No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ১৪ বছর পরে সন্ন্যাসীর বেশে ফিরে বর্ধমানের জমিদারি দাবি করলেন ‘জাল’ প্রতাপচাঁদ

    ১৪ বছর পরে সন্ন্যাসীর বেশে ফিরে বর্ধমানের জমিদারি দাবি করলেন ‘জাল’ প্রতাপচাঁদ

    Story image

    বাংলার প্রখ্যাত জমিদার পরিবারগুলির মধ্যে বৈভব এবং মর্যাদার নিরিখে বর্ধমানের রাজপরিবারের স্থান ওপরের দিকেই। এই পরিবারেরই সদস্য ছিলেন মহারাজা তেজচাঁদ বাহাদুর। একদিকে তিনি যেমন উচ্ছৃংখল এবং বিলাসী, অন্যদিকে প্রজাপালক হিসেবেও সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর রানির সংখ্যা আট জন। তাঁদেরই একজন নানকীদেবী, যাঁর গর্ভে ১৭৯১ সালে জন্ম নেন প্রতাপচাঁদ। আরেক রানি কমলকুমারী এবং তাঁর বড়োভাই পরাণচাঁদ কাপুরের প্রবল লোভ ছিল জমিদারি সম্পত্তির ওপর। ইতিমধ্যে নানকীদেবী গত হয়েছেন। মহারাজার একমাত্র উত্তরাধিকারী প্রতাপচাঁদ অল্পবয়স থেকেই জমিদারির দেখাশোনা শুরু করেন। কমলকুমারী আর পরাণবাবুর সঙ্গে তাঁর বিরোধও জমে উঠতে থাকে। 

    আঠাশ বছর বয়সে প্রতাপচাঁদের এক গুরুতর অসুখ হয়। তাঁকে অম্বিকা কালনা নিয়ে যান বৃদ্ধ জমিদার তেজচাঁদ। প্রতাপচাঁদের দুই স্ত্রী ছিলেন, তাঁরা কেউ সেখানে যাননি। এদিকে অসুখ বাড়তে থাকে। কালনাতেই নাকি প্রয়াত হন প্রতাপচাঁদ। এরপর প্রতাপের দুই স্ত্রী তেজচাঁদের থেকে বিষয়-সম্পত্তি চেয়ে বসলেন। মামলা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য দু’জনে মাসহারা নিয়েই সন্তুষ্ঠ থাকেন। 

    অনেকেই বিশ্বাস করত, প্রতাপচাঁদ মরেননি। লোকে বলতে লাগল, কোনো এক পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে ১৪ বছরের জন্য অজ্ঞাতবাসে গিয়েছেন তিনি। সময় হলেই আবার ফিরে আসবেন। এদিকে, তেজচাঁদের উত্তরাধিকারী দরকার, তার জন্য সাত নম্বর বিয়েটা করলেন তিনি, উজ্জ্বলকুমারীর সঙ্গে। কিন্তু, সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেলেন এই রানি। উত্তরাধিকারী আর পাওয়া হল না। তার সুযোগ নিলেন পরাণচাঁদ। নিজের ছেলে দত্তক দিলেন তেজচাঁদকে। আরেকটা চালও চাললেন পরাণবাবু। বৃদ্ধ জমিদার তেজচাঁদের সঙ্গে নিজের মেয়ে বসন্তকুমারীর বিয়ে দিলেন। কমলকুমারী আর বসন্তকুমারী এতদিন ছিলেন পিসি আর ভাইঝি, এখন দু’জনে সতিন হয়ে উঠলেন। দু’জনেই সম্পত্তি পাওয়ার জন্য আকুল। এসবের মধ্যেই একদিন তেজচাঁদ মারা গেলেন। সম্পত্তি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা চলতেই থাকে।

    এই সব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে প্রতাপচাঁদের মৃত্যুর পর ১৪ বছর কেটে গেল। ১৮৩৫ সালে গোলাপবাগে হাজির হলেন এক সন্ন্যাসী। দাবি করলেন, তিনিই প্রতাপচাঁদ। ১৪ বছর আগে মৃত্যু হয়নি তাঁর। এদিকে পরাণচাঁদের ছেলেকে তেজচাঁদ তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গিয়েছেন। পরাণবাবু আর ঝুঁকি নিতে রাজি নন। সন্ন্যাসীকে তাড়াতে লেঠেল পাঠালেন। বর্ধমান শহর থেকে বেরিয়ে এক জায়গায় আশ্রয় নিলেন সন্ন্যাসী। জায়গাটার নাম হয়ে যায় ‘বাজেপ্রতাপপুর’। 

    সন্ন্যাসীও কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। তিনি বিষ্ণুপুরের রাজার কাছে গিয়ে সাহায্য চাইলেন। তারপর গেলেন বাঁকুড়ার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। রটে গেল, প্রতাপচাঁদ ফিরে এসেছেন। দলে দলে লোক গিয়ে সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা করতে থাকে। এদিকে, রাজ্যের শান্তিভঙ্গের অপরাধে তাঁকে গ্রেপ্তার করল কোম্পানির পুলিশ। কয়েকমাস হাজতবাসের পর তিনি কলকাতায় এসে রাধাকৃষ্ণ বসাকের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। জনগণের মধ্যে তাঁর সমর্থন বাড়ছে। এমনকি ভিখারিরাও “প্রতাপচাঁদের জয় হোক” বলে ভিক্ষা চাইত। অল্পবয়সী ছেলেরা গাইত, “পরাণবাবু হয়ে কাবু, হাবুডুবু খেতেছে”। 

    সন্ন্যাসী জলপথে বর্ধমান যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু রাস্তায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হল। ১৮৩৮ সালে হুগলির ম্যাজিস্ট্রেট স্যামুয়েল সাহেবের অধীনে শুরু হল তাঁর বিচার। আদালত চত্বর লোকে লোকারণ্য। প্রজারা চায়, সন্ন্যাসী গিয়ে বর্ধমানের জমিদারের পদে বসুন। একের পর এক সাক্ষী এলেন। তাঁদের মধ্যে গণ্যমান্যের সংখ্যা কম নয়। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরও এলেন সাক্ষী দিতে। তিনি যে ‘কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’-র একজন কর্মকর্তা ছিলেন, সেই সংস্থা ছিল রানি বসন্তকুমারীর আইনি উপদেষ্টা। দ্বারকানাথ জানালেন, এই সন্ন্যাসী কোনোভাবেই প্রতাপচাঁদ হতে পারেন না। এভাবে তীব্র বাদানুবাদে মামলা এগোতে লাগল। সারা বাংলায় হইচই ফেলে দিয়েছিল এই মামলা। শেষে আদালত ঘোষণা করল, এই ব্যক্তি প্রতাপচাঁদ নন। এক হাজার টাকার জরিমানা হল সন্ন্যাসীর। বঙ্কিমচন্দ্রের দাদা সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই ঘটনা নিয়ে লিখে ফেলেছিলেন ‘জাল প্রতাপচাঁদ’ নামের বই। 

    বাকি জীবনটা শ্রীরামপুরে কাটিয়ে দিয়েছিলেন এই সন্ন্যাসী। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নানা বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল। প্রচুর লোক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। সাধারণ লোকেরা অনেকেই মনে করতেন, তিনিই আসল প্রতাপচাঁদ। 

    তথ্যঋণ – অমৃতময় মুখোপাধ্যায়, গৌতম বসুমল্লিক।
    ছবিসূত্র – উইলিয়াম হেনরি হাচিসনের আঁকা রাজা প্রতাপচাঁদের প্রতিকৃতি
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @