মেয়েদের শ্রমগান আনছে বিপ্লব, গান সংগ্রহে অগ্রণী ভূমিকা শিক্ষিকা চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়ের

ঘুমপাড়ানি থেকে ধান তোলার গান, শিলনোড়া বা পাটাপুতা থেকে পান্তাভাতের গান – মেয়েরা গান বেঁধে চলেছেন দীর্ঘ দীর্ঘদিন ধরে। প্রাত্যহিক দিনযাপনে জীবনের বারোমাস্যা হয়ে সে সব গান বেজে চলেছে শরীরে, মনে, প্রাণে। বহু প্রাচীনগ্রন্থে মেয়েদের গানের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু সাহিত্যের বিবর্তন যত এগিয়েছে, নারীকণ্ঠ ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে গিয়েছে। গ্রামীণ মেয়েদের গান তাই আজ খানিক আড়ালে। যদিও আজও এ বাংলার কত শত গ্রামে ভেসে বেড়াচ্ছে মহিলাদের গাওয়া গানের সুর। যা ভোলার নয়। যে সুর শুনলে মন গুনগুনিয়ে উঠতে বাধ্য। যে গানে মিশে রয়েছে আদর। দাইমা, কাটুনি, জেলেনি, গোয়ালিনী, মালিনী, কিষাণী থেকে রাঁধুনি, পরিচারকা, ভানুনি, ভাজানি, ছাতপিটানি – সংসারের জাঁতাকল সামলে প্রত্যেকের কাজই যেন গানের অংশ হয়ে উঠেছে। নারীর গান হয়ে উঠেছে শ্রমের গান (Woman Labour Songs)। এমন বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন শিক্ষিকা চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় (Chandra Mukhopadhyay)। ‘তবুও প্রয়াস’ (Tobuo Prayas) থেকে প্রকাশিত তাঁর সাম্প্রতিক একটি গ্রন্থ ‘নারীর গান শ্রমের গান’-এ উঠে এসেছে মহিলাদের জীবনগাথায় গানের মাধুর্য। চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় কথামুখ অংশে লিখেছেন, “উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে মেয়েদের সাক্ষরতার হার চার শতাংশের কাছাকাছি; তার মধ্যে কলম ধরতে পেরেছিলেন অতি সামান্যজন।” কিন্তু হাতে লেখাই কি শিক্ষার একমাত্র পরিচয়? নারীদের অন্তর্বিশ্বে প্রবেশ করলে উপলব্ধি করা যাবে তাঁদের তৈরি হাজার হাজার গান নদীমাতৃক বাংলাকে সুরমাতৃক করে তোলে। সেই সুরের বিশ্ব থেকে গিয়েছে খানিক আড়ালে। নারীর জীবনযন্ত্রণা যত বেড়েছে, গান তত দৃপ্ত হয়েছে। হয়ে উঠেছে একাকিত্বের প্রিয় বন্ধু।
মেয়েদের শ্রমগান রেকর্ড করছেন চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়
মেয়েদের তৈরি হাজার হাজার গান নদীমাতৃক বাংলাকে সুরমাতৃক করে তোলে। সেই সুরের বিশ্ব থেকে গিয়েছে খানিক আড়ালে। নারীর জীবনযন্ত্রণা যত বেড়েছে, গান তত দৃপ্ত হয়েছে। হয়ে উঠেছে একাকিত্বের প্রিয় বন্ধু।
চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় বেশ কয়েকবছর ধরে অবিস্মরণীয় কাজ করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে তিনি সংগ্রহ করেছেন অজস্র নারীশ্রমের গান। শুধু সংগ্রহই করেননি, ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে (গীদালি/Geedali) গানের কথা-সুর সবটাই নিজে গেয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন আরও হাজার হাজার নারীর মধ্যে। এখনও অসংখ্য গ্রামীণ মেয়ের শুধু বাড়ির মধ্যেই চলে কত কাজ। ঘর-নিকানো, বাসনমাজা, কাপড় কাচা, মশলা কোটা, জ্বালানি জোগাড় করা, রান্না করা, সবাইকে খেতে দিয়ে তারপর নিজের মুখে কিছু তোলা, সন্ধ্যায় আবার প্রদীপ জ্বালা, রাত্রের খাবার তৈরি করা – সব কাজ একা হাতে সামলানো কি মুখের কথা? এই সমস্ত কাজের আলাদা আলাদা গান রয়েছে তাঁদের। গানের কথা মেয়েদের, সুরও মেয়েদের। চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, “খেতখামার থেকে ঘর – সবদিকের কাজ করেও কিছু কাজ মেয়েরা করেন, বৃত্তি হিসেবে বংশ পরম্পরা ধরে। গানে ‘চিকন গোয়ালিনী’-র কথা, কবি চণ্ডীদাসের প্রেম প্রসঙ্গে রামী রজকিনীর কথা বা অন্নদামঙ্গলে ঈশ্বরী পাটনির কথা আমরা জানি। চর্যাপদে তো মেয়েদের শুঁড়িখানা চালাবার কথাও পাওয়া যায়। ...মেয়েদের নিপীড়িত, নির্বাক, অসহায় দেখানোর যে একপেশে চর্চা, তার পাশাপাশি এই স্বাধীন কর্মরতাদের কথা, বিশেষ মর্যাদায় স্মরণ করার চেষ্টা করেছি।”
জলপাইগুড়িতে চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়
‘নারীর গান শ্রমের গান’ বইটি চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় নানান ঘটনা পরম্পরায় সাজিয়েছেন। সেখানে উঠে এসেছে মেয়েদের প্রাত্যহিক জীবনের লড়াই আর সাহসের অফুরন্ত জেদ। নারী শ্রম সংগীত, চাষবাস খেতখামার, শস্য থেকে খাদ্যঃ নানা রূপ নানা ধাপ, আহার্যের সন্ধানঃ খালবিল ঝোপজঙ্গল, জল আনাঃ নদী-পুকুর, ঘর সামলানো হেঁশেল সামলানো, জীবিকা দক্ষতা সৃজনশীলতা, জন পুরোহিত এবং প্রাণের স্ফুরণ ধারণ আর লালন – ৯টি শিরোনামে উজ্জ্বল এই বই। পড়তে পড়তে নিশ্চিতভাবে গানের সুরের কাছে পৌঁছে যাবেন পাঠকরা। কিন্তু সরাসরি হয়তো ছুঁতে পারবেন না। লেখিকা সুরের পরিচিতির জন্য কয়েকটি গানের, দু-চার পংক্তির স্বরলিপি করে দিয়ে সে কাজ সারতে চাননি। কারণ তাঁর মতে, গানের অন্যতম মূল অংশ ভাবকে এভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। প্রসবযন্ত্রণার গানের সুর কি স্বরলিপিতে ধরা যায়? সুরের কাছে পৌঁছানোর জন্য চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়ের ইউটিউব চ্যানেলটিই যথেষ্ট। নিজে গান গেয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন গানের সারমর্ম।
গ্রামবাংলার মেয়েদের গান, একটি তথ্যচিত্র
কিন্তু আজকের শহরে মেয়েদের এমন হাজার হাজার গান কি ব্রাত্য? উত্তরে শিক্ষিকা-লেখিকা জানাচ্ছেন, শহরের মেয়েদের গানের ইতিহাস তুলনামূলকভাবে দুর্বল। এখনও হয়তো শহরের মেয়েরা এসব গান গাইছেন, কিন্তু তাঁর শিকড় ওই গ্রামেই রয়েছে। কিংবা গ্রামে থাকা মা-ঠাকুমাদের থেকে তিনি শিখেছেন। এমনকি মেয়েদের নিজস্ব গান নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন বহু গ্রামে এখনও বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা গান তৈরি করছেন, সুর দিচ্ছেন, গাইছেন।
যন্ত্রসভ্যতা আসার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে বসেছে দৈনন্দিন রোজনামচা। এখনকার শিশুরা অনেকেই ঘুমপাড়ানি গান থেকে বঞ্চিত। তার জায়গায় এসেছে ইউটিউবে গান চালিয়ে ঘুম পাড়ানো। কৃত্রিমতা ক্রমশ জাঁকিয়ে বসেছে। দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলার নানা গ্রামে ছুটে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়ের। এই দীর্ঘ গবেষণার কাজে তাঁকে সাহায্য করেছেন অনেক মানুষ।
মালদায় চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়
ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় এখনও অনেক মহিলা নিরক্ষর, কিন্তু তাঁরা নিজেদের গানের জন্য আলাদা জায়গা তৈরি করেছেন। সেই মেয়েদের চিনতে হলে সরাসরি তাঁদের গান শোনা উচিত। কারণ লিখিত সাহিত্যে মেয়েদের শ্রম সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে কম জানা যায়। গত ৩৫ বছর ধরে চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় এরকম হাজার হাজার মহিলার সঙ্গে দেখা করেছেন, যাঁদের সকলেরই নিজস্ব গান রয়েছে। সংগ্রহ করেছেন প্রায় ছয় হাজারেরও বেশি গান, যার মধ্যে দেড় হাজারটি গান বাংলাদেশের। ৬৭ বছর বয়সী শিক্ষিকা-লেখিকা জানান, বাংলাদেশে না গিয়েই নানাজনের সূত্রে তিনি গানগুলি সংগ্রহ করেছেন। এ-ও জানান, এই ধরনের গানে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার প্রায় নেই বললেই চলে। মেয়েদের কণ্ঠটিই সেখানে বিশেষ মর্যাদা পায়।
গত ৩৫ বছর ধরে চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় এরকম হাজার হাজার মহিলার সঙ্গে দেখা করেছেন, যাঁদের সকলেরই নিজস্ব গান রয়েছে। সংগ্রহ করেছেন প্রায় ছয় হাজারেরও বেশি গান, যার মধ্যে দেড় হাজারটি গান বাংলাদেশের।
বাংলার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা পরিশ্রমী, ধীময়ী, দরদি গ্রামীণ মেয়েরা আজও ধারণ করে রেখেছেন নিজস্ব সংস্কৃতি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এইভাবে তাঁরা স্মৃতি আগলে বাঁচিয়ে রাখছেন সৃজন। চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়ের কথায় তাঁরা কেউ হাস্যময়ী, গুণবতী। প্রয়োজনে তাঁরাই প্রতিবাদী বাংলার মা-মেয়ে।
চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়ের গবেষণাধর্মী গ্রন্থ
___________________
নারীর গান শ্রমের গান – চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় – প্রকাশকাল ২০২২ – মুদ্রিত মূল্য ৩৫০ টাকা – তবুও প্রয়াস প্রকাশনী
প্রাপ্তিস্থান – তবুও প্রয়াস দপ্তর (১৯/২ রাধানাথ মল্লিক লেন, কলকাতা, ৭০০০১২)
চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়ের ইউটিউব চ্যানেলের লিংক – গীদালি/Geedali