রামকৃষ্ণদেবকেও ধমক দিতেন যে নাস্তিক ডাক্তার

‘তুমি পরমহংসগিরি করছ কেন?’
মহেন্দ্রলাল সরকারের এমন প্রশ্ন শুনে তাজ্জব রামকৃষ্ণদেবের শিষ্যরা। কিন্তু, কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না। এত বড়ো মাপের ডাক্তার। গিরিশচন্দ্র ঘোষ সহ বন্ধুস্থানীয় অনেকে অনুরোধ করেছেন বলেই তো রামকৃষ্ণদেবের চিকিৎসা করতে এসেছেন তিনি। এদিকে মহেন্দ্রলালের বিশ্বাস, এই ‘পরমহংস’ আসলে মথুরবাবুর শখের জিনিস ছাড়া আর কিছুই না। বড়োলোকদের এমন অনেক শখ থাকে। রামকৃষ্ণদেবের অবতারের তত্ত্বে একদমই বিশ্বাস করেন না ডাক্তার মহেন্দ্রলাল। অতএব, গিয়েই সোজা বসলেন রামকৃষ্ণের বিছানায়। তা দেখে ভক্তরা আরো ঘাবড়ে গেলেন। রামকৃষ্ণদেবের বিছানায় তো তিনি ছাড়া আর কেউ বসে না। ভক্তদের আপত্তিতে অবশ্য মহেন্দ্রলালের ভারি বয়েই গেছে। তাঁর কাজ ডাক্তারি। বিছানায় না বসলে রুগি দেখবেন কেমন করে!
মহেন্দ্রলাল সরকারকে যাঁরা চিনতেন, তাঁরা অবশ্য মোটেও খুব অবাক হননি এই আচরণে। এই কিংবদন্তী ডাক্তার মানুষটি খুবই দুর্মুখ। তার ওপরে নাস্তিক। তাঁর কথা যাকে বলে, ‘লাঠি মারা কথা’। নাহলে ভাবোন্মত্ত রামকৃষ্ণদেবের নাচগান দেখে তিনি ধমকে উঠে বলতে পারেন— ‘তুমি এরকম তিড়িংবিড়িং করবে না।’ রামকৃষ্ণদেবও কিন্তু ভয় পেতেন মানুষটিকে। রাখাল ডাক্তারকে নাকি বলেছিলেন— ‘মহেন্দ্র সরকার দেখেছিল, কিন্তু জিভ এমন জোরে চেপেছিল যে ভারি যন্ত্রণা হয়েছিল, যেন গরুর জিভ চেপে ধরেছে।’
অদ্ভুত মানুষ ছিলেন বটে মহেন্দ্রলাল সরকার। শৈশবেই বাবার মৃত্যুর পর কলকাতার নেবুতলায় মামাবাড়িতে মানুষ। ভর্তি হলেন হেয়ার সাহেবের ‘স্কুল বুক সোসাইটি’-তে (পরবর্তীতে হেয়ার স্কুল)। কিছুদিনের মধ্যেই ওলাওঠায় মৃত্যু হল হেয়ার সাহেবের, কলেরায় মারা গেলেন মহেন্দ্রলালের মা-ও। নিজেও অসুস্থ হয়ে স্কুল ছাড়তে বাধ্য হলেন মহেন্দ্রলাল। কিন্তু, উমাচরণ মিত্র আর টোয়েন্টিম্যান সাহেবের তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা চালিয়েই গেলেন মেধাবী মহেন্দ্রলাল। কৈশোর থেকেই দেশে কুসংস্কারের বাড়াবাড়ি দেখে তিতিবিরক্ত মহেন্দ্রলাল ডাক্তারি পড়তে পড়তেই হয়ে উঠলেন ঘোর নাস্তিক। খানিকটা কঠিন, রুক্ষও। মেডিকেল কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালীন একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটালেন মহেন্দ্রলাল। পঞ্চম বর্ষের ক্লাস নিচ্ছিলেন ডাক্তার আর্চার। তাঁর একটা প্রশ্নের উত্তর কেউ পারছে না, দরজার পাশ থেকে সেই প্রশ্ন শুনে উত্তর দিয়ে দিলেন মহেন্দ্রলাল। বিস্মিত আর্চার আবিষ্কার করলেন উঁচু ক্লাসের আরো বহু জিনিসই জানে মহেন্দ্রলাল। আগুনের মতো নাম ছড়িয়ে পড়ল তাঁর। একাধিক বৃত্তি, মেডেল নিয়ে ১৮৬৩-তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় এমডি হিসেবে পাশ করলেন মহেন্দ্রলাল।
কুসংস্কার, পুজো-আচ্চা, কীর্তনে মেতে থাকা জাতির ভিতরে প্রকৃত বিজ্ঞানচেতনার উন্মেষ ঘটাতে আজীবন চেষ্টা করে গেছেন ডাক্তার সরকার। তাই লন্ডনের ‘রয়্যাল ইনস্টিটিউশন’ এবং ‘ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্স’-এর মতো জাতীয় বিজ্ঞানসভা তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। যে প্রতিষ্ঠান চালাবে ভারতীয়রাই। তাঁর এই উদ্যোগের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জাস্টিস দ্বারকানাথ মিত্র, কেশবচন্দ্র সেন, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর সহ আরো অনেকে। ‘বঙ্গদর্শন’-এর পাতায় (১৮৭৩, ভাদ্র) বঙ্কিমচন্দ্র এই প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করার জন্য উদারহস্তে দান করতে অনুরোধ করলেন সবাইকে। ১৮৭৬-এ তৈরি হল বহু আকাঙ্ক্ষিত ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স’। সরলাদেবী চৌধুরাণীও এখানে আসতেন ফিজিক্স-বিষয়ক বক্তৃতা শুনতে। মহেন্দ্রলালের সংস্পর্শে এসে বিজ্ঞানচর্চায় আগ্রহী হয়েছিলেন গিরিশচন্দ্রও।
এহেন মহেন্দ্রলাল প্রথম চিকিৎসাজীবনে মনে করতেন, হোমিওপ্যাথি হল বুজরুকি। কিন্তু, ১৯০২-তে ‘ফিলজফি অফ হোমিওপ্যাথি’ নামের একটি বই পড়ার পর আমূল বদলে যায় তাঁর চিন্তা। শুরু করলেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা। ‘ক্যালকাটা জার্নাল অফ মেডিশিন’ ততদিনে প্রকাশ করে ফেলেছেন মহেন্দ্রলাল। এবারে রাজেন্দ্রলাল দত্তের সাহয্যে শুরু করলেন হোমিওপ্যাথি ওষুধ তৈরি। যা বিশ্বাস করেন, যাকে সত্য বলে মনে করেন, তা লুকিয়ে রাখতে জানতেন না মহেন্দ্রলাল। তাই, মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের চতুর্থ বার্ষিক সভাতেও প্রকাশ্যে হোমিওপ্যাথির সমর্থনে বক্তব্য রাখলেন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট তাঁর এই পরিবর্তন ভালো চোখে মেনে নিল না। মহেন্দ্রলালও ইস্তফা দিলেন পদ থেকে। ততদিনে, হানিম্যানের তত্ত্বে তিনি খুঁজে পেয়েছেন হিপোক্রিটাসের চিকিৎসানীতির সার। হানিম্যানের তত্ত্বের নানা ভুল তিনি ধরতে পারছেন, কিন্তু সেই চিকিৎসা-পদ্ধতির সত্য তাঁকে আকর্ষণ করছে। সেই আকর্ষণকেই আমৃত্যু জড়িয়ে ছিলেন একরোখা মানুষটি।
আরও পড়ুন
ভগবান বুদ্ধ
এমন মানুষ যে রামকৃষ্ণদেবকেও রেয়াৎ করবেন না, তাই স্বাভাবিক। রামকৃষ্ণদেব সম্পর্কে ভক্তদের নাকি বলতেন, ‘হি ইজ আ গুড ম্যান। তোমরা ওকে অবতার বলে খারাপ করে দিচ্ছ।’ আর এই পছন্দের মূলেও ছিল মহেন্দ্রলালের সেই সত্যের প্রতি চির আকর্ষণই। রামকৃষ্ণকে নাকি তিনি বলতেন, ‘তোমার সত্যানুরাগের জন্যই তোমায় এত ভাল লাগে।’ কিন্তু, ভক্তির আবেশ কখনো ঘিরে ধরেনি তাঁর চিকিৎসার বোধকে। একটা মজা গল্প মনে পড়ে এই বিষয়ে। একদিন ভাবাবেশে থাকা অবস্থায় রামকৃষ্ণদেব মহেন্দ্রলালকে জিজ্ঞেস করলেন—কেন এইসব হয়? উত্তরে ডাক্তার সরকার বললেন—নার্ভাস সেন্টারের অ্যাকশন বন্ধ হয়, তাই অসাড়—এদিকে পা টলে, যত এনার্জি, ব্রেনের দিকে যায়। এই নার্ভাস সিস্টেম নিয়েই লাইফ। ঘাড়ের কাছে আছে মেডুলা অবলংগাটা; তার হানি হলে লাইফ এক্সটিঙ্কট হতে পারে। এহেন ব্যাখ্যা শুনে সবাই তাজ্জব। মহেন্দ্রলাল এমনই। নাহলে কেউ বলতে পারে— ‘সাঁওতালদের হিস্ট্রি পড়ে জানা গিয়েছে যে, কালী একজন সাঁওতাল মাগী ছিল। খুব লড়াই করেছিল।’ রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে তীব্র মতবিরোধের পরেও তৈরি হয়েছিল এক গভীর সখ্য। রামকৃষ্ণ পরে ডাক্তারকে ভেঙিয়ে নাকি বলতেন— ‘আগে কেমন তিড়িংবিড়িং করত। এখন ডাক্তার ডাইলিউট হয়ে গিয়েছে।’
নিজের বিশ্বাস, যুক্তিবোধকে কিন্তু কখনোই ডাইলিউট হতে দেননি মহেন্দ্রলাল। মতাদর্শগত কারণে স্বেচ্ছায় ছেড়ে এসেছেন পদাধিকার, অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসক হিসেবে রমরমা খ্যাতি। আবার হোমিওপ্যাথি চর্চার সময়েও তিনি একেবারে নাকচ করেননি তাঁর পূর্বজীবনের চিকিৎসার জ্ঞান। ভুল-ঠিক যাই হোক নিজের বিচারে সত্যদর্শনকে আজীবন আঁকড়ে থেকেছেন মানুষটি। সবই ভালো, শুধু তাঁর মেজাজ বদলায়নি কোনোদিন। অবশ্য, মেজাজটাই যে আসল রাজা— তা ভালোই বুঝতেন মহেন্দ্রলাল।
সূত্রঃ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত (অখণ্ড), ঠোঁটকাটা ভগবান, দেবদত্ত গুপ্ত