির উর্দু মুখপত্র ‘কউমি জং’-এ লেখা শুরু করেন। থেকে গেলেন মুম্বাই শহরে। তার পর থেকে সমাজ সচেতন কবিতা শুরু করেন। তাঁর মতে, কবিতা সমাজ পরিবর্তনে বাদ্যযন্ত্রের মতো ব্যবহার হওয়া উচিত।

    তাঁর কাব্য প্রতিভার স্ফূরণ ১১ বছর বয়সে। এক মুশায়রায় পড়লেন একটি গজলের গীতিকবিতা, ‘ইতনা জো জিন্দেগী মে কিসি কি খালাল পাড়ে / হাঁসনে সে হো সুকুন না রোনে কাল পাড়ে’, যা বেগম আখতারের কণ্ঠে অমরত্ব লাভ করে। তারপরে কলম আর থামেনি, বার বার তাত খুশবু সবাইকে মোহিত করেছে। তিনি পরে আরো কাইফি সাহেবের লেখা বেশ কিছু গজল গেয়েছেন; যেমন ‘মায় ঢূঁড়তা হুঁ জিসে/উয়ো জাঁহাঁ নহি মিলতা জিসে’। একবার এক মেহফিল ছিল কাইফি সাহেবের গীতি আর সেগুলি গাইলেন আখতারি সাহেবা। সেখানে কাইফি সাহেব বলেছিলেন, বেগম আখতার সাহেবের গজল শোনা মানে গজল দেখা।

    ***কবি উর্দু, ফারসি ও হিন্দী তিন ভাষাতেই ছিলেন সাবলীল, স্বচ্ছন্দগতি। একাধিক বই লিখেছেন - আখির-ই-সাব, শারমায়া, আওয়ারা সাজদে, কৈফিয়াত, নঈ গুলিস্তাঁ এবং আরো কয়েকটি। চলচ্চিত্রজীবনের শুরু ১৯৫২ সালে। শহীদ লতিফের ছবিতে গান লেখার মধ্য দিয়ে। অচিরেই হয়ে ওঠেন এক জনপ্রিয় গীতিকার। ‘শামা’, ‘কাগজ কি ফুল’, ‘শোলা অর শবনম’, ‘অনুপমা’, ‘আখেরি খত’, ‘হাকিকত’, ‘আর্থ’ প্রভৃতি নানা ছবির সংলাপও লিখেছিলেন। চেতন আনন্দের ‘হির রানঝা’র সংলাপ ছিল কবিতায়। এক ইতিহাস গড়েছিলেন এভাবে। এম এস সথ্যুর ‘গরম হাওয়া’ ছবির সংলাপ ও চিত্রনাট্য কে ভুলতে পারে? ইসমাত চুঘতাই-এর কাহিনী থেকে নেওয়া। মনে পড়ে অবিস্মরণীয় পঙক্তিচয় – ‘আজ রাতমেঁ বহোত গর্ম হাওয়া হ্যায়/আজ রাত নিঁদ নেহি আতে’। এই ছবি তাঁকে দিয়েছিল জাতীয় পুরস্কার ও ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার। পদ্মশ্রী পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা পেয়েছেন - আফ্রো এশীয় রাইটার্স লোটাস পুরস্কার, সোভিয়েত ল্যান্ড পুরস্কার, মহারাষ্ট্র গৌরব ও আরও অনেক। সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান ১৯৮০ সালে। তাঁর বিখ্যাত লেখাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আউরত’, ‘মাকান’, ‘দাইরা’, ‘বাহুরুপনি’ ইত্যাদি। ‘মেরি আওয়াজ সুনো’ নামে হিন্দি ছবিতে তাঁর গান নিয়ে একটি ছবি তৈরি হয়েছিল।

    যে সব গান কখনো পুরনো গান হবে না, তার মধ্যে আছে লতা মঙ্গেশকর ও তালাত মাহমুদের যৌথ কন্ঠে ‘ডর লাগে দুনিয়া সে’ (বুযদিল), আবার লতাজির গলাতেই ‘চলতে চলতে ইয়ু হি কোহি মিল গিয়া(পাকিজা) বা ‘ঝুম ঝুম ঢলতে রাত’(কোহরা), মহম্মদ রফির গলায়, ‘ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মেহ ফিল মেরে কাম কি নেহি’ (হীর রঞ্ঝা) ও ‘কর চলে হাম ফিদা ওয়াতন সাথিওঁ’(হকিকত), হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘ইয়ে নয়ন ডরে ডরে’ (কোহরা) - আরও অনেক অনেক। জসবিন্দর সিং-এর ‘তুমহারে জুলফি কি সায়ে মেঁ’ ভোলা যায়? বলা বাহুল্য, নারী অধিকারের পক্ষে ও ধর্মীয় উগ্রতার বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী সদা উদ্যত ছিল।

    কবি ১৯৪৭ সালে শওকত আজমির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। গত অক্টোবরে ঢাকায় তাঁদের কন্যা ও জামাতা কবি ও কবির কমরেড সহধর্মিণীর ৫৫ বছরের রোম্যান্স-ঘন দাম্পত্য জীবন কাহিনী(সাথে জসবিন্দরের অসামান্য কাইফির লেখা গজল) শুনিয়ে দু-ঘন্টা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন। প্রেক্ষাগৃহে তিল ধারণের স্থান ছিল না। হবেই তো, কারণ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর কলমে জ্বলে উঠেছিল দখলদার পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের প্রতি তীব্র ঘৃণা। বাংলাদেশ ভোলেনি বন্ধু কবিকে সম্মানিত করতে। কাইফি-শওকতকে নিয়ে একটি সংকলন ‘ইয়াদ কি রেহগুজার’ এক বিরল গ্রন্থ, যা অন্তত বাংলায় ভাষান্তরিত হলে আবেগপ্রিয় বাঙালি পাঠকদের কাছে হয়ে উঠবে নিত্যসঙ্গী। কাইফি সাহেবের বিভিন্ন সময়ের সাক্ষাৎকার থেকে থেকে উঠে এসেছে তাঁর আজমির বেড়ে ওঠা, সেই মিজওয়ান গ্রামের কথা, শওকতের সঙ্গে কাইফির পরিচয় থেকে পরিণয়, ১৯৫০-এর দশকে মুম্বাইয়ে লড়াকু দিনগুলো, মিল শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ ও সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছে কাইফি-শওকতের ভালোবাসার ৫৫ বছর।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @