বাংলার এক নির্বাসিত রাজপুত্র যেভাবে হয়ে উঠলেন লঙ্কাদ্বীপের রাজা

বিজয় সিংহের লঙ্কা জয় নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত একটি মহাকাব্য লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন। খানিকটা লেখা শুরু করেছিলেন, আর কাহিনির সারাংশ অনেকটাই খসড়া করে রেখেছিলেন ইংরেজিতে। তবে অল্প বয়সে তিনি মারা যাওয়াতে ওই কাব্য আর বেশি দূর এগোতে পারেনি। বিজয় সিংহের কথা বাঙালি সাধারণত ছোটোবেলাতেই জেনে যায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায় আর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা থেকে। শ্রীলঙ্কা বা সিংহল দ্বীপের প্রথম ঐতিহাসিক শাসক ধরা হয় বিজয় সিংহকেই। গবেষকরা বলে থাকেন, খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩ থেকে ৫০৫ সাল পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেছিলেন সিংহলে। যদিও কীভাবে তাঁর জন্ম হয়েছিল, কীভাবে তিনি সিংহল অর্থাৎ এখনকার শ্রীলঙ্কায় পৌঁছেছিলেন, সেগুলো নিয়ে যে পৌরাণিক গল্পগুলো প্রচলিত আছে, যেগুলো অন্যান্য পৌরাণিক সাহিত্যের মতোই মনগড়া অলৌকিক কাহিনিতে ভরপুর। প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্য ‘মহাবংশ’ আর ‘দ্বীপবংশ’-তে রয়েছে বিজয় সিংহের পৌরাণিক গল্প। আর চিন দেশের পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের বিবরণ এবং অজন্তার গুহাচিত্রেও সিংহল বিজয়ের কথা আছে। তবে চারটে কাহিনির মধ্যে কিছু কিছু অমিলও খুঁজে পাওয়া যায়।
পৌরাণিক কাহিনিগুলো যতই মনগড়া হোক, ইতিহাসবিদদের কাছে সেগুলো কিন্তু মোটেও ফেলনা নয়। গবেষকরা সেগুলো থেকেই এমন সব তথ্য বের করে আনেন, যেগুলো দেখে চমকে উঠতে হয়। সেটা নিয়ে আরেকদিন বলা যাবে বরং। এখন আপাতত ‘মহাবংশ’ আর ‘দ্বীপবংশ’-র গল্পে ফেরা যাক। এই দুটো বইয়ের কাহিনিতে সামান্য কিছু পার্থক্য থাকলেও বেশিরভাগটা একই। বঙ্গদেশের এক রাজকন্যা ছিলেন সুসিমা। তখনকার যুগে তিনি বেশ স্বাধীনচেতা ছিলেন বলে প্রায়ই লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার হতেন। একবার মনের দুঃখে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। বণিকদের একটা দল মগধে যাচ্ছিল, তাদের সঙ্গেই চলতে থাকেন সুসিমা। রাঢ়দেশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে এক সিংহ তাদের আক্রমণ করে। সিংহ দেখে বণিকরা তো সোজা চোঁ-চোঁ দৌড় লাগাল। আর সুসিমাকে সিংহ নিয়ে গেল নিজের গুহায়। তারপর একদিন সিংহ আর সুসিমার দুই সন্তান জন্মাল। ছেলের নাম রাখা হল সিংহবাহু আর মেয়ের নাম সিংহসিবলী। দীনেশচন্দ্র সেন মনে করেন, এই সিংহ বনের কোনো পশু নয়। সম্ভবত সিংহ উপাধির কোনো ডাকাত আক্রমণ করেছিল বণিকদের।
এদিকে সুসিমা একদিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে সিংহকে ছেড়ে পালালেন। ফিরে এলেন বাবার রাজ্যে। তাঁর বাবা বঙ্গেশ্বর ততদিনে আর বেঁচে নেই। বঙ্গেশ্বরের এক ভাইয়ের ছেলে তখন সিংহাসনে বসে। সুসিমা এসে বিয়ে করে ফেলেন তাঁকে। সিংহ তো আবার ততদিনে সুসিমার খোঁজে চলে এসেছে বঙ্গদেশের সীমান্তে। শুরু করেছে নানা উৎপাত। তখন সুসিমার ছেলে সিংহবাহু গিয়ে তাকে মেরে ফেলল। অর্থাৎ ছেলের হাতেই মরতে হল সিংহকে। আর সিংহবাহু ছোটোবেলায় যেখানে ছিলেন, সেই রাঢ় অঞ্চলে একটা রাজ্য তৈরি করে সেখানে রাজত্ব করতে থাকেন। সিংহপুর হয় তাঁর রাজধানী। নিজের বোন সিংহসিবলীকে বিয়ে করে রানি বানালেন। তাঁদের এক এক করে বত্রিশ জন ছেলে হয়। এদের মধ্যে সবথেকে বড়ো ছেলের নাম বিজয় সিংহ। এই বিজয় ছিলেন অল্প বয়স থেকেই বখাটে। বেশ কিছু অনুচর নিয়ে অত্যাচার করে বেড়াতেন প্রজাদের ওপর। প্রজারা গিয়ে নালিশ করতেন রাজাকে। কিন্তু রাজা কিছুতেই বড়ো ছেলেকে শোধরাতে পারেন না। শেষমেশ রাজা সিংহবাহু বিজয় সিংহ আর তাঁর দলবলের মাথা অর্ধেক কামিয়ে তাড়িয়েই দিলেন রাজ্য থেকে।
নির্বাসিত বিজয় তিনটে জাহাজ নিয়ে তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে সমুদ্রের দিকে রওনা দিলেন। প্রথম জাহাজে ছিলেন বিজয় সিংহ আর তাঁর সাতশো সাঙ্গপাঙ্গ, দ্বিতীয় জাহাজে এইসব অনুচরদের সাতশো সহধর্মিনী, আর তাদের ছেলেমেয়েদের রাখা হল তৃতীয় জাহাজে। নীল সমুদ্রে ভালোই এগোচ্ছিল তিনটে জাহাজ, কিন্তু হঠাৎ ঈশান কোণে মেঘ ঘনিয়ে এল। আর মেঘের সঙ্গে প্রচণ্ড ঝড়। সে ঝড়ে তিনটে জাহাজ ছিটকে গেল তিনদিকে। শিশুদের জাহাজটা গিয়ে পৌঁছল নগগদ্বীপ বা নাগদ্বীপে, মহিলাদের জাহাজ মহেন্দ্রদ্বীপ বা মহিলাদ্বীপে গিয়ে ভিড়ল আর বিজয় সিংহের জাহাজ নোঙর করল সুপ্পারক বা সুপুরা দ্বীপে। সুপুরা দ্বীপের বাসিন্দারা বেশ অতিথিপরায়ণ, বিজয় আর তার দলবলকে যত্নআত্তির কোনো ত্রুটি রাখেনি তারা। কিন্তু স্বভাব যায় না মলে। বিজয় একটু চাঙা হয়েই দ্বীপবাসীদের ওপর উৎপাত শুরু করলেন। মদত দিল তাঁর চ্যালাচামুণ্ডারা। কিন্তু এটা তো আর বিজয়ের বাবার রাজত্ব নয়, আর বাবা নিজেই যখন তাঁকে রাজ্যছাড়া করেছেন, তখন পরের দেশ আর কতটা সহ্য করবে! তাই বিজয়কে মানে মানে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ছাড়তে হল সেই জায়গা।
তারপর আবার জাহাজে করে সমুদ্রে ভেসে পড়া, আবার নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা। এবার জাহাজ চলতে লাগল দক্ষিণ দিকে। এদিকে রসদ ফুরিয়ে আসছে, সামনে জল আর জল ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। এইভাবে অনেকদিন চলার পর অবশেষে ডাঙা দেখা গেল। সেটা ছিল রাবণের লঙ্কাদ্বীপ বা তাম্রপর্ণী, সেখানে তখন যক্ষরাজ মহাকালসেনার রাজত্ব। বিজয় সিংহের জাহাজ ঠিক যেদিন তাম্রপর্ণীতে গিয়ে ভিড়ল, বৌদ্ধশাস্ত্র অনুযায়ী সেই দিনটাতেই উত্তর ভারতের কুশীনগরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন গৌতম বুদ্ধ। বিজয় তো নতুন দেশে এলেন, কিন্তু সেখানকার রাজা তাঁর আগমনকে খুব একটা ভালো চোখে নিলেন না। কিন্তু রাজার মেয়ে কুবেণী আবার বিজয় সিংহের প্রেমে হাবুডুবু। এই কুবেণীর সাহায্যেই যক্ষরাজকে হত্যা করে বিজয় তাম্রপর্ণীর রাজা হয়ে বসলেন। কুবেণীকে বানালেন নিজের রানি। তাঁদের দুই সন্তান হয়। তাম্রপর্ণীর নাম পাল্টে নিজের বংশের নামে দেশটার নাম রাখলেন সিংহল।
তবে কুবেণীর জীবনে দুর্ভোগ ঘনিয়ে এল খুব তাড়াতাড়ি। বিজয় সিংহ তাঁর নতুন রাজত্বের জন্য এক ক্ষত্রিয় পাটরানি খুঁজছিলেন, যক্ষের মেয়েকে তিনি মন থেকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। তাই মাদুরাইয়ের পাণ্ড্য রাজার মেয়েকে বিয়ে করলেন আর তাড়িয়ে দিলেন কুবেণীকে। কুবেণী তখন নিজের দুই সন্তানকে নিয়ে মনের দুঃখে যক্ষদের কাছে ফিরে গেলে যক্ষেরা তাঁকে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য খুন করে ফেলল। বিজয় সিংহ আটত্রিশ বছর রাজত্ব করার পর মারা গেছিলেন কোনো উত্তরাধিকারী ছাড়াই। তাঁর মৃত্যু হলে সিংহল রাজ্যে প্রবল বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। অবশ্য মৃত্যুর আগে বিজয় একটা চিঠি লিখেছিলেন সিংহপুরে তাঁর যমজ ভাই সুমিত্তকে, সিংহলের শাসনভার গ্রহণ করার অনুরোধ জানিয়ে। ততদিনে সুমিত্ত সিংহপুরের রাজা হয়েছেন, বৃদ্ধও হয়েছেন যথেষ্ট, তিনি নিজের ছোটো ছেলে পাণ্ডুবাসুদেবকে সিংহলে পাঠিয়ে দিলেন। পাণ্ডুবাসুদেব গিয়ে তারপর ভার নেন সিংহল রাজ্য শাসনের। তাঁদের রাজবংশ তারপর সিংহলে ছশো বছর রাজত্ব করেছিল।
`(ছবি দুটি অজন্তার গুহাচিত্র থেকে নেওয়া। প্রথমটি সিংহল দ্বীপে বিজয় সিংহের অভিষেকের ছবি। দ্বিতীয়টিতে রয়েছে লঙ্কা বা সিংহলে বিজয় সিংহের প্রথম আগমনের দৃশ্য।)
তথ্যসূত্র – বৃহৎ বঙ্গ, দীনেশচন্দ্র সেন; প্রাচীন বাংলার গৌরব, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী; মুক্তমনা ব্লগ; তুলি কলম ব্লগ।