প্রিয় বিদায়

তখনও বাতাসে সংশয়, সন্দেহ, অবিশ্বাস, বারুদের গন্ধ; দেয়াল জুড়ে মাও সে তুং-এর ছবি। স্লোগান – চিনের চেয়ারম্যান...। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের চাপে এবং নীতির চোরাগলিতে ঢুকে, আভ্যন্তরীণ বিবাদে জড়িয়ে পড়ে নক্সালপন্থী রাজনীতি আকর্ষণ হারাচ্ছে। কংগ্রেসের বিকল্প শক্তি যুক্তফ্রন্ট মানুষের আশা-আকাংখা পূরণে ব্যর্থ এবং সেও আভ্যন্তরীণ কলহে লিপ্ত হয়ে মানুষের আবেগে আঘাত করেছে। অন্যদিকে, রাষ্ট্র ও প্রশাসনের মদতে এই রাজ্যে নব কংগ্রেস তার সাংগঠনিক শক্তি বাড়াচ্ছে। তখন পরিস্থিতি এমনই।
আমরা তখন সবে এসেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিছুটা ঠেকায় পড়ে, কিছুটা কোনও এক বন্ধুর চাপে পড়ে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হই। তখনও ছাত্র পরিষদ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে তেমন দীর্ণ হয়নি(অন্তত প্রকাশ্যে), তখনও রাজ্যের ছাত্র-যুবদের প্রধানতম নেতার নাম প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী (১৩ নভেম্বর, ১৯৪৫ – ২০ নভেম্বর, ২০১৭)। জন্ম নিয়েছে নতুন এক দেশ -বাংলাদেশ । জন্ম নিয়েছে নতুন এক প্রত্যয় – আমরা পারি। আমাদের কানে তখন বাজছে – তোমার প্রিয় আমার প্রিয় প্রিয়-সুব্রত যুগ যুগ জিও।
আমার জীবনে অন্যতম বেদনাদায়ক ঘটনা অখিলেশের মৃত্যু। মৃত্যু তো নয়, হত্যা। ছাত্র পরিষদের দুই গোষ্ঠীর বিবাদের ফলে উপাচার্যের ঘরে ছুরিকাঘাতে প্রাণ যায় অখিলেশের। ভারি বেদনার সেই দিন, কলঙ্কের দিন। এর মধ্যে রাজ্যরাজনীতিতে প্রিয়-বিরোধী অংশের(সোমেন মিত্র, প্রদীপ ভট্টাচার্য, বারিদবরণ দাস, প্রদ্যুত গুহ ইত্যাদি) মদতে গড়ে উঠেছে ‘শিক্ষা বাঁচাও কমিটি’। শিবিরে শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে ছাত্ররা। বহরমপুরে রাজ্য সম্মেলনের পর দুই গোষ্ঠীর মাঝে দূরত্ব যেন আরও বেড়েছে। কারণ মূলত ক্ষমতার সমান বা যুক্তিসম্মত ভাগ না পাওয়া।
আজ, এতদিন পরে মনে হয়, কেবল সিদ্ধার্থ রায়ের কূটচাল নয়, সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের অদূরদর্শী রাজনীতি কংগ্রেস রাজনীতিতে দুই শিবিরের দূরত্ব বাড়ানোর অন্যতম প্রধান কারণ। আর সুব্রতর প্রতি ভালবাসায় অন্ধ প্রিয়-র ঘাড়ে চাপে সে দায়। প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী তখন যুব কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি পদে নির্বাচিত(১৯৭১)। বিধাননগরে কংগ্রেস অধিবেশনের সুচারু আয়োজনের জন্যও দেশের অন্য রাজ্যেও প্রশংসিত। এই সময় কমলাপতি ত্রিপাঠীর মুখে শুনেছি যে তাঁরা তখন বাংলার কেবল দুজন নেতাকে সমীহ করতেন – সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ও প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী। অনেক পরে প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সীর মুখেই শুনেছি যে তাঁর বিচারে দেশে ও দলে আছেন তিন নেতা – ইন্দিরা গান্ধী, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় আর তিনি।
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই বোধহয় কাল হয় তাঁর। প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী ইন্দিরাকে ছেড়ে আলাদা দল করলেন। দল না ছেড়ে তাঁর উপায় ছিল না – তিনি পরোক্ষে যুবরাজ সঞ্জয়ের নেতৃত্ব, যোগ্যতা ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।
এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল যে ছাত্র পরিষদ কিন্তু কদাচ কংগ্রেসের শাখা সংগঠন ছিল না। প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সীর নেতৃত্বে সে সংগঠন মূল সংগঠনের থেকে গুরুত্ব আদায় করে নেয়। এই রীতি যদি ছাত্র সংগঠনগুলি অনুসরণ করত!
যখন কুমুদ ভট্টাচার্য ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি তখন দলের থেকে ছাত্র পরিষদকে দেওয়া হয়েছিল একটি জিপ, দৈনিক বরাদ্দ ছিল তেল দশ লিটার আর পাঁচশ টাকা। কোষাধ্যক্ষ ছিলেন ধীরেন বসু, তাঁর থেকে বরাদ্দ সেই সামান্য টাকা বা তেলের কুপন জোগাড় করাও ছিল বেশ দুরূহ। অফিস ছিল মহাজাতি সদনের দোতলার ঘেরা ব্যালকনিতে।
মহাজাতি সদনের দোতলার অফিসেই প্রিয়দার সাথে ঘনিষ্ঠ আলাপ। আমরা কয়েকজন তখন ওখানেই থাকি। অখিলেশ হত্যার পর নুরুল গোষ্ঠী আমাদের ঘরছাড়া করে, আমরা কয়েকজন আশ্রয় নি’ মহাজাতি সদনের অফিসে। কোনদিন নীচে সঙ্গীত অনুষ্ঠানে, কোনদিন নেতাদের দরবারে।
ওখানেই কথা হত তাঁর সাথে। তাঁর কাছে রাজনীতির নানা আঙিনা চেনা। প্রিয়দা এই রাজ্যের প্রতি ব্লকের অন্তত একজন কংগ্রেস কর্মীকে চিনতেন, তার হাঁড়ির খবর জানতেন। বিরুদ্ধ দলের খবরও রাখতেন।
তখনই আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় যে, প্রিয়-সুব্রত জুটি আর তেমন নেই। অস্পষ্টতাও ছিল। একদিন সুব্রত বললেন, আমার ঘাড়ে বন্দুক রেখে দক্ষিণ কলকাতায় প্রিয়দার রাজনীতি করায় আমি আর মদত দেব না। এর দুএকদিন পরে প্রিয়দা ফিরল বিদেশ থেকে। সুব্রতর বাড়িতে এলে দুজনে সেকি ভাব, সেকি ভালবাসা বিনিময়! সুব্রত বললেন, তুমি ভিতরে যাও, বউমা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে(অল্পদিন আগে সুব্রত বিয়ে করেছেন, প্রিয় তখনও অবিবাহিত)।
দক্ষিণী বার্তা নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন প্রিয়দা, যেখানে নিয়মিত লিখতেন বিশিষ্ট বামপন্থী লেখক ও এককালের বিপ্লবী নেতা শৈবাল মিত্রও। শৈবালদাকে একবার জিগ্যেস করেছিলাম, দক্ষিণী বার্তায় লেখেন কেন?
- ওতো প্রিয়র পত্রিকা। পুরোন বন্ধু তো, ওর অনুরোধ ফেলতে পারি না।
তবে প্রিয়দা লেখকদের যে মর্যাদা দিতেন তার তুলনা নেই। আমার মতো অর্বাচীন লেখকও সে পত্রিকায় লিখে সম্মান-দক্ষিণা পেয়েছে।
প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সীর মৃত্যুতে দুঃখ পেয়েছি একথা বলব না, মানুষটা বড় কষ্ট পাচ্ছিলেন তো। তার চেয়ে বুঝি এই ভালো। দুঃখ পেয়েছি U-17 বিশ্বকাপে তাঁর প্রতি যে অবহেলা প্রকাশ পায় তাতে। প্রিয়দা সে অবহেলা বোঝার জায়গাতেই ছিলেন না।