ওরা না থাকলে রামায়ণ লেখা হত না

তারা যদি না থাকতেন, সীতা উদ্ধার হত না। রামায়ণও লেখা হত কি না সন্দেহ। বানরসেনা তো গায়ে গতরে খেটেছিল সীতা উদ্ধারে। কিন্তু কোথায় আছেন বন্দিনী সীতা, কোন পথে যেতে হবে সীতা উদ্ধারে, সে সব হদিশ দিয়েছিলেন অন্য দু’জন। তারা হলেন রামায়ণের দুই পাখি। জটায়ু আর সম্পাতি। দুই ভাই। ৮হাজার বছর আগে এক দুর্ঘটনায় হারিয়ে গিয়ে এক জন দণ্ডকারণ্যে অন্য জন বিন্ধ্য পর্বতে বাস করতেন। জটায়ুর বয়স ৬০ হাজার বছর। সম্পাতির আরও বেশি। সম্পাতি জটায়ুর দাদা। অরণ্য কাণ্ডে আছে, রামের বাবা রাজা দশরথের বন্ধু জটায়ু এক দিন ঘুমোচ্ছিলেন, এমন সময় সীতার চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে যায়। দেখলেন রাবণ সীতাকে নিয়ে আকাশপথে চলেছেন। ৬০ হাজার বছরের বৃদ্ধ, যুবক রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে নামলেন। রাবণের রথ ভেঙে দিলেন। ধনুক ভেঙে দিলেন। রথের সারথীকে হত্যা করলেন। রাবণ জটায়ুর দিকে নালীক, নারাচ, বিকর্ণী প্রভৃতি অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। জটায়ু রাবণের বাঁ দিকের ১০ হাত কেটে দিলেন। মায়া বলে অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই রাবণের নতুন ১০টি হাত গজিয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত রাবণ খড়গ দিয়ে জটায়ুর দু’টি ডানা এবং দুই পা কেটে দিলেন। গৃধ্ররাজ জটায়ু মৃতপ্রায় হয়ে ভূপতিত হলেন।
সীতা খুঁজে না পেয়ে রাম গোদাবরী নদীর কাছে জানতে চাইলেন সীতা কোথায়? রাবণের ভয়ে নদী কোনও উত্তর দিল না। এর পর দেখা হল রক্তাক্ত জটায়ুর সঙ্গে। জটায়ুর মুখে, শরীরে রক্ত দেখে লক্ষ্মণ এবং রাম দু’জনেই ভাবলেন, জটায়ুই সীতাকে খেয়ে ফেলেছেন। রাম ধনুকে বাণ পরিয়ে জটায়ুকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন। জটায়ু তা দেখে বললেন, আমি এমনি মারা যাব। আমাকে হত্যা কোরো না। এই বলে রামকে জটায়ু বললেন সীতাহরণের কাহিনি। মারা যাবার আগে জটায়ু আরও দুটো কথা বলে গেলেন। বললেন যে ‘মুহূর্তে’ রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে গেছেন তাকে বলে ‘বিন্দ’ মুহূর্ত। এই মুহূর্তে যে ধন চুরি যায় তা শীঘ্র ফিরে আসে। এবং অপহরণকারী বিনষ্ট হয়। জটায়ু বললেন, তুমি শীঘ্রই জানকীকে ফেরত পাবে। আর বললেন, বিশ্রবার পুত্র কুবেরের ভ্রাতা রাবণ এই কাজ করেছে। এই বলে প্রাণত্যাগ করলেন জটায়ু।
পাখিরা বহু দূর দেখতে পায়। কোন পাখি কত দূর দেখতে পায় তার বিবরণ জটায়ুর দাদা সম্পাতি দিয়েছিলেন বানরদের। বানররা সীতাকে খুঁজতে খুঁজতে বিন্ধ্য পর্বতে এসে হাজির। বহু মাস কেটে গিয়েছে। সীতার কোনও খোঁজ মেলেনি। সীতার খোঁজ না নিয়ে ফিরে গেলে সুগ্রীব কী শাস্তি দেবেন কে জানে! তার থেকে বরং এইখানেই অনশন করে মরে যাওয়া ভালো, এই সব ভাবছিলেন সুগ্রীবের ছেলে অঙ্গদ ও অন্যান্য বানররা। অঙ্গদ এমন কথাও বললেন, যে তার দাদা বালীকে হত্যা করতে পারে, সেই সুগ্রীবকে বিশ্বাস করা যায় না। সেখানেই ৮ হাজার বছর ধরে বাস করতেন জটায়ুর দাদা রামায়ণের আর এক পর্বতপ্রমাণ পাখি সম্পাতি। সম্পাতি যখন বানরদের কাছে শুনলেন রাবণ জটায়ুকে হত্যা করেছে, সম্ভবত তাঁর মধ্যেও জেগে উঠেছিল প্রতিশোধের ইচ্ছে। সম্পাতি বললেন তিনি দেখতে পাচ্ছেন সীতাকে। রাবণের হাতে বন্দিনী সীতাকে। বললেন সেই পরম রমণীয়, বিশ্বকর্মার তৈরি লঙ্কা নগরী এখান থেকে একশো যোজন দূরে সাগরের মাঝখানে। বললেন, সেই নগরীর ‘সুবর্ণময় দ্বার, কাঞ্চনময় বেদী, হেম বর্ণ অতি বৃহৎ প্রাসাদ এবং সূর্যতুল্যবর্ণ উন্নত প্রাকার...’। সম্পাতি বললেন, রাবণের অন্তঃপুরে সীতাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তাঁকে পাহারা দিচ্ছে রাক্ষসীরা। তোমরা অবিলম্বে লঙ্কানগরী গমন কর। সেখানেই সীতাকে পাবে। এত কিছু বলে সম্পাতির কেমন যেন মনে হল এই সব বানররা ওঁর কথা বিশ্বাস করবে তো! তখন সম্পাতি বললেন, পাখিরা বহু দূর পর্যন্ত দেখতে পায়। তিনিও সীতাকে দেখতে পাচ্ছেন। তবে সব পাখি সমান দেখতে পায় না। সম্পাতি বললেন, ‘চড়াই, পায়রা জাতীয় পাখি যারা ধান খায়, তারা আকাশের প্রথম ভাগ পর্যন্ত দেখতে পায়। কাক এবং বৃক্ষফলভোজী শুক প্রভৃতি পাখিরা দেখতে পায় আকাশের দ্বিতীয় ভাগ পর্যন্ত। বন্ন কুক্কুট, ক্রৌঞ্চ এবং চক্রবাক বিহঙ্গগণ তৃতীয় ভাগ পর্যন্ত, শ্যেনসকল চতুর্থ ভাগ এবং গৃধ্রগণ পঞ্চম ভাগ পর্যন্ত যাইয়া থাকে। রূপযৌবনসম্পন্ন, বল-বীর্য্যশালী হংসগণ আকাশের ষষ্ঠভাগ পর্যন্ত গমন করে। আর বিনতানন্দন গরুড় এবং অরুণ আকাশের সপ্তম ভাগ পর্যন্ত গমন করিয়া থাকে। আমরা সেই বিনতানন্দন গরুড় এবং অরুণ হইতে জন্মগ্রহণ করিয়াছি’। জটায়ু এবং সম্পাতির বাবা ছিলেন অরুণ।
পুরাকালে বৃত্রাসুরকে বধ করার পর অহঙ্কারের বশে জটায়ু এবং সম্পাতি আকাশমার্গে যাত্রা করেছিলেন ইন্দ্রকে জয় করতে। ইন্দ্রকে জয় করে ফেরার পথে সূর্য যতক্ষণ না অস্তাচলে যায় স্পর্ধাবশে তাকে অনুগমন করতে থাকেন দুই ভাই। সূর্য মধ্য গগনে এলে তার তেজে জটায়ু মাটিতে পড়ে যেতে থাকেন। তাঁকে বাঁচাতে জটায়ুকে নিজের ডানা দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করেন সম্পাতি। তাতেই সম্পাতির দু’টি ডানা দগ্ধ হয়ে গেল। তিনি জড়ীভুত হয়ে বিন্ধ্যাচলে পতিত হলেন। সেখানেই ছিল নিশাকর ঋষির আশ্রম। নিশাকর ঋষি চিনতেন সম্পাতিকে। কিন্তু পুড়ে যাওয়া সম্পাতিকে তিনি প্রথমে দেখে চিনতে পারেননি। যখন চিনলেন, বললেন তুমি এখানেই থাক। কোনও এক দিন রামের দূত এখানে আসবে সীতা অপহরণের খোঁজ নিতে। তুমি তাদের সঠিক খবর দিও। এই বলে ঋষি নিশাকর হিমালয়ে চলে গেলেন। পরে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। সেই থেকে হাজার হাজার বছর ধরে সম্পাতি অপেক্ষা করে ছিলেন, কবে রামের দূত আসবে! কবে তাদের দেবেন সীতার খবর! এই হল রামায়ণের দুই পাখির কাহিনি। (চলবে)