No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বিশ্বকে নতুন নক্ষত্র চিনিয়েছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ, তাঁকে চিনতে পেরেছিল কি দেশ?

    বিশ্বকে নতুন নক্ষত্র চিনিয়েছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ, তাঁকে চিনতে পেরেছিল কি দেশ?

    Story image

    বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেই। চাকরিবাকরির উচ্চাশা নেই। শুধু আকাশের দিকে দূরবীন তাক করে ঠায় বসে থাকেন রাধাগোবিন্দ চন্দ্র। গ্রহ-নক্ষত্রদের সঙ্গেই তো সংসার পেতেছেন তিনি। ধূমকেতুর ঝাঁটায় চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন ছায়াপথ ধরে। তারাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে লিখেছেন বিভিন্ন পত্রিকায়। এমনতরো মানুষ তো আমজনতার চোখে খ্যাপাটে। গতানুগতিকতার বেড়াজালে বাঁধা যারা পড়ে না, তারাই ‘পাগল’। কিন্তু, এমনই এক পাগল যে বাংলায় জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার দুনিয়াটাকেই বদলে দেবে, তা কে ভেবেছিল! 

    জন্ম যশোরের বাগচর গ্রামে। ছোট্ট ছেলেটা দিদার কোলে শুয়ে আকাশ দেখে। ওই দূরে টিমটিমে তারাটাকে চাই সই পাতাতে। মন লাগে না লেখাপড়ায়। পাঠ্যবই উল্টোতে উল্টোতে হঠাৎ চোখে পড়েছিল অক্ষয় দত্তের প্রবন্ধ ‘ব্রহ্মান্ড কী প্রকান্ড !’ ব্যাস আর যায় কোথায়! নক্ষত্র চেনার নেশা পেয়ে বসল কিশোর রাধাগোবিন্দকে। একটি পাণ্ডুলিপিতে তিনি নিজেই লিখছেন, “অক্ষয়কুমার দত্তের চারুপাঠ তৃতীয় ভাগ পড়িয়া, নক্ষত্রবিদ হইবার জন্যে আর কাহারো বাসনা ফলবর্তী হইয়াছিল কিনা জানি না, আমার হইয়াছিল। সেই উদ্দাম ও উচ্ছৃঙ্খল বাসনার গতিরোধ করিতে আমি চেষ্টা করি নাই।”

    কিন্তু সব ভুলে মহাকাশে বুঁদ হয়ে যাওয়ার ফলে লাটে উঠল লেখাপড়া। জাগতিক হিসেব নিকেশ কি আর এমন মানুষের সয়? ফলে যশোর জেলা স্কুল থেকে তিনবার এন্ট্রান্স-এ ঘায়েল রাধাগোবিন্দ। শেষে পনেরো টাকা বেতনের খাজাঞ্চির চাকরিতেই থিতু হলেন তিনি।

    যশোরের আইনজীবী কালিনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তাঁর লেখা, সংস্কৃত ভাষায় ‘খগোলচিত্রম’, বাংলায় ‘তারা’ আর ইংরাজিতে ‘পপুলার হিন্দু এস্ট্রোনমি’-ই তখন ছিল ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার প্রামাণ্য গ্রন্থ। কালিনাথের নজরে পড়ে গিয়েছিলেন যুবক রাধাগোবিন্দ। ছোকরার উৎসাহে খুশি হয়ে তাকে নিজস্ব নক্ষত্র মানচিত্রটাই দিয়ে বসলেন তিনি। সেই স্টার-ম্যাপ কাজে লাগিয়ে রাধাগোবিন্দ কখনো খালিচোখে বা কখনো কম দামি বাইনোকুলারের সাহায্যে নজর রাখতে শুরু করেন তারাদের গতিবিধি। দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখে পড়ে গিয়েছিল হ্যালির ধূমকেতু। তা নিয়ে লিখলেন ‘হিন্দু’ পত্রিকায়। এর কিছুদিন পরেই চিঠি এল শান্তিনিকেতনের জগদানন্দ রায়ের। তিনি রাধাগোবিন্দকে একটি উন্নত টেলিস্কোপ কেনবার পরার্মশ জানালেন। সঙ্গে অবিমিশ্র প্রশংসা।

    সামান্য জমিজমা বেচে তারাপাগল হাতে পেলেন একটি তিন ইঞ্চি ব্যাসার্ধের টেলিস্কোপ। কিন্তু তাঁর লক্ষ্যবস্তু এখন থেকে হল বহুরূপ তারা বা ভেরিয়েবেল স্টার। ভেরিয়েবল স্টারদের ঔজ্জ্বল্য সর্বদা পরিবর্তনশীল। এই টিমটিমে তো এই জ্বলজ্বলে। 

    একদিন যেন আকাশটা অন্যদিনের থেকে বেশি উজ্জ্বল। একটু ঠাহর করে দেখতে গিয়ে তিনি বুঝলেন, এর উৎস একটি সম্পূর্ণ নতুন তারা। যার নাম পরে দেওয়া হয় নোভা একুইলা-৩। ইউরেকা! কিন্তু দেশীয় পত্রিকায় এ নিয়ে লিখে তেমন চিঁড়ে ভিজবে না। আবার এগিয়ে এলেন জগদানন্দ। তাঁরই উপদেশে রাধাগোবিন্দের প্রবন্ধ পৌঁছল আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ পর্যবেক্ষণ দপ্তরে। খানিক দেরিতেই উত্তর আসে। এই বাঙালি জ্যোতির্বিদের কাণ্ড দেখে মার্কিনিরা থ ! রাধাগোবিন্দ রাতারাতি হয়ে পড়লেন আমেরিকান এসোসিয়েশন অব ভ্যারিয়েবল স্টার অবজার্ভার (এভসো)-র সদস্য। ‘এভসো’ থেকেই তাঁকে দেওয়া হল আরো উন্নত টেলিস্কোপ। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, এরপর ফরাসি এবং ব্রিটিশ এস্ট্রোনমিকাল সোসাইটিরও মেম্বার করা হয় তাঁকে। 

    ১৯২০ থেকে ১৯৫৪ সালের ভেতর প্রায় ৩৮ হাজার ভ্যারিয়েবল স্টার পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তিনি। সেসব তথ্য ছাপা হয়েছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের নানা জার্নালে। দেশেও ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছিল নাম...

    দেশভাগের পর ঘটিবাটি নিয়ে সীমান্ত পেরোতে গিয়ে বাজেয়াপ্ত হয়ে যায় টেলিস্কোপ। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তা ফেরত এসেছিল। কিন্তু ততদিনে এহেন জ্যোতির্বিদকে সবাই ভুলতে বসেছে। বারাসাতের দুর্গাপল্লীতে তাই বিনা চিকিৎসায় অনাহারে মারা গেছিলেন ৯৭ বছরের রাধাগোবিন্দ। অবদানের কী অসামান্য স্বীকৃতিই না তাঁকে দিয়েছিল দেশ! অবশ্য দেশ কী, কোনটা দেশ—সেটাই তো ধোঁয়াশা তৈরি করেছিল তাঁর কাছে... নাহলে জন্মভিটে ছেড়ে এপারে চলে আসতে হয়! 

    যারা দেশ থেকেও থাকে না, তাঁর জন্য কি পড়ে থাকে অপার মহাকাশ? তারায় তারায় হয়তো নিজের অস্তিত্ব খুঁজে যাচ্ছেন রাধাগোবিন্দ। কোনো এক অচেনা তারার ফাঁক থেকে তাঁর দূরবীন হয়তো এখনো উঁকি মারছে পৃথিবীর মাটিতে...

    ঋণ : রোর বাংলা, সমকাল ডট কম।
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @