No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক তিনি

    বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক তিনি

    Story image

    মোবারক হোসেন
    ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুলাই কলকাতার এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন প্যারীচাঁদ মিত্র। তাঁর পিতা রামনারায়ণ মিত্র ছিলেন সেকালে কলকাতার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। প্যারীচাঁদের মানস গঠনে পরিবারের বেশ কিছুটা প্রভাব ছিল। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চায় তাদের পরিবারের সে সময় যথেষ্ট সুনাম ছিল। তার মা আনন্দময়ী দেবী নারী শিক্ষার সেই অন্ধকার যুগেও ছিলেন যথেষ্ট শিক্ষাপ্রাপ্ত। পারিবারিক শিক্ষা ছাড়াও প্যারীচাঁদ মিত্র শৈশবে একজন গুরু মশাইয়ের কাছে সংস্কৃতি ও মুন্সীর কাছে ফারসিতে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে প্যারীচাঁদ মিত্র হিন্দু কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে কলেজ শিক্ষা সমাপ্ত করে যখন তিনি বেরিয়ে আসেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। তিনি ছিলেন সে সময়ে হিন্দু কলেজের বৃত্তি পাওয়া কৃতী ছাত্র। তার মনস্তত্ত্ব ও নীতি দর্শনে ছিল অসাধারণ জ্ঞান। ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মার্চ তিনি কলকাতার পাবলিক লাইব্রেরিতে সহকারী লাইব্রেরিয়ান হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এখানেই তার প্রথম কর্মজীবন শুরু হয়। বাঙালি সমাজে তিনি টেকচাঁদ ঠাকুর নামে সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

    ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ডিরোজিও কোম্পানি প্রেসে ছাপা হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস (১৮১ পৃষ্ঠার একটা বাংলা বই) প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’। যদিও এই গ্রন্থটি ছাড়াও তিনি ‘জাত থাকার কি উপায়’ (১৮৫৯ খ্রি:), ‘রামার রঞ্জিকা’ (১৮৬১ খ্রি:), ‘অভেদ’ (১৮৬১ খ্রি:) এবং ‘আধ্যাত্মিকা’- (১৮৮০ খ্রি:) ছাড়াও আরো কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তবে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮ খ্রি:) প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে সাড়া পড়ে গিয়েছিল তৎকালীন সাহিত্য পিপাসু মহলে। পরে ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও বইটির বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করেছিলেন। প্যারীচাঁদ মিত্রই প্রথম সাহিত্যিক যিনি কথ্য ও সাধুভাষার মধ্যে দূরত্ব দূর করে সাধারণ মানুষের সাথে সাহিত্যের যোগাযোগ স্থাপন করেন। প্যারীচাঁদ মিত্রের অসাধারণত্ব বিশ্লেষণ করে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন ‘‘উহার অপেক্ষা উৎকৃষ্ট গ্রন্থ তৎপর কেহ প্রণিত করিয়া থাকিতে পারেন অথবা ভবিষ্যতে কেহ করিতে পারিবেন কিন্তু ‘আলালের ঘরের দুলাল’ দ্বারা বাংলা সাহিত্যের সে অশেষ কল্যাণ সাধিত হইয়াছে তাহা আর কোনো বাংলা গ্রন্থে সেইরূপ হয় নাই।’’

    ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে প্যারীচাঁদ মিত্রের বাল্যবন্ধু রাধানাথ শিকদারের (তৎকালীন গণিতের মেধাবী ছাত্র ও এভারেস্টের উচ্চতা নির্ণয়কারী) সম্পাদনায় একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সেই পত্রিকায় প্যারীচাঁদ মিত্র ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ এই ছদ্মনামে তার ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন। পরে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ পুস্তাকাকারে মুদ্রিত হয়ে প্রচারিত হয়।

    এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথাধি থেকে জানা যায়, ‘আলালের ঘরের দুলাল’ হচ্ছে বাঙালি লিখিত প্রথম উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাসিকের মর্যাদা যদি কাউকে দিতে হয় তা হলে সেই সম্মান প্যারীচাঁদ মিত্রেরই প্রাপ্য।

    অবশ্য ‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্রকাশিত হওয়ার আগে ক্যাথরিন মুলেন্স নামক একজন বিদেশিনী খ্রিষ্টানের লেখা ‘ফুলমনি ও করুণার বিবরণ’ (১৮৫২ খ্রি:) একটি উপন্যাসের সন্ধান আমরা পাই। এই গ্রন্থটিতে একটি খ্রিষ্টান পরিবারের ঘটনাকে তুলে ধরা হয়েছিল। শ্রীমতি মুলেন্স অতি চমৎকার বাংলাভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। তবে উপন্যাস হিসেবে এটাকে সার্থক বলা চলে না। তা ছাড়া ‘ফুলমনি ও করুণার বিবরণ’ গ্রন্থটি মূলত : The Last day of the week বিবশ নামক একটি ইংরেজি গল্পের ছায়া অবলম্বনে রচিত। তা ছাড়া গ্রন্থটির কাহিনী নির্জীব, নীরস। সেই জন্য এটি সে সময় চিত্তাকর্ষক হতে পারেনি। এর তুলনায় ‘আলালের ঘরের দুলাল’ কাহিনী সৃষ্টিতে অনেক বেশি সার্থক। তাই ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থটিকেই সেই সময় বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রথম উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

    বাংলা সাহিত্যের আধুনিক আদর্শের সার্থক উপন্যাস হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশ নন্দিনী’কেই (১৮৬৫ খ্রি:) আমরা বিজয়ের মাল্য গলায় পরাতে পারি। অবশ্য ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে প্যারীচাঁদ মিত্র রচিত ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এবং কালী প্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম-প্যাঁচার নকশা’ (১৮৬২ খ্রি:) কেন্দ্র করেই বাংলা উপন্যাসের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে উঠেছিল।

    ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসে বাবু রামবাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র মতিলালের জীবনে ছন্নছাড়া নারী সঙ্গ, কামুকতা এবং মদ্যপান ঘটিত বিড়ম্বনা সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে। অবশ্য সে সময়েও লেখা আরেকটি উপন্যাস ভবানী চরণের ‘নব বাবু বিলাস’। এই ‘নব বাবু বিলাসে’ ও তৎকালীন বাঙালি সমাজের চিত্র পিতার অমনোযোগের ফলে পুত্রের পাঠ্যাভাসের হানি হলে তার চরিত্র স্ত্রৈণতা এবং পান দোষের দ্বারা কী পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে উঠতে পারে তা সুন্দরভাবে এই উপন্যাসটিতেও (নব বাবু বিলাস) দেখানো হয়েছে। কিন্তু ‘নব বাবু বিলাসের’ সাথে ‘আলালের’ তফাত হলো তৎকালীন তিনি শুধু সমাজের ভ্রষ্টাচারের চিত্রই অঙ্কিত করেননি। গ্রন্থটির মধ্যে তিনি একটি ইতিবাচক দিকও সার্থকভাবে তুলে ধরেছেন। বাবু রাম বাবুর কনিষ্ঠ পুত্র রাম লালের উত্তম চরিত্র হওয়ার কাহিনী এবং জীবন বোধের জন্য প্যারীচাঁদ মিত্র সে আমলে মুক্ত ভাবাদর্শ ও উত্তম জীবন বোধ দ্বারা পরিচিত হয়েছিলেন।

    একাধারে তিনি ছিলেন নেতৃস্থানীয় সমাজকর্মী, সফল ব্যবসায়ী ও প্রথিতযশা সাংবাদিক। ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ নভেম্বর ৬৯ বছর বয়সে তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নানা প্রতিষ্ঠানে বহু কল্যাণকর ও গঠনমূলক সেবাকার্যের সাথে যুক্ত ছিলেন।

    ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসে বিশেষত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে কলকাতা ও তার নগর কেন্দ্রিক সামাজিক চিত্র আশ্চর্য নিপুণতার সাথে অঙ্কিত হয়েছে। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্যারীচাঁদ মিত্রকে দান করেছে অমরত্ব ও বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে এক যুগান্তকারী স্বর্ণ শিখরের সার্থক রূপায়ণ।

    (ঋণ – অন্যধারা২৪)

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @