রাসবিহারীর জনক রোডে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রাধুবাবুর চায়ের দোকান

“আমার ভালোলাগে জনক রোডের রাধুবাবুর চা” – গাইছেন বাপ্পি লাহিড়ী এবং লিখছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। প্রায় অশ্রুত এই গান ইউটিউবে সার্চ করলে আজও শোনা যাবে। বাপ্পি লাহিড়ী রাধুবাবুর চা খেয়ে এতই মোহিত হন, যে ১৯৮৯ সালে নিজেই সুর দিয়ে এবং গেয়ে রাধুবাবুকে ট্রিবিউট জানান। আমাদের আজকের ডেস্টিনেশন রাধুবাবুর চায়ের ঠেক।
দক্ষিণের ব্যস্ত কলকাতা। যেখানে ধোঁয়া ওঠা বাস-ট্যাক্সি কথা বলতে বলতে হুশ করে চলে গেল। পড়ন্ত বিকেলে ধেয়ে এল একফালি শীর্ণ ট্রাম – তার ঢং ঢং। ওদিকে মধুসূদন মঞ্চের সামনে একদল তরুণ-তরুণী নতুন নাটকের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সন্ধের রাসবিহারী আবার খোশ মেজাজে। এই গল্প কলকাতা দক্ষিণের। একেবারে পুরোনো দক্ষিণ। অর্থাৎ রাসবিহারী-কালীঘাট। এখনও দেওয়ালের পলেস্তরা খসে পড়ে দীর্ঘদিনের আভিজাত্যের বাড়িতে। রাসবিহারীর ৮-এ, জনক রোড, কলকাতা ২৯-এ আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই শহরের খুব প্রিয় রাধুবাবু।
উত্তর হোক বা মধ্য কিংবা দক্ষিণ, রাধুবাবুকে চেনেন না, এমন লোক খুঁজে বের করা দুষ্কর। কে এই রাধুবাবু? রাধাকিশোর দত্ত। বাবার দেওয়া নাম। শুধু চায়ের দোকানের প্রতিষ্ঠাতা নন, তিনি একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীও। মা মারা যাওয়ার পর ভাই-বোনদের দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর কাঁধেই। কিন্তু শুধুমাত্র সংসার নয়, তাঁর তো আরও অনেক দায়িত্ব আছে। দেশ স্বাধীন করতে হবে। স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করতে হবে তারিয়ে তারিয়ে। সেদিনের রাধাকিশোর এসে পড়লেন কলকাতায়। ধীরে ধীরে থিতু হলেন। তারপরেই তো ইতিহাস। জনক রোডের বিখ্যাত রাধুবাবুর চায়ের দোকান-এ আজও আসর বসে দেখার মতো।
দোকানের বর্তমান দেখভালকারী সোমনাথবাবু আমাদের বলে চলেন আরও কত-শত গল্প। বলেন রাধুবাবুর স্বপ্ন দেখার কাহিনি, শিকড় জাপটে থাকার লড়াই, সংসার বাঁচানোর অদম্য জেদ। “অভিনেতা রাজ কপুর এসেছেন কলকাতায়। গ্র্যান্ড হোটেলে থাকবেন। কিন্তু খাবার কী খাবেন? হোটেলের কর্মীরা কিছু বুঝতে না পেরে রাধুবাবুর দোকান থেকেই খাবার কেনা হয়েছিল।” বলে চলেন সোমনাথবাবু।
উত্তর হোক বা মধ্য কিংবা দক্ষিণ, রাধুবাবুকে চেনেন না, এমন লোক খুঁজে বের করা দুষ্কর। কে এই রাধুবাবু? রাধাকিশোর দত্ত। বাবার দেওয়া নাম। শুধু চায়ের দোকানের প্রতিষ্ঠাতা নন, তিনি একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীও। মা মারা যাওয়ার পর ভাই-বোনদের দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর কাঁধেই।
সে-সময়কার কলকাতায় ব্যস্ততা ছিল কম। মানুষ, মানুষকে দেখার সময় পেত। দমবন্ধকর পরিস্থিতি ছিল না। ধোঁয়া ওঠা ট্রেনে ভিজে যেত কলকাতার আনাচ-কানাচ। আর রাধুবাবুর মতো একঝাঁক স্বাধীনতা সংগ্রামীরা তখন দেশ স্বাধীনের স্বপ্নে বিভোর। কানাঘুষো শোনা যায়, সে যুগের সুপারহিট নায়ক-নায়িকাদের গাড়ি এসে ভিড় করত রাধুবাবুতে। আর মাঝেমধ্যেই আসত একটা চেনা গাড়ি। কিন্তু জানালার কাচ নামত না। গাড়ির ভিতরে কে? রাধুবাবুর কি জানতে ইচ্ছা করত? সোমনাথবাবু জানালেন, একবার রাধুবাবু গাড়ির কাছে যান চা দিতে। এক ঝলকে দেখে ফেলেন গাড়িতে বসে আছেন কালো সানগ্লাস পরা সুশ্রী এক মহিলা। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং সুচিত্রা সেন। সে এক আশ্চর্যের বিষয় বৈকি! কিন্তু ম্যাডাম সুচিত্রা রয়েছেন, অথচ পাশে উত্তম নেই! রাধুবাবুর কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। অন্যদিকে আলো সরকার পরিচালিত এবং উত্তমকুমার প্রযোজিত ও অভিনীত ‘ছোটি সি মুলাকাত’-এর শুটিং-এ খাবার পৌঁছাত রাধুবাবুর থেকেই।
শুধু কি তাই? কাটলেট, কোর্মা, স্টু খেতে আসতেন চলচ্চিত্র ও সংগীত জগতের সব দিকপালরা। রাধুবাবুর চায়ের দোকানের অদূরে এক রকে বসে আড্ডা মারতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, বসন্ত চৌধুরী, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, সুখেন দাস, সলিল চৌধুরীরা। এখনও প্রায় আসেন জয় সরকার, লোপামুদ্রা মিত্র, শ্রীজাত, সোহিনী সরকার। আসেন টালিগঞ্জের প্রযোজকরাও।
অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি রাধুবাবু আজও যে কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, তা হল চায়ের স্বাদ। কিন্তু চা-পাতা আসলে আসে কোথা থেকে, সে বিষয়ে প্রশ্ন কড়া হলে কুলুপ আঁটেন কর্তৃপক্ষ। বলেন, “এখানেই রহস্য”। উত্তর কেউ-ই জানেন না। তবুও খাঁটি চা-পাতা আজও অমলিন হয়ে আছে এই দোকানে। নতুন থেকে পুরোনো আজও কত কত মুখ আসেন, গল্প করেন। প্রতি সন্ধ্যায় মুখরিত হয়ে ওঠে আশপাশ। প্রবীণরা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হয়তো ভাবেন হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর কথা। চায়ের বাষ্প চশমার কাচ আবছা করে দেয়। মনে পড়ে যায় বন্ধুদের দল, আর হাত নেড়ে দূর থেকে বলে ওঠা, “এই তো রে, এই দিকে আছি।”
রাধুবাবুরা শহরের অলি-গলিতে আজও অক্ষয় হয়ে থেকে যান। কারণ কলকাতা জানে বেঁচে থাকার মানে।
______________
ছবি: সুমন সাধু