কলকাতার পাখিস্থান

শুধু কলকাতাই নয়, ভিন্নরাজ্যের লোকেদের কাছেও দক্ষিণ কলকাতার রবীন্দ্র সরোবর একটি পরিচিত জায়গা। ঢাকুরিয়ার প্রান্ত থেকে টালিগঞ্জ মেট্রো রেল পর্যন্ত বিস্তৃত এই লেক। বড় বড় গাছের সারি আর ফুলের বাগান ঘেরা। এখানে প্রাতঃভ্রমণকারীদের পাশাপাশি পক্ষীপ্রেমিকরাও আসেন প্রতিদিন। সরোবরের চারদিকে পুরনো গাছগুলির বয়স কত হবে তা বলা মুশকিল। তবে ছোটবেলার এখানে আরও গাছ দেখতাম। বিগত কয়েক বছরে হওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাগানের ঘনত্ব কমেছে। তাছাড়া উন্নয়নের আধুনিকীকরণের তাগিদেও উপড়ে ফেলা হয়েছে অনেক গাছগাছালি।
Black-headed Cuckooshrike
Blue-throated barbet
আমার সঙ্গে রবীন্দ্র সরোবরের সম্পর্ক প্রায় দশ বছরের। সেই সময় আমাদের সরোবরে প্রবেশের পথ ছিল লেক গার্ডেন স্টেশনের দিক থেকে। তখন এখানে ছিল ‘লিলিপুল’ নামে ছোটদের পার্ক। ঘন গাছ-গাছালিতে ভরা বাগানে দেখা মিলত বাংলার নিজস্ব পাখি ছাড়াও অনেক পরিযায়ী পাখিদের। এখন অবশ্য গাছের ঘনত্ব যেমন কমেছে, পাখিদের আনাগোনাও আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। সেইসময় গাছের ডালে প্রায়ই দেখা যেত রোজ-রিংড প্যারাকিট, ইয়োলো ফুটেট গ্রিন পিজিয়ন, লিনিয়েটেড বারবেট, চেস্টনাট টেইলড স্টারলিং, সার্ন বার্ড ও স্পটেড অউলেট পাখিদের। তবে পাখিপ্রেমিক হিসাবে একটা কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বাংলার এই সরোবরের সঙ্গে পাখিদের যেন এক আত্মিক যোগ রয়েছে। তাই এখনও দূর হিমালয়ের ফুটহিল থেকে শীতের মরসুমে উড়ে আসে পাখি।
Blue-throated Blue - Female
Brown-breasted Waber
রবীন্দ্র সরোবর শুধুই পাখির ছবি তোলা নয়, পরিচয় করিয়েছে পাখিদের জীবনযাত্রার সঙ্গেও। এখানে প্রথম আমি জানলাম কিংফিশার সম্পর্কে অদ্ভুত কথা। এর বাসা বাঁধে মাটিতে। একদিন দেখি লেকের জলস্তর যেখানে শেষ হয়েছে তার ঠিক উপরেই ছোট গর্ত থেকে মুখ বের করে বসে আছে একটা কিংফিশার। সামনে গিয়ে দেখি এইরকম অনেক গর্ত যেখানে কিংফিশারের বাস। ওরা এইভাবেই জলের দিকে নজর রাখে। সরোবরে গেলেই দেখা মেলে করমোরেন্টদের দলকে। তারা সর্বদা মাছ ধরতে ব্যস্ত। সরোবরের মাঝখানের রয়েছে ছোট দুটি দ্বীপ। সেখানে অনেকবারই দেখেছি ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েক শত লিটল করমোরেন্ট, সঙ্গে এশিয়ান ওপেনবিল অথবা শামুকখোল, ও কিছু ব্লাকক্রাউনড নাইট হিরন। এই বছরের জানুয়ারিতেই দেখা পেলাম পেইন্টেড স্টর্ক-এর। এরা এখানে আসে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে। দেখি দ্বীপে একটা গাছের উপর বাসা বাঁধার জন্য সরঞ্জাম সংগ্রহে ব্যস্ত।
Coppersmith barbet
Indian paradise flycatcher
Indian paradise flycatcher
বর্তমানে পার্কের আধুনিকীকরণ ও সৌন্দর্যায়নের জন্য লেকের পাড় ধরে বসানো হয়েছে কংক্রিটের চেয়ার। তৈরি করা হয়েছে কংক্রিটের রাস্তা। এর ফলে মানুষের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাখিদের সংখ্যা কিন্তু অনেক কমেছে। লেকের উলটো দিকে আছে ‘লায়নস সাফারি পার্ক’। বড় বড় গাছে ঢাকা বাগান পাখিদের বর্তমান আশ্রয়স্থল। এখানেই দেখা মেলে নানাধরনের পাখির। পক্ষীপ্রেমিকদের পাখির ছবি তোলার নেশা প্রাতভ্রঃমণে আসা মানুষজনের মধ্যে কৌতূহল বাড়িয়েছে। অনেকে আবার নিজে থেকেই পাখিদের সংরক্ষণ ও তাদের যাতে কোনো অসুবিধা না হয় এর জন্য এখানে আগত মানুষদের সাবধান করেন।
আরও পড়ুন
পাখির খোঁজে মংলাজোড়ি
Indian paradise flycatcher
Indian roofed turtle
Orange-headed thrush
২০১৬ সালে এপ্রিল মাসে এক অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলাম। এদিন সকালে এখানে দেখা পেলাম ইন্ডিয়ান প্যারাডাইজ ফ্লাইক্যাচার-এর। অনেক জায়গায় ঘুরেও দেখা পায়নি যার সে-কিনা এই শহরের মধ্যে কলকাতায়, অবিশ্বাস্য লাগছিল। বেলা তখন তিনটের কাছাকাছি। সাফারি পার্কের গেটে থাকা পরিচিত রক্ষী জানাল, বাগানে একটা লম্বা লেজওয়ালা পাখি ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করতেই দেখা পেলাম। আমার মাথার উপরেই ডিগবাজি খাচ্ছে ইন্ডিয়ান প্যারাডাইজ ফ্লাইক্যাচার। তার লম্বা লেজটি সত্যিই দেখার মত। আমি হকচকিয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। মাথায় কালো রঙের ঝুঁটি। এক নিঃশ্বাসে ছবি তুলতে লাগালাম। কিছুক্ষণ পর আরেকজন পক্ষীপ্রেমিক বন্ধু এল। আমরা এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছিলাম যে বুঝতেই পারিনি কখন সূর্য আস্তে আস্তে ডুবতে শুরু করেছে।
Painted stork
Painted stork
Rose-ringed parakeet
পরেরদিন খুব সকালে একবন্ধু ফোনে জানাল, সাদা রঙের ইন্ডিয়ান প্যারাডাইজ ফ্লাইক্যাচার সাফারি পার্কে ঘুরছে। প্রথমে আমার খুব অবাক লাগছিল। কারণ মাসটা ছিল এপ্রিল। কোনোরকমে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর দেখলাম একটা গাছের ডালে সাদা কাপড়ের মত কিছু দুলছে। এটা একটা প্রাপ্তবয়স্ক ইন্ডিয়ান প্যারাডাইজ ফ্লাইক্যাচার(হোয়াইট প্লুমেজ)। দুটি রঙের ইন্ডিয়ান প্যারাডাইজ ফ্লাইক্যাচারের কলকাতায় দেখা পাব তা ভাবিনি।
Rufous treepie
Rufous woodpecker
অনেকদিন পরে সরোবরে গেছি। সকাল ১০.২৫। তখন প্রাতভ্রমণকারীদের দেখা না মিললেও পাখিদের দেখা যায়। ছোট জলাশয়ের ধারেই দেখা পেলাম ভারডিটার ফ্লাইক্যাচার, ব্লু-থ্রোটেড বারবেট, ব্ল্যাক-হেডেড কুক্কুসিক। দুটো স্পটেড আউল দেখলাম প্রেমালাপে ব্যস্ত। সরোবরে ছবি নিয়েছি অরেঞ্জ-হেডেড থ্রাশ, টাইগা ফ্লাইক্যাচার, ব্রাউন-ব্রেস্টেড ফ্লাইক্যাচার, ব্লু-থ্রোটেড ব্লু ফ্লাইক্যাচার, ব্ল্যাক-নেপড মোনার্ক। এমন এমন অনেক পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে যারা হিমালয়ের ফুটহিল থেকে নেমে আসে কিছুদিনের জন্য। বেশি ঠান্ডা থেকে অপেক্ষাকৃত কম ঠান্ডায় মরসুম কাটাতে আসে এরা সরোবরে। অন্য একদিন সকালে সাফারি পার্কে ঘুরে বেরানো বর্ণালী বা ইন্ডিয়ান পিট্টা-র ছবি তুলতে গিয়ে খবর পেলাম কয়েকটি বিরল প্রজাতির কচ্ছপের। ছুটলাম আমরা। লেকের জলে ভাসমান নারকেলের গাছের উপর বসে আছে হোয়াইট ব্রেস্টেড ওয়াটার হেন, কিন্তু কচ্ছপের দেখা নেই। যাইহোক, ওয়াটার হেনের ছবি তুলে ক্যামেরার ছবি রিভিউ করে দেখছি, হঠাৎ চোখে পড়ল শুয়ে থাকা নারকেল গাছের উপর বসে আছে দুটি কচ্ছপ। এগুলি এক বিরল প্রজাতির। যার নাম ইন্ডিয়ান রুফড টারটেল। দেখি একটু পরে আরও তিনটি উঠে এসেছে রোদ পোহাতে। এখানে এই কচ্ছপ থাকার কথা নয়। কেউ হয়ত নিজস্ব সংগ্রহ থেকে ছেড়ে গেছে কচ্ছপগুলি। কারণ সরোবরের সঙ্গে কোনো জলাশয়ের যোগ নেই। পরিযায়ী পাখিদের মানচিত্রে রবীন্দ্রসরবর একটি মরুদ্যানের মতই। না হলে কেনই বা প্রতিবছর পরিযায়ী পাখির দল কিছুদিনের জন্য হলেও এখানে আসে!
Spotted owlets
Verditer flycatcher
White-throated kingfishers
প্রতিদিন সকালে লোকজনের আনাগোনা, গাড়ির শব্দে ভরা এই কংক্রিটের জঙ্গলের মাঝে সবকিছু ভুলে গিয়ে পাখিরা মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে বলে, ছবি তুলতে সুবিধা হয়। কিন্তু এদের কথা ভেবে আমরাও কি কিছু করতে পারি না? অন্তত গাছপালা ও বাগানগুলোকে আরও ভালো ও সুন্দর করে রক্ষণাবেক্ষণ করা তো যেতেই পারে! কারণ এই রবীন্দ্র সরোবর হল শহরের বুকে পাখিস্থান।