No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    উত্তম চেয়েছিলেন, ‘বনপলাশীর পদাবলী’ পরিচালনা করুন ঋত্বিক ঘটক

    উত্তম চেয়েছিলেন, ‘বনপলাশীর পদাবলী’ পরিচালনা করুন ঋত্বিক ঘটক

    Story image

    নেশা আর অবসাদ তখন কুড়েকুড়ে খেয়ে ফেলছে ঋত্বিক ঘটককে। পুনের ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে পড়ানোর ডাক এল। নতুন জীবন শুরুর হাতছানি। বম্বে থেকে স্ত্রীকে লিখলেন, ‘‘এখানে সম্মান, বাঁধা মাইনে এবং মনের মতো কাজ।’’ কিন্তু একটা ঘুণপোকা অস্থির করে তোলে। সেই সুখের চাকরিও ছেড়ে শিলং-এ গিয়ে হাজির হলেন ঋত্বিক। সরমা অবাক হয়ে দেখলেন গোটা মানুষটাই অসংলগ্ন। শ্বশুরমশাইয়ের কাছে হাজার টাকা চেয়ে বসছেন। জীবনটাই কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে তাঁর। ‘পণ্ডিতমশাই’-এর গল্প লিখতে বসলেন। টানা লিখতে লিখতে অজ্ঞান। হাসপাতালে ভর্তি করা হল ঋত্বিককে। খবর পেয়েই ছুটে এলেন উত্তমকুমার। এসেছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। 

    উত্তমকুমার সম্পর্কে প্রায় কোনো তথ্যই হয়তো আর অজানা নেই আমাদের। স্বপ্নপুরুষের সমস্ত গোপনীয়তাকেই তন্ন তন্ন করে হাতড়ে দেখেছে বাংলার প্রজন্মের পর প্রজন্ম। অথচ, সেই দেখায় কীভাবে যেন বাদ পড়ে গেছে ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা। একজন বাংলার মহানায়ক, গ্ল্যামারের শেষ সংজ্ঞা। অন্যজন আকাশচুম্বী সম্ভাবনা, প্রতিভা ও প্রজ্ঞা নিয়েও নীলকণ্ঠ। দুই বিপরীত মেরুর দুই বাসিন্দা। দুজনকে নিয়েই আপামর বাঙালির কৌতূহলের শেষ নেই, মিথের শেষ নেই, কল্পনার শেষ নেই। অথচ, রহস্যময়ভাবে এই দুজনের সম্পর্ক নিয়ে খুব বেশি কথা শোনা যায় না। প্রগলভ বাঙালি জাতির নিরিখে এ যে আশ্চর্য ঘটনা সন্দেহ নেই!

    ঋত্বিকের একটি সিনেমাতেও অভিনয় করেননি উত্তমকুমার। কিন্তু, সব ঠিকঠাক থাকলে হয়ত সেই মাহেন্দ্রক্ষণের সামনে এসে দাঁড়াত বাংলা সিনেমা। ঋত্বিক যখন গুরুতর অসুস্থ, তার চাইতেও গুরুতর হয়ে দেখা দিচ্ছে তাঁর অর্থাভাব, তখন যেভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন উত্তমকুমার। চেয়েছিলেন, রমাপদ চৌধুরীর ‘বনপলাশীর পদাবলী’ নিয়ে সিনেমা তৈরি করুন ঋত্বিক ঘটক। ‘বনপলাশীর পদাবলী’ পরিচালনার প্রস্তাবে না বলেননি ঋত্বিক। তখন তাঁরও টাকার প্রয়োজন। উত্তম অগ্রিমও দিয়ে যান তাঁকে। দুঃসময়ে সেই টাকার যে কত প্রয়োজন ছিল।

    কিন্তু এই সিনেমার পরিচালনা করা আর হয়ে ওঠেনি ঋত্বিকের পক্ষে। কাজ থেকে মন উঠে যাচ্ছিল আগেই। শরীরে অসুখটাও জোরালোভাবে বাসা বাঁধল। ফের হাসপাতাল। কথাবার্তা আরো অসংলগ্ন হতে শুরু করল। এরই মধ্যে হাসপাতালেও গোপনে মদের জোগান জারি ছিল তাঁর জন্য। পায়খানার দেওয়ালের দুটো ইট সরিয়ে চুপিচুপি সেখানে মদের বোতল রেখে যেত হেড সুইপার। মদ খাওয়ার পর সেই ইট ফের লাগিয়ে দিলেই কাজ শেষ। এই মদের টাকা নাকি দিতেন ভিজিটরদের কয়েকজন। তাঁরা কারা? স্পষ্ট করে উত্তর দেননি ঋত্বিক। শুধু বলেছিলেন, অনেকেই আসে, এমনকি উত্তম আর রমাও। রমা বলতে সুচিত্রা সেন।

    সিনেমা তৈরি হবে না বুঝতে পেরেও উত্তম ঋত্বিককে দেখতে যেতেন হাসপাতালে। নাকি তখনো ‘বনপলাশীর পদাবলী’ নিয়ে স্বপ্নটা ছাড়তে চাননি। উত্তর মিলবে না আর। কে জানে, হয়তো ঋত্বিকের প্রতি দুর্বলতাবশত তিনিই অর্থসাহায্য করতেন হাসপাতালে গিয়ে। সেই টাকাতেই হয়তো গোপন পথে মদ আসত। নাহ, এই সম্ভাবনার চর্চা এখানেই থামিয়ে দেওয়া ভালো। লাগাম ছাড়লে কল্পনারা বড়োই বেপরোয়া আর বেয়াদপ হয়ে ওঠে।

    আশ্চর্য এক সম্পর্ক কিন্তু দুজনের। ঋত্বিক সিনেমার পরিচালনা করলেন না। ‘বনপলাশীর পদাবলী’ পরিচালনার দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নিলেন উত্তম। কিন্তু, তা নিয়ে কোনো প্রকাশ্য তিক্ততার আভাস মেলেনি কোনোদিন। সিনেমা হিটও হল। উত্তমকুমারের মুকুটে নতুন পালক জুড়ল। কিন্তু, এই সিনেমা যদি ঋত্বিকের ছোঁয়া পেত, তাহলে হয়তো আরো একটা সোনার অধ্যায় জুড়ে যেত বাংলা সিনেমার দুনিয়ায়। 

    কেন জানি না মনে হয়, আদ্যন্ত ভিন্ন গ্রহের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কোথাও যেন অদ্ভুত মিলও রয়েছে উত্তমকুমার আর ঋত্বিকের ভিতরে। একজন সাফল্যের চুড়ো ছুঁয়েছেন। তিনি যত না প্রতিভাবান, তার চেয়েও বেশি পরিশ্রমী। অন্যজন সাফল্য পেলেন কই? অগাধ প্রতিভা নিয়েও তিলে তিলে নিভে গেলেন স্বেচ্ছায়। অথচ দুজনেরই কী অমোঘ আবেদন। আর অপ্রাপ্তি। উত্তম সব পেয়েও অসুখী আর ঋত্বিক সব হারিয়ে। সুরকার অধীর বাগচীর সামনে একদিন পাগলের মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন উত্তমকুমার। পারিবারিক কারণে ঠিকঠাক এডুকেশন না পাওয়ার যন্ত্রণা তাঁকে কুড়েকুড়ে খেত। অথচ, ‘নায়ক’-এ তাঁর অভিনয়কেই নির্ভুল মনে হয়েছিল সত্যজিতের। নিজের অনেক ত্রুটি খুঁজে পেলেও উত্তমকুমারের অভিনয়ে কোনো ত্রুটি খুঁজে পাননি সত্যজিৎ। অথচ, সেই মানুষটাই ভেঙে পড়েন নিজের সীমাবদ্ধতার দিকে তাকিয়ে। অগাধ সাফল্যের পরেও শান্তি মেলে না। কোথায় যেন একটা যাওয়ার ছিল যেন, যাওয়া হল না।

    আর ঋত্বিক? বোম্বের নিশ্চিন্ত চাকরি-জীবন ছেড়ে এসেছেন পছন্দ না হওয়ায়। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ হিন্দিতে করার অফার পেয়েও ছেড়ে দিয়েছেন। রাজেশ খান্নাকেও ফিরিয়ে দিয়েছেন। পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটের চাকরি ছেড়েছেন। আর ক্রমে তলিয়ে গেছেন হতাশায়, নেশায়। কিন্তু কোন অসুখ তাঁর? কোন অপ্রাপ্তিতে তলিয়ে গেলেন এইভাবে? এর উত্তর আজও আমরা খুঁজছি। ইতিহাসও খুঁজছে। 

    বাংলা সিনেমার দুই নক্ষত্র। দুজনে দুভাবে জ্বলেছেন, পুড়েওছেন নিজেদের মতো। আর সেই পোড়ার আলো পেয়েছি আমরা। আজও পাচ্ছি। দুজনের আলোই একসঙ্গে মিশতে পারত ‘বনপলাশীর পদাবলী’-তে। মেশেনি। বাঙালি চির দুর্ভাগা জাতি। পাওয়ার পাশাপাশি হারানোও তার নিয়তি যে। 
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @