No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘বাংলা’র সুর

    প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘বাংলা’র সুর

    Story image

    কয়েকদিন আগে রাজ্যের বিধানসভায় ‘পশ্চিমবঙ্গ’-র নাম পালটে বাংলা, ইংরেজি এবং হিন্দি তিনটে ভাষাতেই ‘বাংলা’ করার প্রস্তাব পাশ হল। বহুদিন আগে ১৯৯৩ সালে প্রতুল মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন– “আমি এই বাংলার মায়াভরা পথে হেঁটেছি এতটা দূর”; তা-ই যেন সরকারি স্বীকৃতি পেল। কিন্তু প্রচারবিমুখ শিল্পী কিন্তু এসব নিয়ে নীরব। এই নীরবতাই তাঁর অভিমান। সে অভিমান যতই থাকুক, প্রতুল মুখোপাধ্যায় কিন্তু এখনও সমাজ-বিমুখ নন, রাজনীতি-বিমুখ নন। ক্ষোভ-যন্ত্রণা সত্ত্বেও তিনি মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। অসমে জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকরণে সেখানকার বাঙালিদের নিজভূমে পরবাসী হওয়ার পরিস্থিতিতেও পশ্চিমবঙ্গবাসীর যে বড়ো অংশ নিষ্ক্রিয়, তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে এই কলকাত্তাইয়া বাউল লিখে ফেলেন চাবুকের মতো ছড়াটি:

    “রাজ্যের নাম বাংলা হবে
    মুখে ফুটছে হাসি
    পাশের রাজ্যে বাংলাভাষী
    হচ্ছে কারাবাসী।
    বাংলাভাষী হলেই তোমার 
    প্রমাণপত্র চাই
    নইলে তুমি এদেশে নও 
    ক্যাম্পে তোমার ঠাঁই।
    ডিটেনশন ক্যাম্প মানে 
    আকাশ তলে জেল
    প্রমাণপত্র খোয়া গেলেই
    পরীক্ষাতে ফেল।
    তিন প্রজন্ম আছো হেথায়
    তা বেশ তা বেশ
    প্রমাণ তো নেই
    এবার তোমার 
    মেয়াদ হল শেষ
    যাক গে ওসব ভেজাল কথা,
    হাতে তাড়াও মাছি
    ও ঝামেলা এরাজ্যে নেই,
    আমরা ভালোই আছি”।

    প্রবীণ সুরসাধক যিনি শুধুমাত্র শিল্পের খাতিরে গান বাঁধেন না, সংগ্রামের হাতিয়ার করে তাকে গেয়ে বেড়ান রাস্তায়-ঘাটে-জনসভায়-প্রতিবাদসভায়, সেই প্রতুল মুখোপাধ্যায় জীবনের ৭৬টি বসন্ত পার করেও রয়ে গেলেন ‘একক’। আজও দুই বাংলার বহু রাজনৈতিক কর্মী তাঁকে গণসঙ্গীত শিল্পী হিসেবেই চেনে। অথচ গণসঙ্গীত বলতে আমরা বুঝি একসাথে অনেকের গান, একসাথে অনেকের জন্য গাওয়া গান এবং অবশ্যই সবরকম নির্যাতন আর শোষণের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের জেগে ওঠার গান – প্রতুল মুখোপাধ্যায় তাঁর গায়কিতে দ্বিতীয় আর তৃতীয় শর্তটি পালন করলেও প্রথমটির ক্ষেত্রে সবসময়েই তিনি ব্যতিক্রম। একা একা গান গাওয়াতেই তিনি স্বচ্ছন্দ। সেই দিক থেকে তিনি নিজেই গণসঙ্গীতের একটি স্বতন্ত্র্য ধারা লালন-পালন করে আসছেন এখনও। তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা অনুযায়ী, “একক গানে অনুভব সঞ্চারের জন্য এমনকিছু কাজ করতে পারি, যা সমবেত গানে শোনানো সম্ভব নয়, গানকে কখনো কথার কাছাকাছি নিয়ে আসা, নাটকীয়তার প্রয়োজনে সামান্য বিরতি, গানের মধ্যে কথা বলে আবার গানে ফিরে আসা, কথার প্রয়োজনে সামান্য হেরফের করা (voice inflexion), আওয়াজের হেরফের, কণ্ঠের মডিউলেশন (modulation) – এবং আমি যেটা করি, সারা শরীর দিয়ে গান করা – তা সমবেত গানে সম্ভব হত না”।

    ওঁর কথাটিকে যদি আমরা মন দিয়ে পড়ি, তাহলে বুঝতে পারব, কেন তিনি গানের সাথে বাজনার মূর্চ্ছনাকেও মেশাতে চান না। যেখানে তিনি সমস্ত শরীর-মন-কণ্ঠ দিয়ে শ্রোতার সাথে যুক্ত হতে চান, ভিন্ন কণ্ঠের উপস্থিতির মতোই বাদ্যযন্ত্রও সেই সংযোগের পক্ষে বোঝা – অন্তরায়। তাই গানের আসনে তিনি শুধু কণ্ঠে এককই নন, মঞ্চেও একক। অথবা মঞ্চ যদি নাও থাকে, সবার মাঝখানে সমতলে দাঁড়িয়েও তিনি নিঃসঙ্গ সম্রাট। অন্য কোনো গায়ক থাকবে না, বাজনাদার থাকবে না, গাইতে গাইতে তিনি একাই আসরকে শাসন করবেন। এই শাসনের মধ্যে কিন্তু রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচার খুঁজলে বড়োই ভুল করা হবে, এখানে কোনো একনায়কতন্ত্র নেই, আছে শিল্পীর স্পর্ধা। একক শিল্পীই মহাদেব হয়ে জনগণেশের জন্য বিষপান করেন – যুগ যুগ ধরে এটাই হয়ে এসেছে। 

    আত্মভোলা শিল্পী তাঁর দুঃখ যন্ত্রণাকে হাসিমুখে এড়িয়ে যান, তা বলে কি শ্রোতাদের প্রতি তাঁর সত্যিই কোনো অভিমান নেই? নেই গায়কের প্রাপ্তি নিয়ে কোনো যন্ত্রণা? নইলে তিনি শ্রোতাদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও কেন গেয়ে শোনাতে চান না তাঁর সব থেকে বিখ্যাত, সব থেকে বহুল প্রচলিত গান, “আমি বাংলায় গান গাই” বরং তিনি বরং এই গানের অনুরোধে বিরক্ত হয়ে ওঠেন? কেন তিনি বলেন, “বিষয়টি এমন যে, যেন এই গান ছাড়া আমার কোনো গান নেই। ‘আমি বাংলায় গান গাই’ ছাড়াও দেশাত্মমূলক ও শিক্ষামূলক আমার শত শত গান রয়েছে”। এই অভিমান কিন্তু কোনোভাবেই মিডিয়ার প্রতি নয়, একেবারেই সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর এই ক্ষোভ। যিনি সময়ের প্রয়োজনে কুসুমকুমারী দাশের লেখা কবিতায় সুর দিয়ে গাইতে গাইতে “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে”-র পর নিজে থেকেই আরেক লাইন যোগ করে দেন, “আমাদের দেশে হবে সেই মেয়ে কবে”, তাঁর এই অভিমান অত্যন্ত সংগত। 

    মাত্র বারো বছর বয়সে নিজে সুর দিয়ে তিনি গেয়েছিলেন মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা, “আমরা ধান কাটার গান গাই, লোহা পেটানোর গান”। প্রথাগত গানের প্রশিক্ষণ কোনোদিনই নেননি, তা সত্ত্বেও ‘সঙ্গীতম্‌’ নামের এক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননা পেয়েছেন, যে সম্মাননা আগে দেওয়া হয়েছিল ভি জি যোগ কিংবা প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সঙ্গীতজ্ঞদের। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক, ইউনাইটেড ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার স্ট্যাটিসটিক্স অ্যান্ড লং রেঞ্জ প্ল্যানিং বিভাগের সাবেক প্রধান ব্যবস্থাপক প্রতুল বাবুর আরও প্রচুর ভালো গান আছে যেগুলো বারবার শ্রোতাদের মন শুধু ছুঁইয়ে যায় না, তাঁদের নতুন করে ভাবতে শেখায় জীবন ও পৃথিবী সম্পর্কে।  “আলু বেচো, ছোলা বেচো”, “ডিঙা ভাসাও সাগরে”, “জন্মিলে মরিতে হবে”, “খোকন দিল সাগর পাড়ি” এই গানগুলো যেন শ্রোতাদের সামনে আয়না খুলে ধরে, সেই আয়না, যার সামনে দিনের শেষে প্রত্যেকটা মানুষকেই দাঁড়াতে হয়। ষাটের দশকে সত্তরের দশকে যাঁর গান নকশাল আন্দোলনে মানুষের মুখে মুখে ফিরত, আজ সেই মানুষটির পরিচয় শুধু একটিমাত্র গানেরই জন্য, এর থেকে বড়ো ট্র্যাজেডি কিছু হতে পারে কি? আবার সেই “আমি বাংলার গান গাই” বাংলাদেশের মাহমুদুজ্জামান বাবু নিজের নামে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। শিল্পী নীলকণ্ঠ বলেই হয়তো এত যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেন। 

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @