No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    রাসবিহারীর পঞ্চবটী ওরফে ‘নীল চায়ের দোকান’

    রাসবিহারীর পঞ্চবটী ওরফে ‘নীল চায়ের দোকান’

    Story image

    রাসবিহারীর মোড় থেকে গড়িয়াহাটের দিকে ফিরে বাঁ হাতের ফুটপাত ধরে সোজা হাঁটা। সারি সারি খাবার দোকান। চা, মোমো, ফুচকা, ভেলপুরি, ইডলি-দোসা, স্যুপ, চাউমিন আরও কত কী! 

    ফুটপাত তো নয় যেন জ্যান্ত সিনেমার মধ্যে দিয়ে চলন। বিকেলের ভিড়ে ভরা ফুটপাত। তবু ব্যস্ত পা থেমে যাবে ঠিক, এক জায়গায় এসে।

    ফুটপাতের ওপর পাতা বেঞ্চ আর টুল। সেখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আঠারো থেকে আশি। সিনেমার লেটেস্ট আপডেট থেকে রান্নার রেসিপি কিংবা পুরোনো কলকাতার গপ্পো, কী নেই সেখানকার হাওয়ায়। তবে আসল আকর্ষণ উজ্জ্বল কমলা রঙের এক চিলতে এক চায়ের দোকান। সন্ধে নামলেই ঝলমলে হয়ে ওঠে সাদা আলোয়। লেক মার্কেটের বিপরীত ফুটে একটু খোঁজখবর করলেই সন্ধান মিলবে রাসবিহারীর ‘পঞ্চবটী’-র।

    রাসবিহারীতেই রয়েছে ‘ঐতিহাসিক’ রাধুবাবুর চায়ের দোকান। খুঁজলে হয়তো আরও কিছু জনপ্রিয় চায়ের ঠেকের সন্ধান মিলবে এই চত্বরে। তবে, পঞ্চবটী ইজ পঞ্চবটী। পঞ্চবটীকে ‘পঞ্চবটী’ বললে যতটা না চেনা যায় তার চেয়ে ঢের ভালো চেনা যায় ‘নীল চায়ের দোকান’ বললে। অফিসের প্রজেক্ট আলোচনার মিটিং পয়েন্ট থেকে বন্ধুদের আড্ডা ঠেক হিসেবে ধীরে ধীরে সুপরিচিত হয়ে উঠছে এই চা দোকান।

    নীল চায়ের ভালো নাম ‘অপরাজিতা চা’। অপরাজিতা ফুল শুকিয়ে তৈরি হয়। ফুটন্ত গরম জলে শুকনো ফুল দিলে তরলের রং হয় নীল। কাপে ঢালা অপরাজিতা চা-এর রং দেখে মনে পড়ে যেতেই পারে বিলুপ্ত দোয়াত-কালির কথা অথবা ভাঙা প্রেমের বিরহ। একেবারে সেই রং – নীল। সেই নীলে এক-দু ফোঁটা লেবু মেশালে নীল বদলে যায় বেগুনীতে। কাপে ঢেলে রাখা হলে যত সময় যায় তত বদলায় তরলের রং। নীল কিংবা বেগুনী থেকে ময়ূরকণ্ঠী সবুজে। 

    রংবাহারি চা

    নীল চায়ের স্বাদ লাল চা, মানে লিকার চায়ের থেকে অনেকটাই আলাদা। কোনও তুলনা বা বিচারে না গিয়ে স্বাদ পরখ করলে ঠকতে হবে না। চিনি ছাড়া খেতে বেশ লাগে। নেহাত শুধু অ্যাডভেঞ্চারের খেয়ালেও যদি চেখে দেখতে যায় কেউ, তাহলেও ঠকে যাওয়ার চান্স নেই।

    চা নিয়ে যাদের অ্যাডভেঞ্চার করা স্বভাব তাদের কাছে রাসবিহারীর এই দোকান বেশ আকর্ষণের জায়গা। দুপুরের রোদ পড়তে শুরু করলে চায়ের যন্তরমন্তর ঘরখানা চালু হয়ে যায়।

    এই যন্তরমন্তর ঘরের আসল মানুষটি কাশীনাথ সূত্রধর। পেশায় ইন্টেরিয়র ডিজাইনার। কিছুটা অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় ২০০৪ সাল নাগাদ শুরু করেন পঞ্চবটী। কখনও ইমিউনিটি বুস্টার চা, কখনও করোনা চা আবার কখন ‘লেডিজ স্পেশ্যাল’ দুর্গা চা; নানারকম পরীক্ষানিরিক্ষা চলতেই থাকে।

    কাশীনাথ সূত্রধর

    পঞ্চবটীর চায়ের সঙ্গে এই মানুষটির আকর্ষণও কিছু কম নয়। হাতে সময় নিয়ে দোকানের বেঞ্চে একবার বসে পড়তে পারলেই হল। তাঁর গল্পের ঝুলি থেকে ওমনি ঝুরঝুরিয়ে বেরিয়ে আসবে গপ্পো। অতি বড় বেরসিক মানুষেরও মুখ মনের খিল খুলে যাবে। মানুষের ভাবনাকে উস্কে দিতে তিনি ভালবাসেন। তাঁর কথায়, “যে বলে কিছু ভাবতে পারি না, তারও একটা ভাবনা থাকেই... সেখান থেকেই বোধহয় শিল্পের জন্ম হয়”।

    নদীয়ার তেহট্টের মানুষ। আশির দশকে কলকাতায় আসা। তখন ছাত্র। আইটিআই ট্রেনিং নিয়ে কেরিয়ার শুরু করেন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার হিসেবে। শ্যামবাজারের মেস বাড়িতে থাকা। সদ্য চাকরি পাওয়ার আনন্দে বন্ধুদের সঙ্গে বেশ হইহই করে দিন কেটে যায়। বেলুড় মঠের মিউজিয়াম তৈরির গল্প বলতে বলতে খুশিতে চিকচিক করে ওঠে চোখ। সেগুন কাঠের মতো টেকসই আত্মবিশ্বাসে বলেন, “পরের তিনশো বছরেও সময়ের একটা আঁচড় পড়বে না ওই মিউজিয়ামের গায়ে।”কিন্তু যন্তরমন্তরের রোমাঞ্চের নেশাটা তাঁর শিরায়। সেই নেশাতেই ইন্টেরিয়র ডিজাইনার থেকে একদিন হয়ে গেলেন সিনেমার সেটের আর্ট ডিরেক্টর। কাজ করলেন শুকনো লঙ্কা, চোখের বালির মতো বেশ কিছু বাংলা ছবিতে। ক্যামেরাতেও হাত পাকিয়েছেন।

    ইন্টেরিয়রের কাজ করতে করতেই রাসবিহারী অঞ্চলের এই স্টলের সন্ধান পান। আজকের চেহারার সঙ্গে সেদিনের সেই স্টলের কোনও মিল আন্দাজ করা যাবে না। চা দিয়ে শুরুও করেননি। ছিল ছোটখাটো খাবারের দোকান। মানুষ এসে চা খুঁজত। ধীরে ধীরে চা-এ প্রবেশ।

    পঞ্চবটী

    রান্নায় নিজের সহজাত আগ্রহে বিভিন্ন ধরনের চা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। কলকাতার কোন অঞ্চলে কী ধরনের স্পেশ্যাল চা পাওয়া যায় সে সব তথ্যও নখদর্পণে। পঞ্চবটী আজকের চেহারা পায় প্রথম লকডাউনের পর।

    ফ্যাকাশে সময়ে কিছুটা রঙ ফিরুক জীবনে। সেই ভাবনা থেকেই উজ্জ্বল রঙের ছোঁয়ায় বদলে দেন দোকানের খোলনলছে।

    পুরোনো তালিকা

    যত বাঁক বদল করেছে জীবন, তত গল্প জমেছে তাঁর ঝুলিতে। বর্তমানে একটি এনজিওর সঙ্গেও যুক্ত তিনি। সকাল থেকে দুপুর কেটে যায় এনজিওর কাজে। দ্বিপ্রহরে তিনি পঞ্চবটীর ছায়ায়। এ কাজে তাঁর যোগ্য সহযোগী তাঁর সহধর্মিনী।

    দিনের আলো যত গাঢ় হয় তত জমে ওঠে পঞ্চবটীর আড্ডা। চায়ের সঙ্গে আন্তরিকতার টানটিও বড়ো কম নয়। সেই টানেই বিদেশবাসী মানুষটিও দেখা দিয়ে যায় পুরোনো পাড়ায়। যুক্তি-তক্কো-আড্ডা-গপ্পে কাচের কাপে তুফান তুলে জমজমাট সন্ধের ফুটপাত। হাজার ব্যস্ততায় ফুটপাত বদলে নেওয়ার ফাঁকে দূর থেকে দেখলেও কোথায় যেন জেগে ওঠে এক নিখাদ বাঙালি মনকেমন… ‘নীল চায়ের ঠেক’ বেঁচে থাক বাঙালিয়ানায়...

    ছবিঃ নিজস্ব

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @