দেশের বিচারব্যবস্থা আরও সহজ-সরল হবে না কেন?

গত কয়েকমাসের সংবাদপত্রের পাতা ওলটালে দেশজোড়া নানা প্রশাসনিক অনাচারের সমান্তরালে আমাদের সমুন্নত বিচারবিভাগের নানা প্রাগ্রসর পদক্ষেপের দৃষ্টান্ত। কোথাও সরকারি দফতরের দুর্নীতি আড়াল করা কেষ্টবিষ্টুদের কাঠগড়ায় তুলে তাদের কারাভ্যন্তরে নিক্ষেপ করা, কোথাও বা পুলিশি অপদার্থতার পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের সক্রিয়তায় নিরপেক্ষ তদন্তের নিশ্চিতি, কখনও বা রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন প্রতিরোধে আদালতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশ। আমাদের সংবিধানের রীতিনীতিতে বিচার ব্যবস্থার ওজন ও গুরুত্ব সবথেকে বেশি – ইতিহাস বইয়ের পাতায় যেসব মহামানবের ছবি ছাপানো থাকে তার বাইরে আদালতের হাকিমদের মহামান্য বলে সম্বোধন করাটাই আমাদের সাবেকি রীতি। একেবারে সাধারণ মানুষও জানেন, পাড়ার কাউন্সিলার বা শাসকদলের দাদারা যদি তার জরুরি সমস্যায় মাথা না–গলান, স্থানীয় থানা বা প্রশাসন যদি উদাসীন হয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোন বা সরাসরি পাত্তা না দেন তখন তাঁকে শেষ অবধি আদালতের দরজায় যেতে হয়। তবে সেই পথের শেষে কী আছে তা জানা না-থাকলেও ওই পথে এগোতে গেলে মাথায় অনেক ভাবনা চিন্তা ও পকেটে যথেষ্ট রেস্ত নিয়ে আগুয়ান হতে হয় । তবু বিপন্ন মানুষকে কোথাও না কোথাও তো একটা আশ্রয় নিতে হবে। মন্দির মসজিদ বাবাজি মাতাজি আশ্রম আখড়া বা এন জি ও – এইসব আধিদৈবিক প্রতিষ্ঠানেও বিনি পয়সায় কোনও কাজ হয় না। তাছাড়া এইসব সংস্থায় কাজের সীমানাও খুব নির্দিষ্ট। পুত্রবধূর সন্তান হচ্ছে না বলে মন্দিরে জাগ্রত দেবীর কাছে মানত করা হয়তো চলে, কিন্তু লকআপে পুলিশ কাউকে পিটিয়ে মারলে দেবীর থানে মাথা ঠুকলে হয় না, নির্দিষ্টভাবে আদালতেই যেতে হয়। আবার কখনো কোনও মহানির্দেশকের চিত্রনাট্য অনুসরণ করে যদি আইনের রক্ষকরা অভিযোগকারীকে দিয়ে শ্বেতশুভ্র পৃষ্ঠায় স্বাক্ষর করিয়ে নেন এবং পরে সুবিধেমত আপন মনের মাধুরী মিশায়ে এফআইআর রচনা করেন, তখনও সেই হতভাগ্যকে কপাল চাপড়ালে চলে না, ছুটতে হয় আদালত থেকে আদালতান্তরে। অভিজ্ঞতা বলে, এই চলাচলটা খুব অনায়াস নয়।
আরও পড়ুন
কলকাতা জুড়ে স্থাননাম ঘিরে হরেক প্রশ্ন
কিন্তু একথাটা ঠিক যে রাজনীতির দলগুলি যেভাবে দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিগ্রস্তদের নন্দনকানন হয়ে উঠছে তাঁকে উল্টো পথে চালানো খুব সিধে কাজ নয়। স্বাভাবিকভাবে দেশের সংবিধান যখন রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আইনপ্রণয়ন ও প্রশাসন পরিচালনার দায়ভার দিয়েছে তখন আইনসভা নিজেদের কোলে ঝোল টেনে আইন বানাবেন এইটাই দস্তুর। পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনের বড়ো মেজো সেজো কর্তাদের নিজেদের অনুগত ভৃত্য বলেই ভাবতে অভ্যস্ত থাকবেন – এ মোহ আবরণ কেটে কোনও অমল আকাশের সন্ধান মিলবে এমন না ভাবাই ভালো। ফলে যে জায়গাটায় এখনও মানুষের আশা-ভরসা রয়েছে সেই বিচার ব্যবস্থার কোথাও একটা নির্ভরতার জায়গা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে তা হয়েও গেছে। তার সব থেকে বড় প্রমাণ দেশের সর্বস্তরের আদালতে জমে ওঠা মোকদ্দমার পাহাড়, এই মুহূর্তে যার চুড়ো মাউন্ট এভারেস্টকেও ছাড়িয়ে গেছে।
একটা কথা সেই সূত্রেই এসে পড়ে, যে, আইনকানুন সরাসরি সাধারণ মানুষের নানা সমস্যাকে লাঘব করার কাজে লাগে তার প্রয়োগবিধি আরও সরলীকরণ হবে না কেন? মানুষের খুঁটিনাটি সমস্যায় প্রতিদিনের প্রশাসন যেখানে উদাসীন যা আরও বেশি করে মানুষকে আদালতমুখী করছে সেখানে পরিষেবা পাওয়ার পথ সহজতর করার কথা ভাবা হবে না কেন? বিদেশি বিনিয়োগের জন্য যদি আমরা ‘এক জানালা’ নীতির কথা ভাবতে পারি, আদালতের আইনি পরিষেবাতেও এই মসৃণতার ছোঁয়াচ লাগবে না কেন ?
আরও পড়ুন
সব মূর্তি নিছক ‘মূর্তি’ হয় না
সাম্প্রতিক সময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি তথ্যের দিকে চোখ রাখা যায়। প্রথম তথ্যটি হল, সারাদেশে মোট জমে থাকা মোকদ্দমার সংখ্যা তিনকোটি ছাড়িয়েছে আর বিভিন্ন আদালতে মোট বিচারপতির সংখ্যা ষোলো হাজারের কাছাকাছি। সরল পাটিগণিত বলছে, এই জমে থাকা মামলার মীমাংসা হতেই কয়েক দশক লেগে যাবে। যদিও এই হিসেবও সম্পূর্ণ সঠিক নয়। কারণ এই অমীমাংসিত মামলাগুলির মীমাংসা হতে হতে আরও প্রচুর মামলা জমে যাবে এবং বিচারপতির সংখ্যা আনুপাতিক হারে কমে আসবে। কারণ সরকারি সবস্তরেই কর্মী আধিকারিক সংকোচন করে একজনের ওপর বাড়তি বোঝা চাপানোটা একরকম সরকারি নীতি হিসেবেই আজকাল বিবেচিত হয়। অন্যদিকে ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে সারা দেশে বিচারাধীন বন্দিদের শতকরা সত্তর ভাগেরও বেশি বন্দি বিচারাধীন অবস্থাতেই এতদিন কারাবাস করে ফেলেছেন যা তাদের মূল অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারাবাসের মেয়াদের একটা বড় অংশ। এমন হতেই পারে, এবং হবেও, এই অপরাধীদের অনেকের ক্ষেত্রেই অপরাধের উপযুক্ত প্রমাণ মিলবে না অথচ তাদের কারাবাস সামগ্রিকভাবে পঙ্গু করে দেবে তাদের আর্থিক সামাজিক অস্তিত্ব! বিচারব্যবস্থা যদি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ হয় তাহলে এই তথ্য দুটোর কোনোটাই খুব স্বস্তিকর নয়।
আরও পড়ুন
‘ট্রোলে’ ভুবন ভরিয়ে দেবে, ভেবেছিল...
এরই পাশাপাশি বিস্ময়কর হল, আদালতগুলিতে কাজের দিনের অপ্রতুলতা। আদালতের কাজের সঙ্গে গ্রীষ্ম, শীত বা পুজোর কোনও সম্পর্ক নেই, কিন্তু ঔপনিবেশিক প্রথা মেনে এখনও আদালতে মাসাধিক কাল গরমের ও পুজোর ছুটি থাকে, শীতের ছুটিও থাকে দিন দশেকের। কেন? সরকারি কোনও দফতরে তো এইরকম একটানা কাজ বন্ধ থাকার দৃষ্টান্ত নেই, তেমন গুরুত্বপূর্ণ দফতরে প্রয়োজন হলে কর্মীদের ছুটি বাতিল করে তাদের জরুরি কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এর ওপরেও আছে আরেকরকমের আদিখ্যেতা। শোনা যায়, মহামান্য বিচারপতিরা সকাল এগারোটায় এজলাসে বসেন, বেলা দেড়টা নাগাদ তাদের খিদে পায়। খেয়ে জিরিয়ে তারা ফের আদালতকক্ষে আসেন এবং সাড়ে তিনটে-চারটের মধ্যে শুনানি শেষ করে আবার বিশ্রামকক্ষে চলে যান । কোনও সরকারি কর্মী বা আধিকারিক কি এমন সুযোগ উপভোগ করার সময় পান? নির্বাচনের সময়ে বা অন্য কোনও জরুরি সময়ে পুলিশ বা প্রশাসনের কর্মী আধিকারিকদের দিনরাত এক করে কাজ করতে হয়, নির্দিষ্ট ছুটির দিনে তারা ছুটিও পান না, চা-টিফিন খাওয়ার সময়টুকুও অনেক সময় জোটে না! সরকারি কর্মী বা পুলিশের কাজ যদি হয় জনগণকে পরিষেবা দেওয়া, তবে বিচারপতিরাও জনগণের করের টাকায় বেতন বাংলো বাবুর্চি বাহন সবই পান – কথায় কথায় আদালতের কাজ মুলতুবি রাখা কি সুবিচার পাওয়ার পথে অন্তরায় নয়?
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)