No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    জাগায়ে মাতন ঢেউয়ের নাচন মরণ বাঁচন একাকার

    জাগায়ে মাতন ঢেউয়ের নাচন মরণ বাঁচন একাকার

    Story image

    য়দানী বইমেলার মাইকে আঙ্গুরবালার মজলিশি কণ্ঠে বাজছে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর লেখা ও সুরারোপিত ব্রহ্মসংগীত ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা’; প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সিনেমার গান হিসেবে জনপ্রিয় হওয়ার সময়ে যার স্রষ্টার নাম ছিল না। সেই সন্ধ্যায় আঙ্গুরবালার কণ্ঠ মিলিয়ে গিয়ে নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা শোনা যায়, যেভাবে ভুবনায়িত অত্যুজ্জ্বল বিশ্বে নিরুদ্দিষ্ট গত শতকের নয়ের দশকের পূর্ববর্তী থতমত কলকাতা তথা বাংলা তার প্রায় সমস্ত অনুষঙ্গ সমেত।

    কঠিন কোনও রূপকের আশ্রয়ে নয়, নেই বুদ্ধির খেলা, স্মার্ট নাগরিক বাচনে নয়, উইটের দীপ্তির দায় রাখেনি গান, বরং সরাসরি কথা বলছে গান তার শ্রোতাদের সঙ্গে। নির্দিষ্ট শ্রোতা সে গানের। সার্বজনিক হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেই সেই গান।

    ভিড়ভাট্টার বৃত্তের থেকে দূরে মেলার অন্ধকারের মধ্যে একটি ক্ষীণপ্রাণ লাইটপোস্টের নিচে এক খর্বকায় প্রবীণকে ঘিরে কয়েকজন সদ্যযুবা ছেলে-মেয়ে। শীর্ণ চেহারার মানুষটি গান গাইছেন। ক্রেমলিন থেকে নেমে গেছে লাল পতাকা; দ্বিতীয় বিশ্বের অনুপস্থিতিতে আর্থার ডাঙ্কেলের প্রথম বিশ্বের প্রস্তাব গৃহীত হয়ে গেছে ক্রমহারা তৃতীয় বিশ্বে, জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ আন্তর্জাতিকতার বিপ্রতীপে এনেছে বিশ্বায়ন। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার বদলে তৃতীয় বিশ্বকে চক্রব্যূহে ঘিরে ফেলেছে ভুবনগ্রাম। আগেই ওই যুবক যুবতীরা শুনে ফেলেছে গণনাট্য থেকে গণবিষাণ, শুনে ফেলেছে সুমনের গান, শুনে ফেলেছে আবার বছর কুড়ি পরে মহীনের সংকলন, সাক্ষী থেকেছে মহীনের অনুষ্ঠানে আগ্রহীদের ভিড়ের চাপে সরকারি শিশির মঞ্চের ভেঙে যাওয়া কাচের দরজার।

    এতদসত্ত্বেও সেই খর্বকায় পুরুষ, চোখের কোণে ঝলকানো হাসি বুজে আসে কখনও গাইতে গাইতে, চুলের ফাটলের শেষভাগ দোলে তালে তালে, খাদির পাঞ্জাবি, ঈষৎ নাকি স্বরের সহসা গহন ঘন থেকে তরলে উত্থান, উচ্চারণে স্পষ্ট কিন্তু ম্যানারিজমে বিশিষ্ট, যন্ত্রানুষঙ্গের অনুপস্থিতি বিচিত্র স্বরক্ষেপণের হামিং সাউন্ডের সঙ্গে গায়কের তুড়ি আর তালিতে— বস্তুত সামগ্রিক শারীরিক উপস্থিতিতে এমনভাবে ভরাট হয়েছে যে পরবর্তীকালে ক্যাসেটে দোতারার ধ্বনি, গিটারের তাল আর ইলেকট্রনিক্স পিয়ানোর বেস যেন অরিতিক্ত হয়ে বেজেছিল সাক্ষাৎ শোনা কানে; চোখে অভাব বোধ হয়েছিল পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রার অ্যারেঞ্জমেন্টের মতো হাতের সঞ্চালন। চাক্ষুষ অনুপস্থিত ছিল সেই একলা মানুষের সেনাদল। প্রতুল মুখোপাধ্যায়।

    যাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের অনুষ্ঠানে আপনি বারবার গাইতে যাবেন এর পরে। একটি পয়সাও নেবেন না ছাত্রদের থেকে, নেবেন না আসা যাওয়ার গাড়ি বা ভাড়া। নিজেই চলে আসবেন ব্যাঙ্কের চাকরি সেরে। কিছুই খাবেন না আপনি কেবল এককাপ লাল চা ছাড়া

    ‘রক্তচোষার উসকানিতে জনতার দুশমনিতে সারা জনম গেলে কেটে মরণ যদি আসে...’ গাইছেন তিনি। মূল কীর্তনাঙ্গের সুরের চলনে বইছে গান। এইখানে এসে তুড়ি দিয়ে তাল রাখছেন তিনি, ঘিরে বসা যুবক যুবতীরা হাতে রাখছে তাল। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করা সেইসব ছেলেমেয়ের বুকে চলকে উঠছে রক্ত। মুখ থমথমে। কঠিন কোনও রূপকের আশ্রয়ে নয়, নেই বুদ্ধির খেলা, স্মার্ট নাগরিক বাচনে নয়, উইটের দীপ্তির দায় রাখেনি গান, বরং সরাসরি কথা বলছে গান তার শ্রোতাদের সঙ্গে। নির্দিষ্ট শ্রোতা সে গানের। সার্বজনিক হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেই সেই গান। এর পরে ‘ওরে, সেই মরণের ভারে’র সঙ্গে যখন পাখির পালকের তুলনা করবেন তিনি তখন ‘ওরে’ শব্দে মিশে যাবে আপোষকামীর প্রতি এক তীক্ষ্ণ তাচ্ছিল্য। আবার ‘জীবন উৎসর্গ করে সবহারা জনতার তরে মরণ যদি হয়’ উচ্চারণের সময় ‘হয়’ শব্দে মিশে যাবে অপেরার মতো দীর্ঘ তীব্র তীক্ষ্ণ সুরকম্পন। সাথী সহযোদ্ধার মৃত্যুবেদনা যেন তরঙ্গবাহিত হয়ে বিদ্ধ করবে সেকালের ভুবনায়িত বিশ্বকে অস্বীকার করতে চাওয়া রক্তিম যৌবনের হৃদয়কে। ‘দুশমনে রুখিতে তোর এক পুত্র দিল প্রাণ, মা...’ ‘প্রাণ’ শব্দটি যখন উচ্চারণ করেন তিনি, তখন তা যেন ভেঙে ভেঙে ভেসে যায় দীর্ঘ হাহাকারের সঙ্গে অতীতকালের থেকে অনাদিকালের সমস্ত অকাল প্রয়াতের জন্য, রুশ বিপ্লব থেকে তেভাগা হয়ে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ পেরিয়ে আরও আরও অকাতর আত্ম বলিদানের দিকে। আর তারপরে ‘মা’ ধ্বনি মধ্যমে যেন তার নিজস্ব রংশুভ্রতার মধ্যে দিয়ে পরিত্রাণহীন শোকের দিকে ভেসে চলে। অনন্তকাল ধরে। তাতেও কি নেই বিপ্লবের নামে কাপালিকের নৃমুণ্ড সাধনার ধারা! শ্রেণিশত্রুর নামে স্বশ্রেনির নিধনও। যেভাবে কলোনির মিষ্টির দোকানের সামনের ফাটলধরা চুনি-জনা-তপন লেখা শহিদ বেদী ধুইয়ে দিতে আসতেন সাদা থান পরা এক বিধবা গত শতকে, প্রতিদিন নিয়ম করে। তার মধ্যে একটিই কি তার ছেলে ছিল! নাকি তিনটিই! কোনোদিন ভুল হত না। সেভাবে ভেসে যায় প্রাণের উচ্চারণের তান। ‘ধন্য বীরমাতা বীর পুত্র গরবিনী আমার মা’— এই ‘আমার মা’ অংশটুকু বারে বারে ফিরে ফিরে উচ্চারিত হতে থাকে পরপর। যদি কেউ এখনও ঠোঁটচাপা নাগরিক পরিশীলনের বাইরে গ্রামীণ নারীর শোকের কান্না শুনে থাকেন তাহলে অনেক বেশি বোধগম্য হবে ওই সুরটানা কান্নার সঙ্গে এই সুরারোপের সাদৃশ্যের, আর প্রায় প্রতি নির্বাচনে গ্রামীণ কিশোর যুবকের অপ্রয়োজনীয় মৃত্যুর পরে চ্যানেলের বুম হাতে অসহায় সাংবাদিকের ক্যামেরার সামনে সন্তানহারা মায়ের সুরটানা ‘বিচার চাই’ আছাড়ি পিছাড়ির সঙ্গে আমাদের কারই বা পরিচয় নেই বলুন এই বাংলায়! তিনি কেবল শক্তি স্বরূপিনী হয়ে উঠতে পারেন না... যেমন বিশ্বায়িত দুনিয়ায় হারিয়ে গিয়েছেন সেই সাদা থানের বিধবা। মিষ্টির দোকান চলে গেছে নতুন ওঠা ফ্ল্যাটের নিচে, বাস্তবে ওই শহিদ বেদীর ওপরে, তার কংক্রিট ভিতের নিচে মাটির তলায় পুরনো কলোনির দরমার ভিটের সঙ্গে লেপটে আছে চুনি-জনা-তপনের কাঁচা রক্ত। চেরাবান্দারাজু প্রথম ভারতীয় ভাষা হিসেবে তেলেগুতে অনুবাদ করেছিলেন মাও সে তুংয়ের লং মার্চের কবিতা। মার্চিং সংয়ের সুরে ঢালা সেই অনুবাদের বঙ্গীকরণ ‘কীসের ভয় সাহসী মন লাল ফৌজের’। সতত যদিও অনুষ্ঠানে সে কথা উল্লিখিত হত না। যেমন উল্লিখিত হত না শিশুশ্রমের তুলনারহিত বাংলা গান ‘এ মহাভারত দাদা এ মহাভারত / মাছের মতোই আছে শিশুর আড়ত / জ্বালানির মতো আছে শিশুর জোগান / মহাভারতের কথা অমৃতসমান’— এর মূল ছড়াকার অমিত মণ্ডলের নাম। সেসব অনেক পরের কাহিনি; তখন বইমেলায় ভিড়ের থেকে দূরে তিনি শিহরিত করছেন একদল যুবক যুবতীকে।

    যাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের অনুষ্ঠানে আপনি বারবার গাইতে যাবেন এর পরে। একটি পয়সাও নেবেন না ছাত্রদের থেকে, নেবেন না আসা যাওয়ার গাড়ি বা ভাড়া। নিজেই চলে আসবেন ব্যাঙ্কের চাকরি সেরে। কিছুই খাবেন না আপনি কেবল এককাপ লাল চা ছাড়া। গান চলবে, গানে ডুবে যাবেন আপনি। ডুবে যাবেন আপনার সৃষ্টিতে; বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রজন্ম মুগ্ধ হয়ে শিখবে বুদ্ধিজীবী বলেও কেউ কেউ থাকে, তাঁকে কোনও নির্দিষ্ট দল করতে হয় না— একটা মতাদর্শকে দৃষ্টি আর সৃষ্টি দিয়ে জীবন্ত করে তুলতে পারেন তাঁরা। ‘ও... ও... ও... ডাঙ্গার টানে পরান ছিল বাঁধা কেন রে ছিল বন্ধু এতকাল, ছিল পরান বাঁধা এতকাল’ তিনি গাইছেন চোখ বুজে। ঋজু মেরুদণ্ড। কনুয়ের পর থেকে আঙুলের ডগা অবধি টানটান আকাশের দিকে। বিশ শতকের আকাশ। ভাঙা মসজিদের পরেও এক মানবিক অভিযাত্রার স্বপ্ন দেখা ভারতের আকাশ। কল্যাণকামী রাষ্ট্রের মৌল দায়িত্বগুলি থেকে তখনও হাত গুটিয়ে নেয়নি রাষ্ট্র অথবা শিক্ষা স্বাস্থ্য খাদ্য বাসস্থানের মত নাগরিকের মৌল চাহিদাগুলি দুর্নীতির আখড়া হয়ে যায়নি তখনও, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পরস্পর ভরসার বনেদ ক্ষয়ে যায়নি সম্পূর্ণ। তখনও গরজি গুমরি উথালপাতাল তরঙ্গ ডাক দিত, তার মধ্যে আপনার গানে পাল তুলে, হাতে হাল ধরে দুস্তর সাগর পার হওয়ার স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়েছিল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের মধ্যে। রাত্রিযাপনের পরে পুবের আকাশ রাঙা হয়ে আসার সঙ্গে ডিঙা ভেসে যাওয়ার ঢেউয়ের তালে তালে সেই আলো আঁধারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাত ভেসে গিয়েছিল।

    কাঁকুড়গাছির মোড়ের সান্ধ্য অফিস ফেরতা বাবু থেকে দল বেঁধে পড়তে যাওয়া ছেলেমেয়েরা একদিন দেখেছিল এক প্রবীণ মানুষকে ঘিরে আরও কিছু ছেলেমেয়েকে— সিআইটি রোডের অজস্র গাড়ির আওয়াজ ছাপিয়ে অরুণ মিত্রের কবিতার সাংগীতিক তরজমায় পঙক্তির শেষে তিনবার ‘হা হা’ তিনরকম ভাবে আছড়ে পড়ে শ্রোতাদের কানে। ‘আমি এত বয়সে গাছকে বলছি তোমার ভাঙা ডালে সূর্য বসাও হা হা’, ‘অন্ধকার হয়েছে আর আমি নদীকে বলছি তোমার মরা খাতে পরী নাচাও হা হা’, ‘আমি মাদারির মতো হেঁকে বলছি এই আওয়াজ হয়ে যাবে এক মাঠ ধান হা হা’। প্রথম দুই ‘হা হা’তে এতটা বয়সে আশ্চর্য চাহিদার জন্য হাসিতে মেসে আত্ম ব্যঙ্গ, শেষ ‘হা হা’তে তা হয়ে দাঁড়ায় আশ্চর্য এক কান্না, কারণ তিনি খরার মাটিতে হেঁটে চলেছেন রক্ত পায়ে যাতে দুয়েকটা বীজ ভিজে ওঠে সেই রক্তে। গানের মধ্যে, তার সুরের মধ্যে, গায়কির মধ্যে যে নাটকীয়তা বুনে দিতে পারেন তিনি তা জনবহুল সিআইটি রোডকে করে তুলতে পারে সেই নিসর্গ যেখানে হাড় বাজানো চলে— ডাক দেওয়া যায় মাদারির মতো এক মাঠ ধানের। রাজপথ খালি হয়ে আসে আড়াই দশকের আগের রাত বাড়লে। ন্যাংটো ছেলেকে আকাশে হাত বাড়াতে দেখা যায় ফুটপাথে জোছনা লাগলে।

    বিতর্কটা বারবার জেগে ওঠে। বিশেষত তেমন শিল্পী সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে যাদের শিল্পকর্মে এক ধরনের সমাজ সচেতনতার ছাপ থাকে; থাকে এক গণমুখী চরিত্র। প্রায়শই তার সঙ্গে বামদক্ষিণ রাজনৈতিক অবস্থান সংক্রান্ত প্রশ্ন যে উঠে আসে তা আজকে থেকে নয়। এর শিকড় খুঁজতে গেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে পৌঁছতে হবে যেখানে ফ্যাসিবাদের পক্ষে বিপক্ষে স্পষ্ট শিবির বিভাজন হয়ে হয়েছিল। ন্যুট হামসুং থেকে সালভাদর দালি বহু বিখ্যাত সৃষ্টিশীল মানুষকে নিয়ে এই প্রশ্ন আছে।আছে ক্রিসচ্যানিটি প্রশ্নে খোদ ডিলানের অবস্থান নিয়েও। সারা পৃথিবীর সঙ্গে ভারতে একসময় শিল্পী সাহিত্যিক নট নাট্যকার বুদ্ধিজীবিরা একত্রিত হয়েছিলেন বামপন্থী দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে। আবার একসময়ে নানা কারণ বশত তাঁরা ছড়িয়ে গিয়েছেন। এখানে উল্লেখ্য বহু অগ্রগণ্য সমাজ সচেতন সৃষ্টিশীল মানুষ সেই বৃহৎ বামবৃত্তের অন্তর্গত হননি কোনোদিন, কিন্তু তথাকথিত অবাম বৃত্তে থেকেও সাধারণভাবে প্রগতিভাবনার শরিক ছিলেন তাঁরা। খুবই উল্লেখযোগ্য সতীনাথ ভাদুড়ী। বিতর্ক তাঁদের নিয়ে ওঠেনি। বিতর্ক ওঠে না কমিউনিস্ট পার্টির বহুধাবিভক্তির পরেও বামরেখার বাম-মধ্য-দক্ষিণের অবস্থান নিয়েও, অন্তত বিগত শতকেও তা তেমন প্রবল হয়নি। প্রশ্ন ওঠে বাম বা অতিবাম থেকে অতি দক্ষিণের চলনে। আরও স্মরণীয় এই যে বাম অতিবাম অবস্থান তাও যে সরাসরি দলীয় এমনও নয়— এই চলনের ইতিহাসে কেউ কেউ যেমন সরাসরি বামমধ্যদক্ষিণ নির্ণীত বামরেখায় ছিলেন তেমনই কেউ কেউ কখনোই সেই রেখায় অবস্থান না করলেও সমাজ সচেতনতার ক্ষেত্রে তাঁদের সৃষ্টিকর্ম সেই মতাদর্শের কাছাকাছি থাকায় তাঁদের সেই বামবৃত্তের অন্তর্গত করে দেখার প্রবণতা আছে এবং উল্লেখ্য যে সেই বৃহত্তর বাম বা তথাকথিত সমাজসচেতন বৃত্ত থেকেই সেই শিল্পকর্মের উপভোক্তা উঠে আসেন সম্মিলিত হন। এমন মানুষের রাজনৈতিক অবস্থান বদলে, দক্ষিণ বা অতি দক্ষিণে শিবির বদল করলে সেই উপভোক্তারা হতাশ হন, ক্রুদ্ধ হন। প্রতারিত বোধ করেন। তাতেও কোনও সমস্যা নেই। যাঁরা হতাশ, ক্রুদ্ধ বা প্রতারিত বোধ করেন তাঁদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে শিল্পী বা তাঁর শিল্পকে পরিত্যাগ করার। সমস্যা সেখানেও নয়। প্রশ্ন আসে এখানে যে, শিল্পীর সমাজ সচেতনতা কি তাহলে একটি পারফরমেন্স কেবল! শিল্পকর্মে একটি বিশেষ ধরনের সমাজ সচেতনতা কি কেবল একটি শৈল্পিক উপাদান! ভারতীয় নন্দনতত্ত্ব অনুসারে যা রতিহাসাদি ক্রমে ক্রোধ নামক স্থায়ীভাবের উদ্দীপক? সামাজিক অসংগতি ও অসাম্য থেকে যে ক্রোধের জন্ম মানব মনে? তাকেই কি পূরণ করেন সমাজ সচেতন শিল্পী, নাকি তা আদ্যন্ত বিশ্বাস সঞ্জাত? এবং সেক্ষেত্রে কি শিল্পীর আত্ম প্রতিষ্ঠার আয়ুধ হিসেবে নেহাতই ব্যবহৃত হন সমাজ সচেতন বৃত্ত থেকে সম্মিলিত হওয়া উপভোক্তারা? যারা শিবির বদলে আরেকবার হতাশ ক্রুদ্ধ ও প্রতারিত বোধ করেন? সচেতনে সমাজ সচেতনতার উপাদান কি বিশ্বাস সঞ্জাত না হয়েও কেবল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে উৎকৃষ্ট শিল্পকর্ম উৎপাদন করতে পারেন? আমাদের মনে হয় তা পারেন না। শিল্পের শর্ত অনুসারেই পারেন না। তাহলে প্রশ্নটি নতুন করে উত্থাপিত হতে পারে শিল্পী যদি শিবির বদল করেন তাহলে তাঁর শিল্পও কি পরিত্যাজ্য? সাহিত্যের ছাত্র এই কলমচির সাধ্য নয় তার সার্বজনিক স্বীকার্য কোনও উত্তর খুঁজে বার করা, তবে এদেশেই বৌদ্ধ ক্ষণভঙ্গবাদ সময়ের রৈখিক চলনকে অস্বীকার করে বহু সময়বিন্দুর সংযোগ হিসেবে দেখে— তেমনই সময়ের চলনপথে শিল্পী যদি তাঁর শিল্পের প্রতিপাদ্য সামাজিক অসংগতি ও অসাম্যকে উপজীব্য করে সার্থক শিল্পের উৎপাদন করে থাকেন যা রসতত্ত্ব অনুসারে শ্রোতার বা উপভোক্তার মনের ক্রোধ নামক স্থায়ীভাবকে কখনও জাগ্রত করতে সক্ষম হয়ে থাকেন তাহলে শিবির বদলে শিল্পী পরিত্যাজ্য হলেও শিল্পটি কী করে পরিত্যজ্য হয়! পাশ্চাত্যের নন্দনতত্ত্বও যে বলে উৎপাদনের পরে, বাজারজাত হওয়ার পরে শিল্পকর্মটি আর শিল্পীর নয় কেবল, বরং তা উপভোক্তার। তা ওপেন টেক্সট।

    ‘গলায় তেমন সুর খেলে না, হোক বেসুরো পর্দাবদল, মিলিয়ে দিলাম সবার সাথ, মিলিয়ে দিলাম গলা’ বলে যারা স্লোগান দিতে দিতে হাট মিটিংয়ে চোঙা ফুঁকে, গেট মিটিংয়ে গলা ভাঙতে ভাঙতে শহর গ্রাম চিনেছেন, স্লোগান দিতে গিয়ে যারা সবার সাথে নিজের দাবি প্রকাশ্যে তুলতে শিখেছেন আপনার গানে, প্রতুলবাবু, তাঁরা ক্ষ্যাপা মোষের ঘাড়ে আপনাকে বিস্রস্ত কর্তব্যকর্মরহিত উপবিষ্ট দেখলে যে হতাশ হবেন তাতে আর আশ্চর্য কী!

    লোহার সাঁকো টাটুর বুকে হিমশীতল পথ পার হন আপনি।
    রসিকজনের লংমার্চে আপনি বারবার গীত হবেন।

    _________
    সংগীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের শোক সংবাদ | Singer-Song writer Pratul Mukhopadhyay Obituary
    *কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আঘাত করা এ-লেখার উদ্দেশ্য নয়। মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @