সত্যজিতের ‘অভিযান’দেখে ক্ষুব্ধ ঋত্বিক বললেন, ‘অযান্ত্রিক’-এর প্রায় হুবহু কপি

ওদেসা বন্দরের সাদা কালো সিঁড়ি। উপরে ঝলসাচ্ছে ‘কসাক’ সৈন্যদের বেয়নেট। তারা এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসে। ঠিক নিচে দেখতে পাওয়া যাবে ঘোড়সওয়ারেরা তলোয়ার চালাচ্ছে জনতার উপর। গুলির সুতোয় বিদ্ধ, বিস্ফারিত হতবাক মায়ের হাত ছেড়ে নবজাতকের প্যারাম্বুলেটর সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে নিচে...
আরো পড়ুন
বঙ্গদর্শন পুজোসংখ্যা, ১৪২৬
সামান্য কয়েকটি শটে বোনা শব্দহীন হাহাকার। শতাব্দী পার করা সিনেমার ইতিহাসে এক অমোঘ সিকোয়েন্স। ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’ নাড়া দিয়েছিল বিভিন্ন চিত্রপরিচালককে। বাংলায় সিনেমা নিয়ে ‘সিরিয়াস’ ভাবনাচিন্তা করছিলেন যে তিনটি মানুষ, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তির কথাতেই তা পরিষ্কার হবে হয়তো। সেই ব্যক্তির নামটা আগে বলে রাখি-- ঋত্বিককুমার ঘটক।
“এই আইজেনস্টাইন... সত্যজিৎ রায়কেও আপনারা জিজ্ঞেস করতে পারেন, he will admit, that he is the father of us. আর (তাঁর থেকেই) আমরা ছবি কাটতে শিখেছি... filmmaking-এ ওটা একটা ব্যাপার।”
সেই সত্যজিৎ রায়েরই ‘অভিযান’ মুক্তি পেয়েছে তখন। ছবি দেখতে এসে মাঝপথেই উঠে দাঁড়ালেন একজন। বেরিয়ে এলেন হল থেকে। শুরু হল পরিচালকের নামে গালিগালাজ। দর্শকের সামনেই, প্রকাশ্যে। এই মানুষটিকে চিনতে পারাও খুব শক্ত না। মোটা ফ্রেমের চশমা। ধুতি- জহর কোট। গালে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। ঠিকই ধরেছেন, ঋত্বিককুমার ঘটক।
এইটুকু শুনে মনে হতেই পারে, এ হল জাত বিদ্বেষ বা ঈর্ষা। নাহলে এমন আচরণের অর্থ? তিনি তো ‘মানিকবাবু’র অনুরোধেই দেখতে এসেছিলেন ‘অভিযান’। কিন্তু যাঁরা ঋত্বিককে চিনতেন, তাঁর সঙ্গে সত্যজিতের সম্পর্কটি বুঝতেন, তাঁরা কি খুব অবাক হয়েছিলেন এই ঘটনায়? এমন আচরণের কারণ দর্শাতে গিয়ে ঋত্বিক টেনে এনেছিলেন পরিচালক-ত্রয়ীর তৃতীয় পুরুষ অর্থাৎ মৃণাল সেনকে-- “মৃণাল (সেন) ছবিটি দেখে এসে বলল, ঋত্বিক ছবিটি দেখে এসো। তুমি দেখবে মানিকবাবু বহু জায়গায় অযান্ত্রিক-এর প্রায় হুবহু কপি করেছেন। আমি ইন্দিরাতে ছবিটি দেখতে গিয়ে দেখলাম, সত্যিই তাই! অসংখ্য ফ্রেম এক্কেবারে হুবহু এক। মাঝপথে খেপে গিয়ে উঠে পড়লাম।”
সত্যজিৎ, স্বাভাবিকভাবেই, এমন আচরণ কখনোই করেননি ঋত্বিক সম্পর্কে। ‘অযান্ত্রিক’ দেখে বলেছিলেন, “ঋত্বিকবাবু, সিনেমাটা সময় মতো রিলিজ করলে আপনি পথিকৃৎ হতেন।” তাঁর মতে ঋত্বিক ছিলেন খাঁটি বাঙালি পরিচালক। যাঁর সিনেমায় বিদেশি ছাপ নেই। এমনকি এই ব্যাপারে সত্যজিৎ নিজেরও আগে বসিয়েছিলেন ঋত্বিককে। উল্টোদিকে, মানিকবাবুর সবচেয়ে কড়া সমালোচকদের একজন ছিলেন ঋত্বিককুমার ঘটক। না, বিদ্বেষ বা ঈর্ষা থেকে নয়। সেও এক শ্রদ্ধাবোধ আর আন্তরিকতা থেকেই। ঋত্বিক তো সত্যজিতের থেকে আলাদা একজন মানুষ। তাঁর বহিঃপ্রকাশও যে আলাদা হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
আরো পড়ুন
জ্বলন্ত লাফের থাবা: ঋত্বিক ঘটক
‘পথের পাঁচালী’ অসম্ভব ভালো লেগেছিল ঋত্বিকের। এবং সমালোচনাও ছিল কিছু। ফিল্ম সোসাইটির একটা মিটিং-এ দুজনের প্ৰথম আলাপ। তখনো ‘সিনেমায় নামেননি’ ঋত্বিক। মানিকবাবু ভালোবেসে ফেলেছিলেন খ্যাপাটে মানুষটাকে। আপোষহীন, সোজাসাপ্টা। আর আছে অন্যভাবে সিনেমাকে ঠাহর করার চোখ। সত্যজিৎ বলেছিলেন, “... আমার কাছে যে-জিনিসটি সব চাইতে ভালো লেগেছিল সেটা সে যে ভাবে ছবিটাকে বিশ্লেষণ করেছিল, তার কয়েকটা দৃশ্যকে, সেটা থেকে আমার মনে হয়েছিল, ঋত্বিক যদি ছবি করে তাহলে সে খুব ভালোই ছবি করবে।’’
তাই, ঋত্বিক ঘটকের পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে কাজের ব্যবস্থাটিও করে দিয়েছিলেন সত্যজিৎই। অদ্ভুত মজার সম্পর্ক ছিল তাঁদের মধ্যে। শোনা যায়, সারা কলকাতা ঘুরে ঋত্বিক ট্যাক্সি দাঁড় করাতেন সত্যজিতের বাড়ির সামনে। তারপর ভোকাট্টা! ভাড়া মিটিয়ে দিতেন মানিকবাবু।
আরো পড়ুন
ঋত্বিক ঘটক: যন্ত্রণার স্বরলিপি
‘দামাল’ ঋত্বিক নাকি একদিন হঠাৎ পৌঁছে গিয়েছিলেন আরো এক ‘উঠতি পরিচালকের’ বাড়ি। ইনি অবশ্য একদা সহযোদ্ধা, ও প্যারাডাইস ক্যাফের সেই বিখ্যাত আড্ডাটির সদস্য। মৃণাল সেনের স্ত্রী গীতা চমকে গিয়েছেন তাঁকে দেখে। অসম্ভব রোগা হয়ে গিয়েছেন! গীতাকে ঋত্বিক বলেন, “আর মদ খাবো না।” একটু পর বললেন, “আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না”। গীতা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “মদ না ছাড়লে কী করে বাঁচবেন আপনি?” উত্তরে উদাস গলায় ঋত্বিক বলেছিলেন, “আমি আর মদ খাবো না।” তারপর হুট করেই বলেছিলেন, “গীতা, মৃণাল খুব ভালমানুষ। কিন্তু ওর ‘ভুবন সোম’, ফুঃ!”
একসময় ঋত্বিক-মৃণালরা ঠিক করেছিলেন স্টুডিয়োর অস্বচ্ছল কলাকুশলীদের নিয়ে একটা সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলবেন। তার প্রাথমিক কাজটি শুরুও করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু কয়েক দিন পরেই কাকদ্বীপে গণ-আন্দোলনে গুলি চালালো সরকার। একটা চিত্রনাট্য লিখে ফেলেন মৃণাল সেন। আর ঋত্বিক যোগাড় করে আনলেন একটা ভাঙা ক্যামেরা। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পৌঁছবেন কাকদ্বীপ। ষোলো মিলিমিটারের নির্বাক ছবি তুলে এনে, কলকাতায় তা সম্পাদনা করে দেখবেন গ্রামে গ্রামে। বাংলার মানুষের মুখে ছড়িয়ে যাবে আন্দোলনের সংলাপ।
আরো পড়ুন
মৃণালে জড়িয়ে থাকা মহাপৃথিবীর সন্ধানে
শেষপর্যন্ত পরিকল্পনা সফল হয়নি। কিন্তু শেখা হয়ে গিয়েছিলেন ‘হাতিয়ার’ চালানো। সিনেমা তো তাঁদের কাছে রাজনৈতিক মত প্রসারের মাধ্যম। আর ক্যামেরা হাতিয়ার।
এই অস্ত্রের সঙ্গে আপোষ করতে কখনো শেখেননি ‘ভবা’। প্রথম থেকেই। তাই সত্যজিৎ যেখানে কোথাও খানিক পরিশীলিত, মৃণাল শেষের দিকে যেখানে পরিমিত, সেখানেই ঋত্বিক বলগাহীন ও নির্মম। একেক সময় মনে হতে পারে ‘কর্কশ’। সম্পূর্ণ অন্যধারায় বইছে ছবি। চরিত্রগুলো চিৎকার করে, আসলে তাঁর কথাই বলে যেন। ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র নীতা বাঁচতে চায়, ‘মহানগরের’ আরতির মতো তো তার পাশে কেউ বাড়িয়ে দেয়নি হাত। ঋত্বিকের বক্তব্য আসলে জলের মতো সহজ। চলচিত্র সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিও।
“...যদি আপনি সচেতন হয়ে ওঠেন, ছবি দেখে বেরিয়ে এসে বাইরের সেই সামাজিক বাধা বা দুর্নীতি বদলানোর কাজে লিপ্ত হয়ে ওঠেন, আমার protest-কে যদি আপনার মধ্যে চারিয়ে দিতে পারি, তবেই শিল্পী হিসেবে আমার সার্থকতা।...”
বাংলা সিনেমাকে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে ঠাঁই করে দিয়েছিলেন ঋত্বিক-সত্যজিৎ আর মৃণাল। কিন্তগু ঋত্বিকের মতো সিনেমাকে আজীবন এতখানি তীব্র রাজনৈতিক শিল্প-মাধ্যম হিসেবে কি দেখতে পেরেছিলেন বাকি দু’জন, জানা নেই।
তথ্যঋণ : আনন্দবাজার পত্রিকা, এন টিভি ডট কম, সন্দীপন ভট্টাচার্য