রামকৃষ্ণদেবের প্রিয় তেলেভাজার দোকান আজও বেঁচে বরানগরে

শ্রীরামকৃষ্ণদেব ভক্তের সেবার্থে মা কালীর কাছে ডাব-চিনি যেমন চাইতেন, তেমনই ভক্তদের আপ্যায়নে নিজেও রকমারি খাবারের পদ খেতে ভালোবাসতেন। এহেন শ্রীরামকৃষ্ণদেবই চেটেপুটে খেতেন ‘ফাগু সাহু’-র কচুরি। সেইসব গল্প আজো শোনা যায় বরাহনগরের প্রাচীন এবং সুপ্রসিদ্ধ ‘মুখোরুচি’ নামের নিরামিষ তেলেভাজার দোকানে এসে পড়লে।
এই দোকানের সঙ্গে রামকৃষ্ণদেবের সম্পর্ক ঘিরে কতই না গল্প-ইতিহাস। রামকৃষ্ণদেব ফাগুর খুব ভক্ত ছিলেন। একদিন কলকাতা থেকে ঘোড়ার গাড়িতে করে ফিরছেন। সঙ্গে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র রামলাল এবং গাড়ির কোচম্যান। রাস্তার ওপারে ফাগুর নিরামিষ তেলেভাজার দোকান। রামকৃষ্ণদেব রামলালের কাছে জানতে চাইলেন, “ট্যাকে পয়সা আছে?” রামলাল হ্যাঁ বলতেই নির্দেশ এল, “যাও কচুরি কিনে আনো।” রামলাল কচুরি আনতে গেলেন। রামকৃষ্ণদেব বসে গাড়িতেই। ফাগু খুব যত্ন করতেন রামকৃষ্ণকে। প্রথমেই তিনি জল ও দুই খিলি পান দিলেন। তারপর দিলেন কচুরি। রামলাল সেই কচুরি এনে দেখেন রামকৃষ্ণদেব গাড়িতে নেই। কোচম্যানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ঠাকুর অনেক আগেই গাড়ি থেকে নেমে সোজা চলে গেছেন।” রামলাল তখন রামকৃষ্ণ যেদিকে গিয়েছেন সেই দিকে ছুটলেন। কিছুদূর গিয়ে তাঁকে দেখতে পেয়ে রামলাল জানতে চাইলেন, “কোথায় যাচ্ছেন একা?” রামকৃষ্ণদেব তখন ভাবের ঘোরে বলছেন, “ফাগুর কচুরি খাব”। সেই ভাবের ঘোরেই গোঁ ধরে তিনি হন্ হন্ করে দক্ষিণেশ্বরের দিকে হাঁটতে থাকেন।
'মুখোরুচি'র তেলেভাজার ভাণ্ডার
বরানগর অঞ্চলের একদিকে চলে গিয়েছে গোপাললাল ঠাকুর রোড, তার অন্যপ্রান্তে কাশীপুর রোড। এমনি দুই রাস্তার সংযোগস্থলে কালী মন্দিরের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিখ্যাত নিরামিষ তেলেভাজার ‘ফাগুর দোকান’, যার পোশাকি নাম ‘মুখোরুচি’। ইতিহাস এই দোকানের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে। সারাটা দিন দোকানে ক্রেতাদের আনাগোনা লেগেই রয়েছে। সকাল হোক, বিকেল হোক বা সন্ধে, যে-কোনো পথচলতি মানুষ ওই দোকানের ছাঁকা তেলে ভাজা কচুরি, চপ, ঝুড়িভাজার গন্ধ পাবেনই। বয়স বাড়লেও তেলেভাজার স্বাদে কিন্তু কোনো খাদ মেশেনি এখনো। সেই স্বাদের জনপ্রিয়তাকে উপেক্ষা করতে পারতেন বা বলেই হয়তো ভক্তদের মারফত রামকৃষ্ণদেবের কাছে বারবার পৌঁছে যেত এই দোকানের কচুরি।
এই তল্লাটে ‘মুখোরুচি’ ছাড়াও আরো অনেক তেলেভাজার দোকানই কিন্তু চোখে পড়ার মতো। কিন্তু, আর পাঁচটা দোকানের থেকে তো ‘মুখোরুচি’ আলাদা। দোকানে ঢুকলেই ফটোফ্রেমে বাঁধানো একটি বিশেষ লেখা, “এই কালী মন্দিরের ঠিক উত্তরপার্শ্বে ফাগুর দোকান ছিল। ফাগুর দোকানের কচুরি খাইতে শ্রী শ্রী শ্রীরামকৃষ্ণদেব ভালবাসিতেন(১১) যেখানে সেই খোলার চালের খাবার দোকান ছিল সেখানে এখন পাকাবাড়ী উঠিয়াছে, একখানি খাবারের দোকানও সেই স্থানে চলিতেছে নাম –“মুখোরুচি” (মূল বানান অপরিবর্তিত)। লেখাটির নিচে বরানগর রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের ১৯৬৭ সালের ‘সোভিনিয়র'-এর উল্লেখ।
সেই বিখ্যাত ফটোগ্রাফ
‘মুখোরুচি’র কচুরি, চপ খেয়েছেন অথচ দোকানের এই ফটোগ্রাফ চোখে পড়েনি এমন ব্যক্তি পাওয়া দুর্লভ। বর্তমানে দোকানের পাশে একটি কালীমন্দির আজও রয়েছে। খুব সম্ভবত, দোকানে ঝোলানো ফটোগ্রাফটিতে যে কালীমন্দিরের নামোল্লেখ করা হয়েছে এটি সেই মন্দিরই। আবার এই দোকানের সামনে দিয়ে বিস্তৃত কাশীপুর রোডের ওপর কিছু দূরেই শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বসতবাড়ি ‘উদ্যানবাটী’ অবস্থিত। সুতরাং কালীপ্রতিমা দর্শনের আশায় রামকৃষ্ণদেব যখন মন্দিরে যেতেন, তখনই ফাগুর দোকানের কচুরি খেতেন। লোকমুখে এমন গল্পই ঘোরে আজও।
কিন্তু কে এই ফাগু? পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ফাগু সাহু ছিলেন বিহারের বাসিন্দা। কাজের খোঁজে বিহার ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়। তারপর আর ফিরে যাননি। চার-পাঁচ পুরুষ ধরে চলে আসছে তাঁর এই ব্যবসা। ফাগু সাহু প্রথম সামান্য একটু জায়গায় এই দোকান তৈরি করেছিলেন। তখন এটি ছিল খোলার চালের তৈরি। পরে, ফাগু সাহুর থেকে গোপী সাহু জায়গাটি কিনে নেন। এরপর বাবুলাল সাহু নতুনভাবে পাকাবাড়ি বানিয়ে ওইখানে তেলেভাজার দোকানটি একইভাবে চালাতে থাকেন। বর্তমানে কালীচরণ সাহুর তিন ছেলের (রতনলাল সাহু, রাজেশ সাহু এবং বিনোদ সাহু) যৌথ প্রচেষ্টায় এই দোকান আজও রমরমিয়ে চলছে।
দোকানে বিনোদ সাহু এবং রাজেশ সাহু
সাহু পরিবারের ছোটো ছেলে বিনোদ সাহু বলছিলেন, “আগেকার দিনে লোকবসতি কম থাকার পাশাপাশি জিনিসপত্রের দামও অনেক কম ছিল। এত বেশি দোকানও তখন ছিল না। সেই সময় এই দোকানে চপ, তেলেভাজার পাশাপাশি গাওয়া ঘি দিয়ে ভাজা কচুরিও তেরি হত। তখন কখনো কখনো আর পাঁচজনের মতো শ্রীরামকৃষ্ণদেবও এই দোকানের কচুরি, জিলিপি খেতে আসতেন। এই দোকানের তেলেভাজা খেতে তিনি ভালোও বাসতেন খুব।” বিনোদ সাহু আরো বলছিলেন, এখন এই এলাকায় আরো অনেক চপের দোকান তৈরি হয়েছে। প্রতিযোগিতা বেড়েছে, জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে। সেখানে শুধু ইতিহাসকে সামনে ধরে রাখলে দোকান চলবে না। সঙ্গে অন্যান্য দোকানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাবারের মান ও জনপ্রিয়তা ধরে রাখার কাজটাও করতে হয়।
দোকানের আইটেম কিন্তু কম নয়। কচুরি তো রয়েছেই, সঙ্গে ক্রেতাদের কাছে সমান জনপ্রিয় এই দোকানের ডালবড়া, ক্যাপসিকাম চপ, আলুর চপ, কাশ্মীরি চপ, সিঙাড়া, নিমকি, ঝুড়িভাজার মতো লোভনীয় সব তেলেভাজার পদ। দামও একেবারে নাগালের মধ্যে। নিত্যদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা অবধি চলে দোকানের বিক্রি-বাট্টার কাজ।
‘মুখোরুচি’-র আয়তন কিন্তু আজও বাড়েনি। আয়তনে ছোটো হলেও ইতিহাস, স্বাদ আর জনপ্রিয়তার ভর করে এই দোকান আজও তৃপ্তি দিচ্ছে হাজারো মানুষকে। মালিকানা বা নাম বদল হলেও এই দোকানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রামকৃষ্ণদেবের ইতিহাস আজও মোছেনি। মোছেনি দোকান ঘিরে থাকা ক্রেতাদের ভিড়। ঝাঁ চকচকে দোকানের পাশে এমন আটপৌরে প্রাচীন দোকান দেখলে ভালো লাগে। শিকড়ের একটা গন্ধ পাওয়া যায় যে। সেও কি কম পাওয়া!
তথ্যসূত্র- ‘শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’; বর্তমান পত্রিকা, রবিবার, ২০০৮ (শ্রীরামকৃষ্ণ বিশেষ কিছু দোকানের খাবার কেন পছন্দ করতেন?)।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা- বিনোদ সাহু।