চোখ নয়, মন দিয়ে দেখো : নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমির ভিন্ন পাঠ

বই-বাঁধাই প্রশিক্ষণ
একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে ৬৬টি বছর কম কথা নয়। এক ঝলকে এই দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসকে বর্ণনা করাও এক কথায় অসাধ্য। তার উপর যদি সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির পিছনে থাকে এক অনন্য ইতিহাস। এই অনন্য ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে প্রায় ৬৬ বছর ধরে এগিয়ে চলেছে রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমি, নরেন্দ্রপুর (Ramakrishna Mission Blind Boys Academy, Narendrapur)।
কথা হচ্ছিল রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমি, নরেন্দ্রপুরের অধ্যক্ষ ব্রহ্মচারী অসীমচৈতন্য মহারাজের সঙ্গে। এক অনাবিল তৃপ্তিতে তিনি শুনিয়ে গেলেন ১৯৫৭ সালে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির সেই অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য ইতিহাস। বলা যায় এক দৃষ্ঠিহীন ব্যক্তির শুধুমাত্র নরেন্দ্রপুর মিশনে পড়তে চাওয়ার ইচ্ছে থেকেই জন্ম নিল এই নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইড বয়েজ অ্যাকাডেমি।
এবার সেই ইতিহাসে আসা যাক। ১৯৫৭ সাল। স্বামী লোকেশ্বরানন্দ মহারাজ তখন সবে মাত্র নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর কাছে ভবানীপ্রসাদ চন্দ্র নামে প্রেসিডেন্সিতে পড়া এক দৃষ্টিহীন ব্যক্তি এসে বললেন, তিনি রামকৃষ্ণ মিশনে পড়তে চান। লোকেশ্বরানন্দ মহারাজ তখন সদ্য নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন তৈরি করেছেন সাধারণ ছাত্রদের জন্য। তাই ভবানীপ্রসাদকে হ্যাঁ বা না কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কেন না, ভবানীপ্রসাদ চোখে দেখতে পান না।
ভবানীপ্রসাদ চন্দ্র
কীভাবে তাঁকে নরেন্দ্রপুর মিশনে সাধারণ পড়ুয়াদের সঙ্গে ভর্তি করা হবে, সেটা বড়োই চিন্তায় ফেলে দিল স্বামী লোকেশ্বরানন্দ মহারাজকে। কিন্তু ভবানীপ্রসাদ নাছোড়বান্দা, তিনি বললেন, তাঁকে একবার কলেজের রাস্তাটা দেখিয়ে দিলেই হবে। তারপর তিনি নিজেই যাওয়া আসা করতে পারবেন। সেই থেকেই ভবানীপ্রসাদ চন্দ্র’র যাত্রা শুরু নরেন্দ্রপুর রামকৃ্ষ্ণ মিশনে। ভবানীপ্রসাদ চন্দ্রই নরেন্দ্রপুর ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমির প্রথম ছাত্র, এই কাহিনি বলছিলেন নরেন্দ্রপুর ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমির বর্তমান অধ্যক্ষ ব্রহ্মচারী অসীমচৈতন্য মহারাজ। ব্রহ্মচারী অসীমচৈতন্য মহারাজ আরও জানালেন, নরেন্দ্রপুর ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমির প্রথম অধ্যক্ষ হিসাবে ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন এখানকার প্রথম ছাত্র ভবানীপ্রসাদ চন্দ্র।
মহারাজ বলছিলেন, ভবানীপ্রসাদ চন্দ্রর পাশাপাশি আরও কয়েকজন দিব্যাঙ্গ ব্যক্তি আসতে শুরু করলেন। তাঁরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন এবং নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্রাবাসে থাকতেন। এই ভাবে দিব্যাঙ্গরা সেই ১৯৫৭ থেকে ছাত্রাবাসে থাকতে শুরু করলেন। আর তাই এই ১৯৫৭ সালকেই রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমি, নরেন্দ্র পুরের যাত্রা শুরুর সময় হিসাবে ধরা হয়।
এরপর ১৯৫৯ সালে রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমির ভবন তৈরি হয়। এভাবে যাত্রারম্ভের পর প্রথমে দশম শ্রেণি তারপর একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণির পাঠক্রম চালু হয় রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমিতে। আজ ৬৬ বছরে অনেক দৃষ্টিহীনের জীবনজ্যোতি প্রজ্জ্বলিত করতে সক্ষম হয়েছে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন ক্যাম্পাস সংলগ্ন রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমি।
রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমিতে সাধারণ পড়াশোনায় খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়। অ্যাকাডেমির নিজস্ব আইটিআই, ব্রেল প্রেস, কেন ফ্যাক্টরি, মশলা তৈরির কারখানা, যেমন রয়েছে তার পাশাপাশি পশুপালন, কৃষিজ ফসল উৎপাদনের প্রশিক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থাও রয়েছে। ১৯৬৫ সালে তৈরি হওয়া রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমির ব্রেল প্রেস ভারতের মধ্যে অন্যতম ব্রেল প্রেস বলে জানালেন ব্রহ্মচারী অসীমচৈতন্য মহারাজ।
এই প্রতিষ্ঠানে পড়ে ক্ল্যাট ক্লিয়ার করে বর্তমানে ভুবনেশ্বর ল’কলেজে পড়ছেন এমন ছাত্র আছে। কেউ কেউ এখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। এছাড়াও যাঁরা বয়স্ক অথচ রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমি থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন, তাঁদের পশুপালন, কৃষি সংক্রান্ত কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার পথে এগোতে সাহায্য করা হয় বলে জানান অধ্যক্ষ। এছাড়াও ক্রাফ্ট, বুক বাইন্ডিংয়ের প্রশিক্ষণও পায় এখানকার দৃষ্টিহীন পড়ুয়ারা।
প্রতি বছর জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে বার্ষিক অনুষ্ঠানে এই ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমির সারা বছরের উল্লেখযোগ্য কাজ থেকে বিশেষ কিছু কাজকে বেছে নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়৷ তাতে হস্তশিল্প, পুষ্প প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকে। এই বছরও বার্ষিক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ঘরে ছাত্রদের তৈরি নানারকম কর্মকাণ্ড – তাদের তৈরি মডেল ও অন্যান্য কাজ প্রদর্শিত হয়েছে। আলাদা আলাদা ভাবে ছিল ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান এবং হস্ত ও কারুশিল্পের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা। সবটাই কিন্তু এই দৃষ্টিহীন ছাত্রদের কৃতিত্ব। এই সব শিল্পকর্ম চোখে দেখলে মনে হয় না দৃষ্টিহীন ছাত্রদের হাতে তৈরি। সত্যিই অবাক হতে হয়।
সমাজের আর পাঁচজনের থেকে যে দৃষ্টহীনরা আলাদা নয় সেটাই প্রতিটি মুহূর্তে প্রমাণ করে চলেছে নরেন্দ্রপুর ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমি। এখানকার শিক্ষকরা মনে করেন, দৃষ্টি যাদের আছে, সেই ছাত্রদের সঙ্গে বিশেষ কোনও পার্থক্য দৃষ্টিহীন ছাত্রদের নেই, তাই তাদের আমরা আলাদা করে দেখার কথা ভাবি না। শুধু দৃষ্টিহীনদের পড়ানোর পদ্ধতিটা আলাদা, এটাই যা পার্থক্য।
বিভিন্ন মডেল, ব্রেইল পদ্ধতি, বিশেষভাবে তৈরি চার্ট, ম্যাপ এসবের সাহায্যে অডিও-ট্যাকটাইল পদ্ধতিতে দৃষ্টিহীন ছাত্রদের নরেন্দ্রপুর ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমিতে পড়ানো হয়।
আজ যে আধুনিক পদ্ধতিতে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমির পড়ুয়াদের পড়ান হচ্ছে, ১৯৫৭ সালে ৯জন ছাত্র নিয়ে মিশনের একটি পৃথক কক্ষ থেকে যখন যাত্রা শুরু হয়, তখন এসব কিছুই ছিল না। তবে সময় যত এগিয়েছে বেড়েছে ছাত্রসংখ্যা, পরিকাঠামোগতভাবে উন্নত হয়েছে এখানকার শিক্ষাদান পদ্ধতি ও ব্যবস্থা। অভিজ্ঞতা মানুষকে নতুন ভবাে ভাবতে, চলতে শেখায়, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
নরেন্দ্রপুর ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমির বর্তমান ছাত্রসংখ্যা ১৫২। নতুন ছাত্র ভর্তি হয়েছেন যা তাঁদের নিয়ে এই সংখ্যাটা ১৭০ এ দাঁড়াবে বলে অধ্যক্ষ জানালেন। এই ছাত্রদের মধ্যে কৃষিবিদ্যা, আইটিআই, সাধারণ স্কুলের ছাত্ররা রয়েছেন। মোট ১৮০ ছাত্রকে পড়ানোর ব্যবস্থা এখানে আছে বলে অধ্যক্ষ মহারাজ জানালেন। এই স্কুলে ভর্তির নিয়ম সরকারি স্কুলে ভর্তির নিয়মের মতো একই হলেও দিব্যাঙ্গদের জন্য ২ থেকে ৩ বছরের একটা ছাড় আছে।
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমিতে প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি খুব উন্নত মানের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার পাঠ দোওয়া হয়। কৃষিশিক্ষা ও পশুপালন বিষয়ে দুবছরের ডিপ্লোমা কোর্স করানো হয়। লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টটি বা প্রাইভেট আইটিআই শিক্ষার ব্যবস্থা আছে যা সরকারি আইটিআই অর্থাৎ কারিগরি শিক্ষা বিভাগ কর্তৃক স্বীকৃত।
এখানকার পড়ুয়ারা যেহেতু চোখে দেখেন না, তাই তাঁদের ধারণা তৈরির উপর নির্ভর করে পাঠদান করা হয়। তাই দৈনন্দিন জীবনে আমরা যে সব জিনিস দেখতে পাই তার মাটির মডেল তৈরি করে সেগুলোকে হাত দিয়ে স্পর্শ করে ফলমূল, পশুপাখি চিনতে শেখান হয়। বিভিন্ন জীবজন্তুও চেনানো হয় মাটির মডেলের মাধ্যমে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘কনসেপ্ট ডেভেলপমেন্ট’।
এ ছাড়াও নরেন্দ্রপুর ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমিতে রয়েছে দেশের মধ্যে অন্যতম আঞ্চলিক ব্রেইল প্রেস ও অডিও বুক রেকর্ডিং সেন্টার। বাংলা ইংরেজি সহ দশটি ভাষায় ব্রেইল বুক ও অডিও বুক তৈরি হয় এখানে।
এখানকার দৃষ্টিহীন পড়ুয়ারা মনে করে, তারা জয় করে নিতে জানে আর এই কাজে তাদের সাহস দেন এখানকার শিক্ষকরা। কাজেই দৃষ্টিহীন বলে তাদের মনে কোনও গ্লানি নেই। তারা নিজেদের সমাজের দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষদের থেকে নিজেদের হীন মনে করেন না, কেন না এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের ভাবতে শেখায়, “তুমি কারও থেকে কম নয়, তুমি কারও থেকে পিছিয়ে নেই”। কাজের মধ্য দিয়েই জ্ঞানদৃষ্টি প্রজ্জ্বলিত করে সব দেখা যায়। কোনও ভাবেই তাই সমাজের মূল স্রোত থেকে এদের আলাদা করা যায় না। রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমির কাজ মনে করিয়ে দেয় সেই গান, “অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো..”।
তথ্যসূত্রঃ ব্রহ্মচারী অসীমচৈতন্য মহারাজ, অধ্যক্ষ, রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমি, নরেন্দ্রপুর
ছবিঃ ব্রহ্মচারী অসীমচৈতন্য মহারাজ