No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    রাজনীতি থেকে রামায়ণ বাড়িয়ে বলার ইতিহাস

    রাজনীতি থেকে রামায়ণ বাড়িয়ে বলার ইতিহাস

    Story image

    সত্যযুগ নাকি শুরু হয়েছিল এক রবিবার থেকে। বোঝো কাণ্ড! ছুটু-ফুটি বলে কারও কোনও বোধ ছিল না! সেটা ছিল, বৈশাখের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথি। সত্যযুগ কত দিন ছিল? ১৭,২৮,০০০ বছর। সব মানুষ তখন নাকি মিনিমাম বাঁচত ৪০০ বছর! আবার পৌরাণিক অভিধানে সুধীরচন্দ্র সরকার লিখেছেন, মানুষগুলো নাকি ছিল ২১ হাত লম্বা। তার পর থেকে যত পাপ করেছে, তত ছোট হয়েছে মানুষ। পাপ করতে করতে এক দিন হয়তো মিলিয়েই যাবে! কে জানে! কিন্তু কথা তা নিয়ে নয়। এই লেখার বিষয় হল বাড়িয়ে বলা অভ্যাস। যমন ওই ৪০০ বছর বা ২১ হাত কি বাড়িয়ে বলা নয়?

    হাতের দশ আঙুলই সম্ভবত মানুষের প্রথম ক্যালকুলেটর। গোণা গুণতির ইতিহাসে, সংখ্যা হিসেবে শূন্যের আবিষ্কার ভারতেই। তাই বোধ হয় ভারতীয়দের শূন্যের দিকে একটু বাড়তি ঝোঁক আছে। বিশেষ করে বাঙালির তো আছেই সংখ্যা বাড়িয়ে বলার অভ্যাস। বাঙালার নেতাদের মুখেও সব সময়ই শোনা যায় তাদের সভায় ১৫ লক্ষ থেকে ৫০ লক্ষ মানুষের জমায়েতের গল্প। এর অবশ্য একটা ভারতীয় পরম্পরা আছে। সে কথায় আসছি।

    মহাভারত, রামায়ণ পড়তে গেলে এই ধারণা আরও জোরালো হয়।শূন্যের এমন বাড়াবাড়ি রামায়ণেও অজস্র। মাত্র ১২ বছরের বালক রাম এবং লক্ষ্মণ চলেছেন বিশ্বামিত্রের সঙ্গে। পথে মারীচ এবং সুবাহু রাক্ষস সদলে তাদের আক্রমণ করল। রাম মারীচকে মারবেন না। তাই শীতেষু নামের মানবাস্ত্র-এর সাহায্যে ‘মারীচকে মূর্ছিত ও বিঘূর্ণিত করিয়া শত যোজন (আটশত মাইল) দূরে সমুদ্রে নিক্ষেপ করিয়াছেন’।

    রাম যে বালিকে মারতে পারবেনই প্রথমে সুগ্রীবের তেমন বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাই ভাবলেন পরীক্ষা করা যাক। ‘পরীক্ষার উদ্দেশ্যে সুগ্রীব বালি নিক্ষিপ্ত দুন্দুভির (পর্বতের মতো এক রাক্ষস) কঙ্কাল রামকে দেখাইলে রাম পদাঙ্গুষ্ঠের দ্বারা সেই কঙ্কালকে দশ যোজন দূরে নিক্ষেপ করিলেন’। তার আগে পঞ্চবটীতে হেমন্তকালে যখন রাম আক্রান্ত হলেন, বাল্মীকি বলছেন ‘খর, দূষণ, ত্রিশিরা প্রভৃতি প্রধান রাক্ষসগণ সহ চৌদ্দ হাজার রাক্ষসসেনা মাত্র দেড় মুহূর্তের মধ্যেনিহত হইয়াছে’।

    এর পর, ‘কিষ্কিন্ধ্যা পর্ব’। সুগ্রীবের সৈন্য সংগ্রহ প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, ‘ধূলিজালে সূর্য আচ্ছন্ন হল, চতুর্দিক তমসাবৃত হল, শৈল ও কানন সমেত পৃথিবীকম্পিত হতে লাগল। নানা স্থানথেকে আগত নানা বর্ণের কোটি কোটি বানরসৈন্যসমস্ত ভূমি পর্বত বন আবৃত করে ফেলল। এখানেও সেই কোটির কমে কোনও কথা নেই। আবার ‘সুন্দর কাণ্ড’-এ, নাগমাতা সুরমাকে বোকা বানাতে হনুমান তার দেহ বড় করতে শুরু করল। কতটা? ‘হনুমানের দেহ ক্রমে দশ ত্রিশ পঞ্চাশ ষাট সত্তর ও নব্বই যোজন হল’। এক যোজন মানে ৮ মাইলের বেশি। যদি ৮-ই ধরা যায়, তাহলে হনুমানের দেহ ৯০ যোজন হল মানে ৭২০ মাইল ছাড়িয়ে যাওয়া। এটাকে শূন্যের বাড়াবাড়ি বলব না!

    রামায়নের ‘যুদ্ধকাণ্ড’ বলছে, রাবণের সৈন্যসংখ্যা ১০ সহস্র কোটি। তারা মাংসশোণিতভোজী। কুম্ভকর্ণ, শূর্পনখাদের চেহারার বর্ণণা আমরা জানি। কিন্তু শ্রীলঙ্কার ভূমি এলাকা যে মাত্র ৬৪৭৪০ বর্গ কিলোমিটার। তা হলে রাক্ষসসেনা পিছু যে জায়গা পাওয়া যাচ্ছে, তা হল মাত্র ০.০০০৬৪৭৪ বর্গ কিলোমিটার। সেটাও আসলে ভুল। কারণ সাধারণ ‘রাক্ষস নাগরিকরাও’ তো ছিল। তার পর, বাড়ি ঘর রাস্তা পার্ক বন জঙ্গল সে সবও তো ধরতে হবে! আরও একটা কথা। বলা হচ্ছে শুধু সেনাই ১০ সহস্র কোটি। অথচ ২০১৫ সালেই দেখা যাচ্ছে, ওই দেশটার জনসংখ্যা সোয়া দু’কোটিরও নীচে।

    রাম কত দিন রাজত্ব করেছেন? ২৫ বছরে তাঁর অরণ্যযাত্রা। ৩৯-এ

    ফিরে আসা। তার পর দশবর্ষসহস্রাণি দশবর্ষশতানি, তার মানে এগারো হাজার বছর রাজত্ব করেছেন রাম। সুখময় ভট্টাচার্যের মতে, মহর্ষি জৈমিনির মীমাংসাদর্শনে একটি সূত্র আছে। ‘অত্যুক্তি বা অসম্ভব উক্তি স্থলে বৎসর শব্দে দিন বুঝিতে হইবে। তদানুসারে এগারো হাজার বৎসর এগারো হাজার দিন, অর্থাৎ ত্রিশ বৎসর এক মাস বিশ দিন বুঝিতে হইবে’।

    এবার মহাভারত। ‘উদযোগ পর্ব’-এ যেমন। দুযোর্ধন আর অর্জুন দ্বারকায় এলেন কৃষ্ণকে ম্যানেজ করতে। কিন্তু ব্যাসদেব তো কেসটাকে এত সহজে হতে দেবেন না। ফলে কৃষ্ণ তখন নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। অর্জুন কৃতাঞ্জলি হয়ে বসে পড়লেন পায়ের কাছে। দুর্যোধন শিয়রে। কৃষ্ণ ঘুম থেকে উঠে কাকে কী দিলেন? প্রথমে অর্জুনকে বললেন, পার্থ, নারায়ণ নামে আমার ১০ কোটি গোপ যোদ্ধা অছে, তুমি তাদের চাও, না নিরস্ত্র কৃষ্ণকে? এই ১০ কোটি গোপ সেনার গল্পেও মনে হয় শূন্যের গোরু অনেকটাই গাছে চড়েছে। কেন? কারণ কৃষ্ণের গোপ সেনাই ১০ কোটি। তার পর তো আরও শত শত রাজা-গজারা পড়েই রইলেন। মনে রাখতে হবে ভারতের মোট সেনা-সংখ্যা এখনও এর চেয়ে বহু বহু কম। সংখ্যাটা আসলে ব্যাসদেব মনের আনন্দে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বলেই মনে হয়। কৃষ্ণ গেলেন অর্জুনের দিকে, ১০ কোটি গোপ যোদ্ধা দুযোর্ধনের দিকে। এর পর দুযোর্ধন দেখা করলেন ভোজ বংশের রাজা কৃতবর্মার সঙ্গে। পত্রপাঠ তিনিও দিনিও দিয়ে দিলেন এক অক্ষৌহিনী সেনা। মানে, ১,০৯,৩৫০ পদাতিক, ৬৫,৬১০ ঘোড়া, ২১,৮৭০ হতি, ২১,৮৭০ রথ। কৃতবর্মার দেওয়া হাতির সংখ্যাটা একটু বেশিই মনে হয়। কারণ, ২০১২ সালের হাতি শুমারি অনুসারে ভারতে এখন হাতির সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। সে কালে জঙ্গল টঙ্গল বেশি ছিল ঠিকই, কিন্তু এক কৃতবর্মারই যদি বিলিয়ে দেওয়ার মতো হাতি থাকে প্রায় ২২ হাজার, বাকি রাজারা কি হাতিশালে গোরু মোষ পুষতেন! তবে ঘোড়ায় মনে হয় তেমন জল নেই। সর্বশেষ লাইভস্টক সেনসাস অনুসারে ভারতে এখনই ৬ লক্ষের বেশি ঘো্ড়া আছে। ফলে ওই সংখ্যাটা মানতেই হবে বিশ্বাসযোগ্য।

    তবে সব শেষে এ কথাও মানতে হবে, বাড়িয়ে না বললে কি মহাকাব্য হয়? ওসব হল গিয়ে আর্টের সংখ্যা। ওদিকে তেমন তাকাতে নেই।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @