প্রশান্ত কিশোর : বাংলা রাজনীতির ময়দানে

যুদ্ধের ময়দানে দ্রোণাচার্যকে বিভ্রান্ত করতে যুধিষ্ঠির চেঁচিয়ে বললেন, ‘অশ্বত্থামা হত’, তারপর মৃদু গলায় বললেন, ‘ইতি গজ’। এর ফলে দ্রোণাচার্য ভেঙে পড়লেন যুদ্ধের ময়দানে। এটাই সম্ভবত পৃথিবীর সব থেকে প্রাচীন ফেক নিউজ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ফেক নিউজ হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হল, বলা হল, পোপ ফ্রান্সিস ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জয়ী দেখতে চান। বা, হিলারি ক্লিন্টন আইসিস সংগঠনকে গোপনে অস্ত্র সরবরাহের ব্যবস্থা করেছেন। পরে একটি সমীক্ষায় দেখা যায় প্রায় ৭৫ শতাংশ মার্কিন নাগরিক এসব মিথ্যা খবর বিশ্বাস করেছিলেন।
২০১৭ সালে রাজস্থানের কোটায় সোশ্যাল মিডিয়া ভলান্টিয়ারদের এক সভায় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ (দৈনিক ভাস্কর এবং দ্য ওয়্যার-এর রিপোর্ট) বলেন, ‘আপনারা শুধু মেসেজ ছড়িয়ে দিন, প্রতিদিন যা ভাইরাল হবে’। কী ধরনের মেসেজ? অমিত শাহ বলছেন, ‘আমাদের ৩২ লাখের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে। একজন সোশ্যাল মিডিয়ার কর্মী সেখানে লিখে দিয়েছিল, অখিলেশ মুলায়মকে চড় মেরেছে। বাস্তবে এমন কিছুই কিন্তু ঘটেনি। কিন্তু খবরটা ভাইরাল হয়ে গেল। এই ধরনের কাজ করা মোটেই উচিত নয়। কিন্তু আবার এটাও ঠিক, ওই মেসেজ একটা ‘মহল’ তৈরি করতে পেরেছিল। যেটা আমরা করতে চাই। কিন্তু এমন কাজ কিন্তু কখনও করবে না’। উপস্থিত কর্মীরা সবাই হেসে উঠলেন। অমিত শাহ আবার বললেন, ‘আমি কী বলছি আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন’।
ডিজিটাল যুগের নির্বাচনে এমন সব কৌশল ব্যবহার হবে বা হচ্ছে, যা অনেক সময় আমরা আগে থেকে বুঝতেই পারব না। কিন্তু যে উদাহরণগুলো দেওয়া হল সেগুলো হল মানুষকে বোকা বানিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা। এই ধরনের কাজের ইতিহাস বহু পুরোনো। যেমন, ১৮৩৫ সালে ‘নিউইয়র্ক সান’ পত্রিকা একটা সিরিজ ছেপেছিল। সেখানে ছবিতে দেখানো হল, চাঁদে এক দল বাদুড়ের মতো মানুষ, নীল রঙের ছাগল ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার পাশেই নীলকান্তমণি (Sapphire) দিয়ে তৈরি প্রাসাদ। বলা হল, ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন হারসেল (John Herschel) দক্ষিণ আফ্রিকার এক অবজারভেটরি থেকে একটি জোরালো টেলিস্কোপ দিয়ে চাঁদের এই ছবিগুলি তুলেছেন। এরা সব চাঁদের প্রাণী। কয়েকদিনের মধ্যেই নিউইয়র্ক সান-এর বিক্রি ৮ হাজার থেকে বেড়ে হয়ে গিয়েছিল ১৯ হাজার। কম্মটি করেছিলেন সান-এর সম্পাদক রিচার্ড অ্যাডামস লক। ঘটনা হল, সত্যিই ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন হারসেল দক্ষিণ আফ্রিকার একটি অবজারভেটরিতে গবেষণা করছিলেন টেলিস্কোপ নিয়ে। কিন্তু ছবি বা ওই রিপোর্ট কোনওটাই তিনি পাঠাননি। সবটাই সান-এর অফিসে বসে বানানো হয়েছিল কাগজের বিক্রি বাড়াতে। সানের সম্পাদক জানতেন, দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে চিঠি ছাড়া যোগাযোগ করা সম্ভব নয়, ফলে সত্য প্রকাশ হতে হতে মাস পেরিয়ে যাবে। ততদিনে তাঁর ব্যবসা অনেকটা এগিয়ে যাবে। লোকেও ভুলে যাবে।
আগের যে সব দৃষ্টান্ত, সেসব হল মানুষের মনকে ভুল পথে চালিত করার চেষ্টা, নির্বাচনকে অনৈতিক ভাবে প্রভাবিত করার কৌশল। কিন্তু এই অনৈতিক কাজের বাইরেও ভোটে তুখোর স্ট্র্যাটেজির একটা ভূমিকা আছে। ছোটো-খাটো ভাবে তার প্রয়োগ আগেও ছিল, তবে ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোর এই ‘বিজ্ঞান’কে ২০১১ সালে গুজরাটে প্রথম সফল ভাবে হাতে-কলমে প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর থেকে প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা সিএজি (সিটিজেনস ফর অ্যাকাউন্টেবল গভর্নেন্স)-এর মুকুটে পালকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ২০১৪ সালে তিনি ছিলেন বিজেপির নির্বাচন স্ট্র্যাটেজিস্ট। নীতীশ কুমার, পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরেন্দ্র সিং, ২০১৯-এ জগনমোহন রেড্ডির নির্বাচনী সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে সিএজি-র নির্বাচন স্ট্র্যাটেজি। ব্যর্থতাও আছে। উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের হয়ে কাজ করেছিলে প্রশান্ত কিশোর। চূড়ান্ত ব্যর্থ হন তিনি। সাফল্যের ধারে পাশেও যেতে পারেনি কংগ্রেস। ফিজ কত প্রশান্ত কিশোরের! কেউ বলেন ১০০ কোটি, কেউ বলেন ১৪০। প্রশান্ত কিশোর এই নিয়ে কখনও মুখ খোলেননি। কিন্তু এটা ঠিক সব সময় তিনি ফিজ নেন না। এমন একটা ইঙ্গিত রয়েছে প্রশান্তের একদা সহকর্মী শিভম শঙ্কর সিং-এর লেখা বই, ‘হাউ টু উইন অ্যান ইন্ডিয়ান ইলেকশন’ বইয়ে। এই প্রশান্ত কিশোর এবার বাংলায় এলেন বর্তমান শাসকদলের হয়ে কাজ করার জন্য।
কখন এলেন প্রশান্ত কিশোর? যখন শাসকদল বিজেপির কাছে ১৮টি আসন হারিয়েছে। তখন প্রতিদিন টেলিভিশনে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে মুকুল রায় বা কৈলাশ বিজয়বর্গীয়ের হাত থেকে পতাকা নিচ্ছেন তৃণমূলের দলত্যাগীরা। যে লোকসভার ভোট হয়ে গেল, তাতে বিধানসভা ভোটের নিরিখে সংখ্যগরিষ্ঠতা থাকলেও বহু অপ্রত্যাশিত আসনে পিছিয়ে পড়েছে শাসকদল। সেটা পঞ্চায়েত এবং পুরসভার ওয়ার্ডের ক্ষেত্রেও সত্যি। যে নেতারা পিছিয়ে পড়েছেন, দলত্যাগীদের সিংহ ভাগ তারাই। তখন রাজ্যের আকাশে বাতাসে বিজেপি হাওয়া। তার আগেই নরেন্দ্র মোদী রাজ্যে বক্তৃতা দিতে এসে শুনিয়ে গিয়েছেন, ৪০ জন শাসকদলের বিধায়ক বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। মুকুল রায় বললেন সংখ্যাটা আরো বেশি। একটা কথা ফিসফাসে ছড়িয়ে দেওয়া হতে লাগল, এত বেশি সংখ্যায় বিধায়করা দল ছাড়বেন যে পুজোর আগেই মমতার সরকারের পতন হবে। নিয়ম করে দিল্লি থেকে আসতে শুরু করল অ্যাডভাইসরি বাণ। এই যে বিজেপি-আবহ বা বিজেপি ন্যারেটিভ রাজ্য জুড়ে তৈরি হল, সেই ন্যারেটিভটা বদলের প্রয়োজন ছিল। এবং সেটা সহজ কাজ ছিল না। প্রশান্ত আসার পর (পরামর্শ ঠিক কার তা অবশ্য নির্দিষ্ট করে আমার জানা নেই), ‘কাটমানি’ বিষয়টি, নিজে রক্তাক্ত হবে জেনেও, যে ভাবে প্রবল ঝুঁকি নিয়ে রাজনীতির ময়দানে নিয়ে এল তৃণমূল কংগ্রেস, আজ কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, তার ধাক্কায়, বিজেপির সেই ন্যারেটিভ বদলাতে শুরু করেছে। প্রথম চাল কিন্তু এখনও পর্যন্ত অনেকটা সফল। শেষ কথা কী তা জানতে অপেক্ষা করতেই হবে।
গত বৃহস্পতি এবং শুক্রবার, শীর্ষনেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর, শাসকদলের নেতা বিধায়কদের বেশ কয়েক দফা পরামর্শ দিয়েছেন প্রশান্ত কিশোর, যা সংবাদপত্রে বিস্তারিত ভাবে প্রকাশিত। তাতে বোঝা যাচ্ছে বুথস্তর থেকে দলের মাথা পর্যন্ত নানা শিরা-উপশিরায় নতুন করে দলকে বাঁধতে চাইছেন তিনি। লড়াইটা জয় শ্রী রামের সঙ্গে সোনার বাংলার, এবং তা হাড্ডাহাড্ডি, সন্দেহ নেই। মনে রাখতে হবে, ২০০৪-এর লোকসভা ভোটে মাত্র ১টি আসন থেকে ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে ১৯টি আসন দখল করে মমতা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বাউন্স ব্যাক করার ক্ষমতা তিনি রাখেন।