No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    সুখে-দুঃখে সেলাই সম্বল করে ‘পদ্মশ্রী’ পেলেন সোনারপুরের প্রীতিকণা গোস্বামী

    সুখে-দুঃখে সেলাই সম্বল করে ‘পদ্মশ্রী’ পেলেন সোনারপুরের প্রীতিকণা গোস্বামী

    Story image

    “নকশি-কাঁথাটি বিছাইয়া সাজু সারারাত আঁকে ছবি,/ ও যেন তাহার গোপন ব্যথার বিরহিয়া এক কবি।”

    পল্লিকবি জসিমউদ্দিনের ‘নকশিকাঁথার মাঠ’-এর সাজুর কথা মনে করিয়ে দিলেন এপার বাংলার সোনারপুরের একজন প্রবীণশিল্পী প্রীতিকণা গোস্বামী। তাঁর কাছেই শুনছিলাম যে ১৭ বিনিদ্র রাত জেগে জীবনে প্রথমবার তিনি একটি কাঁথার নকশা তুলেছিলেন। হ্যাঁ, এই প্রীতিকণা গোস্বামীই সারাজীবন ধরে তাঁর সেলাই নির্ভর কাজের সম্মাননা হিসেবে ২০২৩ সালে পেয়েছেন ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী’।

    দুই বাংলার শুধু সাহিত্যে নয়, জীবনযাপনে, সংস্কৃতির সঙ্গে এই লোকশিল্প অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে রয়েছে। সাধারণ কাঁথা সেলাইয়ের সঙ্গে শ্রম ও মনের মাধুরী মিশিয়ে বাংলার মা-বোনেরা শত শত বছর ধরে নকশিকাঁথার যে বর্ণময় ইতিহাস রচনা করেছেন, প্রীতিকণা গোস্বামীর হাত ধরে তা যেন আবার বাংলাকে উজ্জ্বল করে তুলল। তিনি আজীবন নকশিকাঁথা-সহ বিভিন্ন সুচিশিল্পের উজ্জ্বল সফরের যাত্রী থেকেছেন। হাতের দক্ষতার পাশাপাশি চোখের আন্দাজে ফুল পাতার নানা নকশা তুলেছেন জীবনভর। দেশে বিদেশের ভিন্ন ভিন্ন মিউজিয়াম ঘুরে কাজ শিখেছেন এবং শিখিয়েছেন। বাংলার মেয়েদের সেলাইয়ের কাজ শিখিয়ে তাঁদের স্বনির্ভর করার দায়িত্বেও তিনি সফল।

    সাধারণ কাঁথা সেলাইয়ের সঙ্গে শ্রম ও মনের মাধুরী মিশিয়ে বাংলার মা-বোনেরা শত শত বছর ধরে নকশিকাঁথার যে বর্ণময় ইতিহাস রচনা করেছেন, প্রীতিকণা গোস্বামীর হাত ধরে তা যেন আবার বাংলাকে উজ্জ্বল করে তুলল।

    কে এই প্রীতিকণা গোস্বামী?

    দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুরের নয় নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা প্রীতিকণা পেশায় একজন কাঁথা-এমব্রয়ডারি শিল্পী৷ ‘কমলাদেবী কাঁথা সেন্টার’ নামে একটি সূচশিল্পের প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তিনি। বছরের পর বছর ধরে বিনা পারিশ্রমিকে তৈরি করছেন বহু ছাত্রীকে, যাঁরা তাঁর উত্তরসূরি। শুধু বাংলা বা ভারতের সীমানায় আবদ্ধ থাকেননি তিনি, বিদেশেও তাঁর শিল্পকীর্তি ছড়িয়ে পড়েছে৷ পুরস্কারের ঝুলি ক্রমশ ভারী হয়েছে জেলাস্তর থেকে জাতীয় পুরস্কারে। আর পদ্মশ্রীতে ভূষিত হওয়া এই প্রবীণ শিল্পী এভাবেই হয়ে উঠেছেন সারা দেশের নারী ক্ষমতায়নের প্রতীক।

    জীবনের লড়াই

    বাঙালির অন্দরমহলে একসময় সূঁচ সুতোর কদর ছিল। প্রীতিকণাও ছোটোবেলায় তাঁর ঠাকুমা, পিসিমাদের হাতের কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। কিন্তু সে অর্থে হাতের কাজে হাতেখড়ি তাঁর ছিল না। মাত্র ১০ বছরে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ায় সংসারে নেমে আসে দুর্দিন। শুরু হয় দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই। তখনই সেলাইয়ে হাতেখড়ি আর তারপর থেকে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে তিনি এটাকেই আঁকড়ে ধরেন। তাঁর ভাষায়, “তখন আমার জীবনে পুরস্কার বা কোনো সম্মান ছিল না। বেঁচে থাকার জন্য অর্থ রোজগারের পথ ছিল সেলাই।”

    এভাবেই চলতে চলতে জীবনে পরিবর্তন আসে। হাতের কাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি আসে সুযোগও। আগেই বলেছি, ১৭ রাত জেগে তিনি একটি কাঁথার নকশা তুলেছেন। সেই কাজ দেখিয়ে ক্রাফট কাউন্সিল অব বেঙ্গলের বিশ্বাস জয় করেন তিনি। এরপর ক্রাফট কাউন্সিলের উদ্যোগে বাংলার মেয়েদের নিয়ে প্রীতিকণা শুরু করেন নিজের প্রতিষ্ঠান। নিজে প্রতিষ্ঠানের জন্য মেয়ে খুঁজেছেন আর অবিরাম শিখিয়েছেন। বাঘাযতীনের পর আবার সোনারপুরে শুরু করলেন একই উদ্যোগ। আর অন্যদিকে ক্রাফট কাউন্সিলের উদ্যোগে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের মিউজিয়াম ঘুরে নানা ধরনের হাতের কাজ শিখে হয়ে উঠেছেন স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যে তাঁর প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীদের উন্নতি হয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ জয় করেছেন পুরস্কার।

    মাত্র ১০ বছরে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ায় সংসারে নেমে আসে দুর্দিন। শুরু হয় দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই। তখনই সেলাইয়ে হাতেখড়ি আর তারপর থেকে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে তিনি এটাকেই আঁকড়ে ধরেন।

    বিদেশে পাড়ি

    কমলাদেবী কাঁথা সেন্টারের জার্নি আন্তর্জাতিক হয়ে উঠল কীভাবে? সে কথা লিখতে গেলে প্রীতিকণা গোস্বামীর মেয়ে মহুয়ার কথা বলতে হবে। প্রবীণ শিল্পী বলেন, “বড়ো মেয়ে মহুয়া ততদিনে ভারতের ফ্যাশন টেকনোলজির প্রথম স্তরের প্রতিষ্ঠান এনআইএফটি থেকে পাশ করেছে। মেয়েকে বলেছিলাম আমার পরে এই সৃষ্টিকর্মকে বাঁচিয়ে রাখতে। কাঁথা সেলাই একটা পরম্পরা শিল্প। সেটা বাঁচিয়ে রাখতে গেলে এ নিয়ে আরো কাজ করে যেতে হবে।” শুরু হল প্রীতিকণার যোগ্য উত্তরসূরি মহুয়া লাহিড়ীর লড়াই। এই সমাজে প্রীতিকণার শিল্পীজীবন যেভাবে অবহেলিত হয়েছে, তা দেখে মহুয়া সংকল্প নেন যাতে শিল্পীরা তাঁদের যোগ্য সম্মান ও পারিশ্রমিক থেকে কখনোই বঞ্চিত না হন। যদিও প্রথমে মায়ের শিল্পভাবনা নিয়ে ছোটোবেলা থেকে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না তিনি। শিল্পীদের দারিদ্র্য, বঞ্চনা আর অবহেলা দেখে দেখে তিনি হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন। তবে ডিজাইনার হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর তাঁর ভাবনাচিন্তার পরিবর্তন ঘটে। মহুয়া বঙ্গদর্শন.কম-কে বলেন, “আমস্টারডামে একবার দেখলাম একজন বিশিষ্ট শিল্পী তাঁর হাতের কাজের প্রদর্শনী করছেন। তাঁর কাজ দেখে সেই প্রথমবার উপলব্ধি হল, বাংলার কাজ বা আমার মায়ের শিল্প অনেক ভালো। তাই মনে হল মায়ের শিল্পকে বিদেশেও পৌঁছে দিতে হবে। আমরা শুরু করলাম হাসনুহানা নামের সংগঠন।”

    ‘হাসনুহানা’ বিদেশে প্রীতিকণাকে দিয়েছে বিশেষ পরিচিতি ও সম্মান। এবার ‘পদ্মশ্রী’ পেয়ে তাঁর দায়িত্ব আরও বেড়েছে। আরও অগুনতি মহিলাকে সেলাইনির্ভর করে জীবন ও জীবিকার পথে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তবে নকশিকাঁথা আঁকড়ে যে লড়াই তিনি শুরু করেছিলেন, তাকে নিঃসন্দেহে মানুষ মনে রাখবে কবির ভাষায়, “অনেক সুখের দুঃখের স্মৃতি ওরই বুকে আছে লেখা,/ তার জীবনের ইতিহাসখানি কহিছে রেখায় রেখা।”

    ____

    *প্রীতিকণা গোস্বামী এবং মহুয়া লাহিড়ীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লেখা

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @