‘কুলাঙ্গার’ ছিলেন না রাহুল দেব বর্মণ

'আমি এই গান তরে শিখাইছি? মাঠের গান ভুলে, বাংলার গান ভুলে, তুই ইংরিজি গানের নকল কইরা সুর করস! আমার সব শিক্ষা বৃথা গেল। তুই আমার কুলাঙ্গার ছেলে।' – চিৎকার করে উঠেছেন বৃদ্ধ। রাগে কাঁপছেন তিনি। মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাওয়ার আগে, একবার তাকালেন ছেলের দিকে। বৃদ্ধ ভাবছেন – তাঁর এতদিনের শিক্ষা-দীক্ষা, গান বাঁধার শৈলী – যা দিয়ে তিলে-তিলে বড় করে তুলেছিলেন ছেলেকেও, তা বুঝি আজ ভেঙে পড়তে বসল। সেই কবে দু’হাতে সুর তুলে এনেছিলেন বাংলার হৃদয় থেকে, বেঁধেছিলেন ‘আমি টাকডুম টাকডুম বাজাই’, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’, ‘মন দিল না বঁধু’-র মতো গান, যা বাঙালির মুখে-মুখে ফেরে এখনও, তাঁরই ছেলে কিনা এমন গান বেঁধেছে! যুগ কি তাহলে বদলে গেল! ‘তুমি আর নেই সে তুমি’-র সুর কি সত্যিই আজকের দিনে ব্যর্থ? ছেলের এই নতুন সুর – এই বিদেশ থেকে আহরণ করার প্রবণতা – ভারতের সঙ্গীত-ভবিষ্যৎ কি তাহলে এভাবেই নিজস্বতা হারাবে?
শচীন দেব বর্মণ। ত্রিপুরার রাজপরিবারের রক্ত বইছে তাঁর শরীরে। সুরের উত্তরাধিকারও। তাঁর ছেলে, রাহুল দেব বর্মণের নতুন সুর শুনতে সেদিন গেছিলেন স্টুডিওতে। সাতের দশকের শুরুর দিক। শচীন দেখলেন, আশা ভোঁসলে-কে রাহুল তোলাচ্ছেন ‘দম মারো দম’ গানটি। সেই গান শুনেই শচীনের এমন প্রতিক্রিয়া।
সত্যিই কি রাহুল ‘কুলাঙ্গার’ ছিলেন? তাঁর সুরে শুধুই বিলিতি প্রভাব, দেশি ঘরানার স্বাদ বুঝি একেবারেই নেই? হিন্দি বাদ দিয়ে, যদি বাংলার দিকেই মন দিই? পুজোর অ্যালবামে তাঁর অনেক গানই সে-সময় প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এখনও সেই গানগুলি শুনতে পাওয়া যায় এদিক-ওদিক কান পাতলেই। কিন্তু বাংলা গানের শ্রোতা হিসেবে, আমি কি রাহুল দেব বর্মণকে ‘ওগো নিরুপমা’, ‘মনে পড়ে রুবি রায়’, ‘কিনে দে রেশমি চুড়ি’ – ইত্যাদি গানগুলোর জন্য মনে রাখব? একাধারে দুর্বল লিরিক ও চটুল সুর একশ্রেণীর শ্রোতার মধ্যে আলোড়ন তুলতে পারে, কিন্তু আমার মন যখন সমাহিত হয়ে শুধু সঙ্গীতে সমর্পণ করতে চায়, রাহুল দেব বর্মণের ওই গানগুলোর দিকে ভুলেও পা বাড়াব না।
আরও পড়ুন
যদুভট্ট ও তাঁর গান
চোখ বুজলে আমার বরং মনে পড়ে একটা রেডিও সেটের কথা, প্রিল্যুডের পর যা থেকে বেরিয়ে আসছে বিষাদকণ্ঠ – ‘এ কী হল, কেন হল, কবে হল, জানি না / শুরু হল, শেষ হল, কী যে হল – জানি না তো।’ আর, এই বিষণ্ণতা শুষে নিচ্ছেন সামনে দাঁড়ানো এক তন্বী। সিনেমার নাম ‘রাজকুমারী’। কণ্ঠে কিশোরকুমার, কথা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের। আর চিত্রায়ণে, রেডিও-র ওপাশে লিপ দিচ্ছেন স্বয়ং উত্তমকুমার! রেডিও-র সামনে দাঁড়িয়ে অন্ধ তনুজার যে অভিব্যক্তি – যেন গানের প্রত্যেকটা কথা ও সুর প্রবল একাকিত্ব ও মানসিক যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে দিচ্ছে তাঁকে – রাহুল দেব বর্মণকে আমি এই সুরের জন্যেই চিনি।
আর এই বাংলার সূত্র ধরেই মনে পড়ে যায় হিন্দি ‘অমর প্রেম’ সিনেমায় রাজেশ খান্নার লিপে ‘ইয়ে ক্যায়া হুয়া’ গানটি। রাহুলেরই সুর, কণ্ঠে সেই কিশোরকুমার। আবার, ‘অমর প্রেম’ যে বাংলা সিনেমার হিন্দি রূপ, সেটিও উত্তমকুমারের অভিনীত। ‘নিশিপদ্ম’। বাংলার সাবিত্রী হিন্দিতে শর্মিলা। তবে মূল রচনাকার আবার সেই বাংলারই। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাহুল দেব বর্মণ তাই আমার মতো বাংলা আঁকড়ে পড়ে-থাকা শ্রোতার কাছে উত্তম-কিশোর-তনুজা ও সাদাকালো সিনেমার আবহ হয়ে ধরা দেন। যেন ছোটবেলা, যেন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা অথচ বেরোতে না-পারার আক্ষেপ। এই রাহুল ‘কুলাঙ্গার’ নন। তিনি শচীনকত্তার ছেলে। আমার কৈশোরপাঠে নইলে মস্ত ফাঁকি থেকে যাবে যে!