রানি পুতুল

শিল্পীদের সাথে কথা বললেও তাঁরা জানিয়ে দেন যে এমন পুতুলের অনুপ্রেরণা তাঁরা রূপ কথা থেকে তুলে আনেননি। পূর্ব পুরুষের মুখ থেকে শোনা বা জানা এক বাস্তবের রানি মা-ই তাঁদের পুতুলের আদর্শ।
কলকাতার ঘরের কাছের জেলা হাওড়া। এই জেলা মূলত পশ্চিমবঙ্গের শিল্প তালুক হিসেবেই পরিচিত। বলতে গেলে ভারতের ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র। এই জেলা শহরের তুলনা করা হয়েছে অনেকটা ওই ম্যানচেস্টারের সঙ্গে। এই হাওড়া জেলার প্রায় অনেকগুলি অঞ্চলেই তৈরি হয় এক বিশেষ ধরনের পুতুল, গড়ন গঠনে খানিকটা ষষ্ঠী পুতুল জাতের কিন্তু ষষ্ঠী পুতুল নয়। দক্ষিণ পাতিল, নরেন্দ্রপুর, জগতবল্লভপুর অঞ্চলের মানুষেরা এমন পুতুলকে আদর করে বলেন রানি পুতুল। হাওড়া জেলার শিল্পীরা আজ প্রায় বহুদিন ধরে দু’খোল ছাঁচে বানিয়ে চলেছেন এমন রানি পুতুল। পুতুলটি পোড়া মাটির আর তার পর কোনও শিল্পী পুতুলে রঙ বোলান কেউবা আবার মিশিয়ে দেন অভ্র। তবে পুতুলের রঙ ওই একটাই যা হল গোলাপি। রানির পরনে দেখা যায় ঘাগড়া-র মতো পোশাক। এ বাংলার লোকশিল্পে পুতুলের যে বিরাট সীমানা সেখানে এই পুতুলের রকম সকম ও চরিত্রের বয়ান অনেকটাই আলাদা।
এখন প্রশ্ন হল এই পুতুলের রানিটি কে ? বাংলার যত ধরনের পুরনো কথা ও কাহিনি রয়েছে সেখানে কিন্তু রাজা-রানিদের কোনও অভাব নেই। কিন্তু ঠাকুমা বা ঠাকুরদাদার রূপকথার ঝুলিতেও আমরা দেখি রাজা রানিদের ভিড়। কিন্তু সেখানে যে সব বড় রানি সুয়োরানি বা দুয়োরানিদের কাহিনি মেলে তাদের চেহারা বর্ণনের সাথে এমন পুতুল রানির কোন মিল পাওয়া যায় না। শিল্পীদের সাথে কথা বললেও তাঁরা জানিয়ে দেন যে এমন পুতুলের অনুপ্রেরণা তাঁরা রূপ কথা থেকে তুলে আনেননি। পূর্ব পুরুষের মুখ থেকে শোনা বা জানা এক বাস্তবের রানি মা-ই তাঁদের পুতুলের আদর্শ।

পুতুল গবেষকরা বলে থাকেন এমন রানির আদলের মধ্যে মিলে মিশে আছে বিলিতি গন্ধ। তা ছাড়া মুখের ঢং টিও বেশ একটু গোলগাল। এমন রানির হদিস পেতে গেলে আমাদের একটু ফিরে জেতে হয় ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার রাজ মহলে। ভারতবর্ষের প্রতি তার ভালবাসার কথা আজও ইতিহাস বিদিত। তিনি যেভাবে কোম্পানির শাসন কে বাতিল করেছিলেন, কিম্বা যেভাবে তাঁর সমস্ত রাজ কর্মচারীদের ভারতবর্ষের দিকে আদর ও দরদ দিয়ে তাকাতে বলেছিলেন তা ভারতবাসীকে মুগ্ধ করেছিল। ১৮৭৬ থেকে তিনি ভারত সম্রাজ্ঞী হন। আপামর হিন্দুস্থানের জনগণ সেদিন তার নাম দিয়েছিল ‘কাইজার- ই- হিন্দ’। সেদিন রানিকে নিয়ে ভারতবাসীর গর্ব বা উল্লাসের কোনও শেষ ছিল না। কলকাতায় এমন অনেক বাড়ি আছে যেখানে রানির ফলক বসিয়েছেন বাড়ির কর্তারা। এমন রানির নানাবিধ ভারত মুখী পদক্ষেপ দেখে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও মনে করেছিলেন যে তিনি ভারত সম্রাজ্ঞী হয়েছেন মহামহিম ঈশ্বরের আদেশে। পাথুরেঘাটার রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর লিখলেন ভিক্টোরিয়া গীতিমালা। সব মিলিয়ে নাগরিক সমাজে জখন রানিকে নিয়ে এই হুল্লোড় তখন তার রেষ লোকসমাজের কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়ল। দেখা গেল কালীঘাটের পটুয়া যখন ঝাঁসির রানির ছবিও আঁকছেন তখন তাঁরা ঝাঁসির রানির মাথায় ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার মতো অবিকল চেহারার মুকুট-টি এঁকে দিচ্ছেন। পাশাপাশি হাওড়া জেলার দক্ষিণ পাতিল বা জগতবল্লভপুরের নরেন্দ্রপুর গ্রামের শিল্পীরা যে রানি পুতুল বানালেন, তার আদলের মধ্যে শিল্পীরা নিয়ে এলেন কুইন ভিক্টোরিয়ার মুখের গোলগাল গঠনটি। সেই থেকে আজও কুইন ভিক্টোরিয়া গ্রামীণ এক শিল্পে বেঁচে রইলেন সকলের আদরের রানি পুতুল হয়ে। শিল্প ঐতিহাসিকরা দেখেছেন অভ্র মেশান লাল বা ম্যাজেন্টা রঙের রানি পুতুলের পোশাকে অথবা চুলের বিন্যাসেও রয়ে গিয়েছে বিলিতি প্রভাব। শিল্পীরা বলে থাকেন তাদের পূর্ব-পুরুষরা রানি ভিক্টোরিয়ার আদলেই তৈরি করেছিলেন এমন পুতুল। বর্তমানে জগতবল্লভপুরের শিল্পী দিবাকর পাল পরিবার পরম্পরায় আজও বানিয়ে চলেছেন এমন রানি পুতুল।