চণ্ডাল ত্রিশঙ্কুর জন্য দ্বিতীয় স্বর্গ বানালেন বিশ্বামিত্র

শূদ্র-তপস্বী শম্বুক স্বর্গে যাওয়ার স্বপ্ন দেখার অপরাধে খুন হয়েছিলেন। শম্বুকের গল্প অনেকরই জানা, তবু এই বেলা একটু বলে নেওয়া বোধহয় জরুরি। বনবাস থেকে ফিরে রাম রাজ্য শাসন করছেন। সেই সময়ে একদিন এক ব্রাহ্মণ তার মৃত ছেলেকে কোলে করে নিয়ে এসে বিলাপ করতে করতে রামকে বললেন, নিশ্চই রাজ্যে কোনও পাপকর্ম অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তাই তার ছেলের এই অকাল মৃত্যু। রাম বশিষ্ঠ, নারদ সহ আট জন উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বসলেন। নারদ রামকে বললেন নিশ্চয় কোথাও লুকিয়ে কো্নও শূদ্র ঘোর তপস্যা করছে, তাই রাজ্যে এই অকাল মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এই কথা শুনে রাম ধনুর্বাণ, খড়্গ নিয়ে পুষ্পক রথে উঠে বেরোলেন শূদ্র-তপস্বীর খোঁজে। পুর্ব পশ্চিম এবং হিমালয় সংলগ্ন উত্তর দিকে অনুসন্ধান করে কিছু খুঁজে পেলেন না। এর পর বিন্ধ্য পর্বতেরও দক্ষিণে শৈবলগিরির উত্তরে এক সরোবর দেখতে পেলেন। দেখলেন সেই সরোবরের তীরে অধোমুখে লম্বমান তপস্যারত একজনকে। বিন্ধ্যগিরির দক্ষিণ ছিল আনার্য অধ্যুষিত। তপস্বীকে রাম জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কোন বর্ণের অন্তর্ভুক্ত এবং কেন তপস্যা করছেন। তপস্বী উত্তর দিলেন, তাঁর নাম শম্বুক, তিনি বর্ণে শূদ্র, তিনি তপস্যা করছেন যাতে তিনি সশরীরে দেবলোকে যেতে পারেন। রাম কোষ থেকে খড়্গ বের করে শম্বুকের মাথা কেটে ফেললেন। ওই সময়ে ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু প্রভৃতি দেবগণ রামচন্দ্রকে ধন্য ধন্য করলেন। শুরু হল পুষ্পবৃষ্টি। এই প্রসঙ্গে এসেই যায় আর একটি মৃত্যুর কাহিনি। অকালে মৃত সন্তানকে নিয়ে ভগবান বুদ্ধের কাছে এসেছিলেন এক মা। প্রায় একই রকম গল্পের শুরুটা। তবে শেষটা অন্য রকম। ভগবান বুদ্ধের উত্তর ছিল আরেক রকম।
সে যাই হোক, শম্বুকের মৃত্যু নিয়ে ভিন্ন মতও আছে। এবার সেই গল্প।আসলে রামায়ণ তো অসংখ্য। আর সব রামায়ণই রামায়ণ। সব রামায়ণেরই ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস ভূগোল। যাঁরা বিশুদ্ধ মূল রামায়ণ খুঁজবেন তাঁরা অনেক মণি মুক্তো হারাবেন। রামচরিতের সব সংস্করণই বৈধ এবং বৃহৎ অর্থে ভারতীয়। দ্বাদশ শতাব্দীর তামিল কবি কম্বন রচিত ‘রামবতারম’-এর রাম কাহিনির উপর নির্ভর করে এবং আরও আরও নানা উপ-কাহিনি যোগ করে যে জনপ্রিয় ছায়াপুতুল-নাচ দক্ষিণে প্রচলিত আছে, সেই লৌকিক রামায়ণে আছে, শম্বুক শূর্পণখার পুত্র। নিহত হয়েছিলেন লক্ষ্মণের হাতে। তবে অজান্তে।
শম্বুকের কথা যখন হলই এতটা তখন আর এক চণ্ডালের কথা না বলা অপরাধ হবে। বিশেষ করে সেই চণ্ডালের নাম যখন ভোট নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক আলোচনায় প্রায়ই উচ্চারিত হয়। তিনি ত্রিশঙ্কু।
ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা ছিলেন ত্রিশঙ্কু। তিনি কোনও কারণে মনে মনে ঠিক করলেন মহাযজ্ঞ করে, না মরে জেগে জেগেই স্বর্গে চলে যাবেন। মানে সশরীরে। রাজার ইচ্ছা। না বলবে কে! কিন্তু বললেন একজন। ত্রিশঙ্কু কুলপুরোহিত বশিষ্ঠকে ডেকে মনের বাসনার কথা প্রকাশ করলেন। বশিষ্ঠ বললেন, ওটা হবে না। সম্ভব নয়। তখন ত্রিশঙ্কু গেলেন বশিষ্ঠর পুত্রদের কাছে। তাঁরাও রাজি হলেন না। ক্রুদ্ধ ত্রিশঙ্কু বললেন, এই অবস্থায় তাঁকে অন্য পথ দেখতে হবে, মহাযজ্ঞ তিনি করবেনই। এই কথায় বশিষ্ঠের পুত্রেরা ক্রুদ্ধ হয়ে ত্রিশঙ্কুকে অভিশাপ দিয়ে বললেন, তুমি চণ্ডালত্ব প্রাপ্ত হও। সঙ্গে সঙ্গেই রাজা ত্রিশঙ্কু বিকটদর্শন চিতাভস্মাচ্ছাদিতদেহ চণ্ডাল হয়ে গেলেন। তাঁকে ওই অবস্থায় দেখে মন্ত্রী, অনুগামীরা সবাই পালিয়ে গেলেন। একাকী রাজা ত্রিশঙ্কু তাঁর চণ্ডাল রূপ নিয়েই গেলেন মুনি বিশ্বামিত্রের কাছে। বললেন, জীবনে কখনও অন্যায় করিনি, পাপ করিনি, ধর্মপথে থেকেছি, যাগযজ্ঞ যথাযথ ভাবে করেছি, এখন আমি সশরীরে স্বর্গে যেতে চাই, তাতেই বশিষ্ঠ ও তাঁর পুত্রদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত ও অভিশপ্ত হয়ে চণ্ডালত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন।
বিশ্বামিত্র রাজি হলেন ত্রিশঙ্কুর জন্য সেই যজ্ঞ করতে। বিরাট করে যজ্ঞ হল। কিন্তু যজ্ঞকর্তা চণ্ডাল হওয়ায় কোনও দেবতাই যজ্ঞীয় ভাগ গ্রহণ করতে উপস্থিত হলেন না। বিশ্বামিত্র ক্রুদ্ধ হয়ে নিজের তপস্বার তেজে ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু চণ্ডালকে ইন্দ্র স্বর্গে ঢুকতেই দিলেন না। ফলে ত্রিশঙ্কু ফের স্বর্গ থেকে অধোমস্তক হয়ে পৃথিবীর দিকে পড়তে শুরু করলেন। মহামুনি বিশ্বামিত্র ত্রিশঙ্কুর আর্তনাদ শুনতে পেয়ে তাঁর তেজ দিয়ে সপ্তর্ষিমণ্ডল ও অন্যান্য নক্ষত্রমালা সহ ত্রিশঙ্কুর জন্য একটা দ্বিতীয় স্বর্গ তৈরি করে সেখানে তাঁকে আশ্রয় দিলেন। প্রথম স্বর্গে ঠাঁই হয়নি, কিন্তু ত্রিশঙ্কু শব্দটা থেকে গেছে। ভোটের ফল শেষ পর্যন্ত ত্রিশঙ্কু হয় কি না, এ তো আমরা প্রতিনিয়তই বলে থাকি আলোচনায়।