No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    নিঃশব্দে ভেঙে যাচ্ছে উচ্চবর্ণের সর্বগ্রাসী আধিপত্য

    নিঃশব্দে ভেঙে যাচ্ছে উচ্চবর্ণের সর্বগ্রাসী আধিপত্য

    Story image

    একটা কথা খুব চালু আছে। আমাদের বাংলায় জাতপাত নেই। মন্ডল কমিশনের রিপোর্ট রূপায়িত হয়ে যাওযার পরেও গত শতাব্দীতে এ রাজ্যের শাসকেরা, যাঁরা প্রায় সকলেই ছিলেন উচ্চবর্ণের (অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য), রাজ্যে অনগ্রসর জাতি খুঁজে বার করতে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। ওড়িশার বিজু পট্টনায়কও মন্ডল কমিশনের রিপোর্ট রূপায়ণে আগ্রহী ছিলেন না এই একই কারণে। পরে অবস্থা কিছুটা বদলায়। আর এখন মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের স্থানাধিকারীদের তালিকায় চোখ বোলালে বোঝা যাচ্ছে, ব্রাহ্মণ–কায়স্থ–বৈদ্যদের আর্থ–সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ ভেঙে পড়ছে। জাতপাতের নাম–পরিচয় নিয়ে বিশদ আলোচনায় না গিয়ে এটুকু বলা যথেষ্ট, এমন সব পদবি এখন মেধা–তালিকায় উঠে আসছে, যা আগে চোখে পড়ত না। অর্থাৎ একটা আর্থ–সামাজিক পরিবর্তন ঘটছে, যার প্রতিফলন ভবিষ্যতে সাহিত্যে–শিল্পে বা উচ্চস্থানীয় সরকারি–বেসরকারি চাকরিতে দেখা যাবে।

    জাতপাতের নাগপাশ দুভাবে কোনও সমাজকে পিষ্ট করতে পারে। প্রথমটা খুব সহজে চোখে দেখা যায়, কারণ সেখানে কাজ করে ভয়, জুলুম, অনুশাসন না মানলে শাস্তি ইত্যাদি। বিহার–উত্তরপ্রদেশ এক সময় ঠিক এমনই ছিল। এর একটা চরম উদাহরণ হল কোনও উচ্চবর্ণের মানুষ রাস্তা দিয়ে গেলে দলিতদের (যাঁদের চার বর্ণের এবং গ্রামের বায়রে রাখা হয়েছিল) সরে দাঁড়াতে হবে এমন জায়গায় যাতে উঁচু মানু্ষটির ছায়া তার শরীরকে স্পর্শ না–করে। সরে না–দাঁড়ালে শাস্তি পেতে হোত, এবং তার মাত্রাও ছিল ভিন্ন ভিন্ন রকমের। যাঁদের এখন বলা হয় অনগ্রসর জাত অতীতে তাঁদের বলা হোত শূদ্র। এই অনগ্রসরেরা চুল আঁচড়ালে তাঁদের বিদ্রুপ বা চড়–থাপ্পড়ের মুখে পড়তে হোত। লালু প্রসাদকেও ছোটবেলায় পড়তে হয়েছিল। বিহারে এই ভূমিহার–রাজপুত–ব্রাহ্মণ–লালার আর্থসামাজিক নিয়ন্ত্রণ ভাঙার চেষ্টা হয়েছে অনেক দশক ধরে। একশো বছর আগে সেখানে যাদব, কুর্মি, কৈরি, এই তিন অনগ্রসর জাত মিলে তৈরি করেছিল ‘ত্রিবেণী সঙ্গম’ নামক সংগঠন। কমবয়সী জগজীবন রাম একটি হরিজন সংগঠনের নেতা ছিলেন। স্বাধীনতার পর রামমনোহর লোহিয়ার নেতৃত্বে সমাজবাদীরা অনগ্রসরদের জন্য শিক্ষা ও চাকরিতে ষাট শতাংশ সংরক্ষণের দাবি তুলে সাড়া ফেলেছিলেন পুরো উত্তর ভারতে। নকশাল আন্দোলন একটা সময়ে ভূমিহারদের অত্যাচার প্রতিরোধ করতে নেমেছিল। আর সবশেষে লালু প্রসাদ, নীতীশ কুমারেরা ক্ষমতায় উঠে আসার পর তথাকথিত উঁচু জাতের নিয়ন্ত্রন পুরোপুরি ভেঙে যায়। পরিবর্তে অবশ্য একটা সময়ে তৈরি হয় যাদবদের রাজনৈতিক–সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, যার দৌলতে বেশ কিছুটা অরাজকতাও তৈরি হয়েছিল।

    একই ধরণের জাতপাত ব্যবস্থা তামিলনাড়ুতে ভেঙে যায় দ্রাবিড় রাজনীতিক প্রভাবে। কেরলে পরিস্থিতি পাল্টায় বামপন্থী সমাজ সংস্কারকদের চেষ্টায়। মহারাষ্ট্রের মারাঠারা, গুজরাতের পাতিদারেরা (যাঁরা কিছুদিন আগে হার্দিক পটেলের নেতৃত্বে আন্দোলনে নেমে সাড়া ফেলেছিলেন), হরিয়ানার জাঠেরা উচ্চবর্ণের না–হওয়া সত্বেও নিজের নিজের রাজ্যে প্রভাবশালী। ফলে ওই সব রাজ্যে উচ্চবর্ণের প্রভাব স্তিমিত হয়ে গিয়েছে। ভোটের সমীকরণও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছে। কর্ণাটকের দুই প্রধান জাত ভোক্কালিগা বা লিঙ্গায়েতরা কেউই সনাতম ধর্ম অনুযায়ী উচ্চবর্ণ নয়। কিন্তু তারাই রাজনীতি–অর্থনীতির বড় নিয়ন্ত্রক শক্তি। অর্থাৎ, পুরো দেশে উচ্চবর্ণের প্রভাব ভাঙতে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক নেতারা একটা বড় ভূমিকা নিয়েছেন। রাজস্থানের মতো যেখানে সেই ধরণের রাজনীতি হয়নি, সেখানে আজও উঁচু জাতের আধিপত্য রয়েছে।

    >পশ্চিমবঙ্গেও রয়েছে। কিন্তু বিশ–পঁচিশ বছর আগে ব্রাহ্মণ–কায়স্থ–বৈদ্য নিয়ন্ত্রণ যতটা সর্বগ্রাসী ছিল আজ ততটা নেই। এই তিন জাতের বায়রে কেউ এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হননি। এমনকি বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বোচ্চ কর্তা বা প্রথম সারির নেতাদের মধ্যেও এই জাতগুলোর রমরমা। তার বাইরে, সাহিত্য–শিল্প–সংস্কৃতি–সংগীত ইত্যাদি ক্ষেত্রে উচ্চবর্ণের আধিপত্য সর্বগ্রাসী। উঁচু জাতের বাইরের নাম খুঁজতে হয় দূরবিন দিয়ে। রামকিঙ্কর নেহাতই ব্যতিক্রম। সাংবাদিকতার জগতেও গত শতাব্দী পর্যন্ত উচ্চবর্ণ ছাড়া নাম খুঁজে পাওয়া যেত না। বড় চাকরিতে, তা সরকারি বা বেসরকারি যাই হোক, বাঙালির বৃত্তে উচ্চবর্ণের বাইরে লোক ছিল না। তাই, নিচের তলার মানুষ কেমন আছেন, কীভাবে আছেন, তার প্রতিফলনও আর ঘটে না বাঙলা সাহিত্যে, নাটকে, সিনেমায়। কোনও বলপ্রয়োগ, চোখরাঙানি ছাড়াই উচ্চবর্ণের কী ভয়ঙ্কর দখলদারি কায়েম হতে পারে, হিন্দু বাঙালি সমাজ তার সব থেকে বড় উদাহরণ। সেই কারণেই মেধা তালিকায় এই দখলদারির বৃত্তের বাইরে থাকা নামগুলো খুব স্বস্তিদায়ক।

    কীভাবে ঘটছে এই পরিবর্তন? একটাই ব্যাখ্যা। অপারেশন বর্গা থেকে শুরু করে এখনকার সরকারের নানা সামাজিক প্রকল্পের নিটফল এই পরিবর্তন। আর এই প্রক্রিয়াকে সাহায্য করছে ইন্টারনেট যুগের প্রযুক্তি। অর্থাৎ, এ কথাই প্রমানিত হচ্ছে, গণতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষমতা এতটাই যে সামাজিক বা রাজনৈতিক সংঘাত ছাড়াই তা বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। এখন এই পরিবর্তন কত দ্রুত কত দূর ছড়িয়ে পড়ে, তার অপেক্ষায় থাকতে হবে।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @