'নিজের কাজে কোনোদিন কম্প্রোমাইজ করেননি তিনি'

ক্রমে কমে আসিতেছে দীর্ঘদেহী উচ্চ শির সুপুরুষ মানুষ।
তবুও ছিলেন এক জন রামানন্দ সেনগুপ্ত, আমাদের কাছাকাছি এই কলকাতাতেই, কমপ্রোমাইজ না-করেও, একশো-এক বছর পার করেও, জীবিত! আজ্ঞে হ্যাঁ, বুধবার সকাল পর্যন্ত। কিন্তু সকাল পৌনে-নটায় হাইফেনেটেড(৮ মে ১৯১৬- ২৩ আগস্ট ২০১৭)হয়ে গেল তাঁর জীবনরেখা। অপরাহ্নে ক্যাওড়াতলা মহাশ্মশানে তাঁর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন হল।

২৫ বৈশাখ ঢাকার উয়ারি-তে জন্ম। বাবা সতীশচন্দ্র সেনগুপ্ত, মা সুরমা দেবী, বড়ো দাদা জ্যোতিষ চন্দ্র সেনগুপ্ত(জ.১৯০০), মেজদা সৌরেন্দ্রনাথ(১৯০২)। আরেক ভাইয়ের মৃত্যু ঘটে পাঁচ বছর বয়সেই। বাবা ছিলেন রেলের এঞ্জিনিয়ার। সেই সূত্রে ছোটোবেলা কেটেছে অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়ালটেয়ারের কাছে টুনি বলে একটা জায়গায়। ন-বছর বয়সে মা ও মামা ক্ষিতিমোহন সেনের সঙ্গে জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে, তারপর সেখান থেকে শান্তিনিকেতনের শিশু বিভাগে ভর্তি করে দেওয়া হয় তাঁকে পড়াশোনার জন্যে। সেই বয়সে দক্ষিণ ভারতে কাটানোর দরুন কিশোর রামানন্দ তেলেগু তামিল মালয়ামালম বলতে পারলেও বাংলা বুঝতে পারলেও বলতে পারতেন না... এর ফলে আমার মনে একটা হীনমন্যতা বোধ হত। বাঙালি হয়েও বাংলা বলতে পারি না, প্রায় সময়ই গাছে উঠে লুকিয়ে থাকতাম ...একদিন গুরুদেব নিচ দিয়ে যাচ্ছেন, দেখতে পেয়ে নেমে আসতে বললেন। নেমে এলাম, বললেন বাড়িতে বাংলায় চিঠি লিখতে পারো তো, বাবা মায়ের খবর নেওয়াও হবে, বাংলাটাও শেখা হবে ...।” (শেষ দু-লাইন অর্ক দেবের নেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে নিলাম)।
১৯২৮সালের জানুয়ারি মাসে বাবার মৃত্যু ওঁদের পরিবারের সবকিছু ওলটপালট করে দেয় ... ফিরে যেতে হয় ঢাকায় তারপর ১৯৩০ সালে আবার কলকাতায় ফিরে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
...চেয়েছিলাম গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে চিত্রশিল্পী হতে, হয়ে গেলাম চলচ্চিত্র জগতের চিত্রগ্রাহক । ... ১৯৩৮ সালে ফিল্ম কর্পোরেশন স্টুডিও'তে ‘আশা’ নামে একটা ছবির মাধ্যমে প্রথম সিনেমার সঙ্গে যোগাযোগ হয় আমার। ছবিটি ছিল বাংলা, অথচ পরিচালক এবং আলোকচিত্রশিল্পী দু'জনেই ইংরেজ। বাঙালি ভালো চাষ করে, তারা আবার সিনেমাও করবে, এটা বোধহয় স্টুডিওর অবাঙালি মালিকেরা তেমন বিশ্বাস করতে পারেননি।
পরাধীন দেশ তার ওপর গায়ের রঙ কালো বলে রামানন্দকে আবদুল বলে ডাকত ইংরেজ ক্যামেরাম্যানরা। ক্যামেরায় হাত দিতে দিত না, ছুঁতে দিত না কিন্তু যাঁর শেখার তাগিদ প্রবল তাকে ঠেকায় কে! ক্যামেরা কুলি চিন্তামণি শিখিয়ে ছিলেন ম্যাগাজিনে ফিল্ম রোল ভরার কাজ । শুটিং-এর সময় ট্রলি ঠেলার একটা ছন্দ থাকে, ফাঁকা না-থেকে সেই কাজ শিখলেন। তারপর পেলেন জি কে মেহতাকে ডিওপি হিসেবে আর তিনি সহকারী। মেহতাজী তাঁকে পুত্র স্নেহে দরদ দিয়ে কাজ শেখান। ১৯৪৭ সালে, আলোকচিত্রশিল্প-পরিচালক হিসেবে আমি প্রথম স্বাধীনভাবে পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির কাজ করি ‘পূর্বরাগ’ ছবিতে। অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় ছিলেন ছবিটির পরিচালক। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ঐ ছবিতেই প্রথম সংগীত পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। জহর রায়-ও তাঁর অভিনয়-জীবন শুরু করেছিলেন একটি বিশেষ চরিত্রে রূপ দিয়ে। তাছাড়া ‘পূর্বরাগ’ ছবিতে আমার সহকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন অসিত সেন। ওটিই চলচ্চিত্রে তাঁর প্রথম কাজ।

১৯৪৮ সালে রেনোয়া লোকেশন হান্টিং-এর জন্য প্রথমবার কলকাতায় আসেন, সঙ্গে এসেছিলেন গন উইথ দ্য উইন্ড ও হাউ গ্রিন ওয়াজ মাই ভ্যালি –র অন্যতম ক্যামেরাম্যান ক্লাইড ডিভিনা । হরিসাধন দাশগুপ্ত ছিলেন রেনোয়ার সহকারী, তিনিই ক্লাইডের সঙ্গে রামের আলাপ করিয়ে দেন। ক্লাইড রামানন্দকে শুটিং দেখার অনুমতি দিল । সেখানে শুধু শুধু শুটিং না দেখে নিজে থেকে যেচে ক্ল্যাপস্টিক দেওয়ার দায়িত্ব নেন রামানন্দ কিন্তু রেনোয়ার কাজ দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে ক্ল্যাপস্টিক দিতে ভুলে যান এবং এ-জন্য রিভার-এর প্রযোজক আমেরিকান ফরেস্ট জাড তাঁকে সর্বসমক্ষে তিরস্কার করেন। পরে রামানন্দ যে ক্ল্যপস্টিক বয় নন তিনি ক্লাইডের গেস্ট এবং পুরোদস্তুর এক জন ক্যামেরাম্যান তা জানতে পেরে রেনোয়া তাঁর কাছে ক্ষমা চান। এরকমই লোকেশন হান্টিং-এর শুটিং-এর সময়, হুগলি নদীতে নৌকোতে ক্যামেরা বসিয়ে নদীতে ঢেকি-জাল দেওয়ার দৃশ্য তুলতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল তো সে সময় ক্যামেরা চালকের ইশারা অনুযায়ী জালের নৌকায় গিয়ে জাল তোলা ও ডোবানোর কাজটি এমনভাবে করলেন যাতে তৎক্ষণাৎ শট ওকে হয়ে গেল। তারপরই ...আমি ‘দি রিভার’ ছবির অপারেটিং ক্যামেরাম্যান এর দায়িত্ব পাই। ট্রলি ঠেলা, ক্ল্যাপস্টিক দেওয়া, ঢেঁকি জাল দেওয়া এই ঘটনাগুলি টিম কনসেপ্টে বিশ্বাস করা, সংঘবদ্ধতা, কোনো কাজকে আমার-নয় মনে-না-করা অর্থাৎ কর্ম মর্যাদায়(এটির বড়োই অভাব দেখি এদেশে)বিশ্বাস এই দিকগুলি প্রতিভাত হয়। সৌমেন্দু রায় বলেছেন, “... রামদার ছত্রছায়ায় তৈরি হয়েছি।...সবাইকে নিয়ে চলেছেন। কারোর সঙ্গে কখনও রেগে কথা বলেননি।...গায়ের রঙ কালো কিন্তু সুপুরুষ। ভালো উচ্চতার, আর সেই উচ্চতাকে মান্যতা দিয়ে মাথা উঁচু করে চলতেন। নিজের কাজে কোনোদিন কম্প্রোমাইজ করেননি ।” অসিত সেনের মতো দীনেন গুপ্তও ছিলেন রামানন্দর প্রধান সহকারী। সুব্রত মিত্রের শুরুটাও তাই। তাঁর বয়ানেই থাকল, ১৯৪৯ সালের কোনও একদিন রেনোয়ার ‘দি রিভার’ ছবির ক্যামেরাম্যান ক্লদ রেনোয়া এসে আমাকে বললেন- " একটি ছেলে অবজারভার হিসেবে এই ছবির কাজে থাকতে চাইছে, তোমার কোনো আপত্তি আছে ? আমি ক্লদকে বললাম- তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে আমার কোনও আপত্তি নেই। ক্লদ বলল- " আসলে ও তোমার ক্যামেরার পেছনে থেকে কাজটা দেখতে চায়, তাই তোমার অনুমতিটা দরকার।" তারপর ১৯৫০-এর একদিন সুব্রত মিত্র অবজারভার হিসেবে দি রিভার ছবির শুটিং-এ উপস্থিত হলেন। এরপর থেকে প্রতিদিন সুব্রত শুটিং -এ আসতেন এবং আমাদের ক্যামেরার পেছনে থেকে সিরিয়াসলি ছবির কাজ দেখতেন। ওঁর সঙ্গে থাকা একটি খাতায় শুটিং-এর খুঁটিনাটি নোট করতেন এবং স্টিল ক্যামেরায় ছবি তুলতেন। আমার তরফ থেকে আমি ওঁকে টেকনিকালার ক্যামেরার ফাংশান দেখাতাম। ক্যামেরায় লুক থ্রুও করতে দিতাম ব্যাপারটা বোঝার জন্য। আর লাইট টা করত ক্লদ নিজে। আর্ক ল্যাম্পের লাইটিং হত। শ্যাডো টাডো থাকত না। এটা হয়ত সুব্রত কে প্রভাবিত করে থাকবে। সুব্রত এই ছবিতে ছোট্ট একটা পার্টও করেছিলেন। উনি সেতার বাজাতে পারতেন। রেনোয়া তাই ওঁকে ছবিতে সেতার বাজানোর একটা পার্ট করতে বলেছিলেন। সুব্রত রেনোয়ার অনুরোধে সেই দৃশ্যে সেতার বাজিয়েছিলেন। এরপরই সুব্রতর সঙ্গে রেনোয়ার পরিচয়টা পাকাপোক্ত হয়েছিল।

রামানন্দ সেনগুপ্ত মোট ৭৫টি ছবিতে ক্যামেরা চালিয়েছেন যার মধ্যে বাংলা ছবির সংখ্যা ৬৩, অন্য ভাষায় ৫টি আর তথ্যচিত্র ৭টি। স্বাধীন দায়িত্বে তোলা তাঁর প্রথম ছবি পূর্বরাগ (১৯৪৭); পরিচালনা : অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় আর শেষ ছবি অজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচালনায় শ্রীমতি হংসরাজ( ১৯৮৯)। ঋত্বিক কুমার ঘটকের প্রথম ছবি নাগরিক (১৯৫২), মৃণাল সেনের প্রথম ছবি রাতভোর (১৯৫৫), পার্থপ্রতিম চৌধুরীর হংসমিথুন (১৯৬৮), চিত্ত বসুর বিন্দুর ছেলে(১৯৫২), চিত্রকরের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (১৯৫৯), অগ্রগামীর নিশীথে(১৯৬৩) ও শিল্পী (১৯৫৬), উৎপল দত্তর ঘুম ভাঙার গান (১৯৬৫) অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের নায়িকার ভূমিকায়(১৯৭২), আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের তিন ভুবনের পারে(১৯৬৯) ছবির কথা মনে পড়ল।
রামানন্দ সেনগুপ্ত এক জন বিরল প্রজাতির, সৎ, আপোসহীন এবং জাত বাঙালী চিত্রগ্রাহক। বয়সে বঙ্গ চলচ্চিত্রেরও(১৯১৭)অগ্রজ, চলেও গেলেন বাংলা সিনেমার শতবর্ষে।
বিদায়!
ভালো থাকবেন রামানন্দবাবু।
পুনশ্চ : ইটালিকসে রামানন্দ সেনগুপ্তর নিজের কথা যা নিয়েছি আজও মনে পড়ে গ্রন্থ থেকে―প্রকাশক নর্থ ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি । ছবি : দেবানন্দ সেনগুপ্ত ।