নিজের মাথায় গুলি চালালেন প্রফুল্ল চাকী

ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী ও স্বাধীনতা আন্দোলনোর অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা ও অগ্নিযুগের শহীদ বিপ্লবী ছিলেন প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু। বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকীর জন্ম ১৮৮৮ সালে ১০ ই ডিসেম্বর। পূর্ববঙ্গের বগুড়া জেলায় বিহার গ্রামে। ছোটবেলায় নামুজা ঞ্জানদা প্রসাদ মধ্য বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরে তিনি বগুড়ায় মাইনর স্কুলে ভর্তি হন। তারপরে ১৯০৩ সালে রংপুরে জেলা স্কুলে ভর্তি হন। এখানে তিনি নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় পূর্ববঙ্গ সরকারের কার্লাইসার্কুলার বিরুদ্ধে ছাএ আন্দোলন অংশগ্রহণ করারর দায়ে তাঁকে এই স্কুল থেকে বহিস্কার করা হয়। এরপর রংপুরে কৈলাস রঞ্জন স্কুলে ভর্তি হন। এখানে পড়ার সময় বিভিন্ন বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগের সূত্রপাত ঘটে। এবং তিনি বিপ্লবী ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হন।
১৯০৭ সালে শেষের দিকে সারা দেশে শুরু হয় ব্রিটিশ শাসক ও সশস্ত্র বিপ্লবী দের সংঘর্ষ, ধড়াপাকড় আর অত্যাচার, নির্যাতন এইসব স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লববাদী দলগুলোকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার মরিয়া হয়ে ওঠে। একের পর এক বিপ্লবীদের ধরে নিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা শুরু করে দেয়। এছাড়া তাদের উপর অকথ্যঅত্যাচার শারীরিক নির্যাতন চালানো শুরু করে। তাঁদেরকে আলিপুর ও আন্দামান জেলে যাবজ্জীন কারাদন্ড দিয়ে পাঠানো হত।
এমন সময়ে একটি ঘটনা ঘটে যায়, সুশীল সেন নামে ১৩ বছরে বালক ঘুসি মেরে পুলিশ সাজের্ন্ট কে নাক ফাটিয়ে দেয়। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতা মামলা শুরু করে ব্রিটিশ সরকার। মামলায় বিচারক ম্যাজিস্ট্রেট কিংফোর্ড বিচারের সুশীল সেনকে ১৫ ঘা বেত্রাঘাত মারার হুকুম দেন। বেত্রাঘাতের ফলে বালক সুশীল সেন রক্তাক্ত হলেন। দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন।এই ঘটনা আগুনের মত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ঠিক এইসময় সকল তরুণ বিপ্লবী দল এইঘটনা ক্ষিপ্ত হয়ে ইংরেজকে বিতাড়িত করার সংকল্প করেন। বিপ্লববাদী দলের অরবিন্দ ঘোষ, চারুদত্ত, হেমচন্দ্র কানুগো, বারীন ঘোষ, একটি পরিকল্পনা করলেন যে, অত্যাচারী কিংফোর্ড-কে হত্যা করার। কিন্তু প্রশ্ন উঠল যে এই কাজের দায়িত্ব কাকে দেওয়া যেতে পারে। ঠিক এইসময় এইকথা শুনে প্রফুল্ল চাকী বললেন :- " আমি প্রস্তুত " " বলুন কি করিতে হইবে"। সবাই ভাবলেন এই কাজ করার জন্য আরো একজনের দরকার। ভেবেচিন্তে বালক ক্ষুদিরাম বসুকে নির্বাচিত করলেন। ১৯০৮ সালে ২৫ এপিল ক্ষুদিরাম বসু কলকাতায় পৌঁছালেন। কলকাতায় গোপিমোহন দত্তের ১৫ নম্বর বাড়িটি ছিল বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা। এখানে বসেই বিপ্লবী হেমচন্দ্র ও উল্লাস কর "বুক বোমা " তৈরী করলেন। এই বোমা বইএর পাতায় রাখা যেত। এই বোমাকে একটি বইএর মধ্যে রেখে কিংফোর্ডকে পাঠানো হল। কিন্তু কিংফোর্ড বই না খোলায় এই যাত্রায় প্রাণ বেঁচে গেল।
আরও পড়ুন
নার্গিস-কে লেখা নজরুলের চিঠি
শুরুবহল নতুন প্রস্তুতি। প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম কলকাতা রেলস্টেশনে পৌঁছানোর পর বারীন ঘোষ তাঁদের কাছে কিংফোর্ড মারার জন্য বোমা পৌঁছে দিলেন। প্রফুল্ল চাকী ক্ষুদিরাম প্রথমবারে মতো একজায়গা হলেন রেলস্টেশনে। কিংফোর্ডকে হত্যা করার জন্য যুক্তি করলেন। এরপর তারা মজঃফরপুরে চলে যান।কারণ প্রতিদিন এখানে তিনি বাস করেন কিংফোর্ড। প্রতিদিন ক্লাব হাউজ থেকে সন্ধ্যার পর সাদা ফিটন গাড়ি করে নিয়মিত বাড়ি ফিরে যান কিংফোর্ড। কিছু দিন চলে গেল, কিন্তু তারা সুযোগের পেল না। কিংফোর্ডকে হত্যা করার জন্য শেষমেষ সুযোগ এল। ১৯০৮ সালে ৩০ এপিল ক্লাব হাউজ থেকে তাঁর বাড়ি পর্যন্ত যে পথ সেই পথের মাঝখানে প্রফুল্ল ও ক্ষুদিরাম ঝোপের ঢাকা একটি জায়গায় লুকিয়ে ছিল। সন্ধ্যার পর সাদা ফিটন গাড়ি তাঁদের কাছে পৌঁছানো মাত্রই গাড়িটি লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপপ করে।কিন্তু সেই দিন ওই গাড়ি তে কিংফোর্ড ছিলেন না। ছিলেন দুই বিদেশ যাত্রী। অতিদ্রুত সেখান থেকে পলায়ন করলেন তাঁরা। এরপরেই সকল স্টেশনে খবর চলে গেল। পুলিশ ঘোষণা করলেন, এই আততায়ীকে ধরে দিতে পারলে পাঁচ হাকার টাকা নগদ পুরস্কার দেওয়া হবে। এই দিকে ক্ষুদিরাম বসু মজঃফরপুর থেকে প্রায় ২৪ মাইল পায়ে হেঁটে ওয়ালী স্টশনে পৌঁছে যান।প্রচন্ড জলের তৃষ্ণায় একটি দোকানে যান তিনি। এইদিকে পুলিশ আততায়ী কে ধরার জন্য ওত পেতে ছিল। পুলিশ ক্ষুদিরাম কে সন্দেহ করেন। ক্ষুদিরাম জল পান করার সময় পাঁচ থেকে ছয় জন পুলিশ ঘিরে ফেলে। এরফলে গ্রেপ্তার হলেন বালক ক্ষুদিরাম বসু। ক্ষুদিরাম বসু বোমা হামলার সব দায় তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন।তিনি একবার ও তার সহযোগীর কথা বা নাম মুখে উচ্চারণ করেননি।
এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে ক্ষুদিরাম বসু প্রফুল্ল চাকীর শুধুমাত্র একসাথে সহকর্মী ছিলেন না। তাদের একের ওপরে বিশ্বাস, ভালোবাসা ও দেশপ্রেমিক এক ভ্রাতৃত্ব হৃদয়ের বন্ধনের সৃষ্টি করেছে। আবার অন্য দিকে প্রফিল্ল চাকী অনেকটা পথ অতিক্রান্ত করার পর গ্রফতার এড়ানোর জন্য রওনা হন ট্রেনে বাঙালী পুলিশ নন্দলাল ব্যানার্জী নামে পুলিশের এক দারোগা সমস্তিপুরে ( মোকামা ঘাট) স্টেশনের কাছে প্রফুল্ল চাকী কে দেখে সন্দেহ করেন। দারোগা সন্দেহ করার জন্য প্রফুল্ল চাকীকে পালাবার চেষ্টা করেন। ট্রেন থেকে নেমে দৌড়ে অনেক দূর চলে যান। পুলিশ তার পপিছু ধাওয়া করল। স্টেশনে পাহারত পুলিশও পিছু নিল। প্রফুল্ল চাকী দারোগা কে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লেন। কিন্তু লক্ষভ্রষ্ট হল। এই সময় তিনি ভাবলেন যদি পুলিশ হাতে ধরা পড়েন তাহলে দলের সিধান্ত অনুযায়ী ঠিক করলেন নিজের গুলিতে তিনি প্রাণ বিসর্জন দেবেন। এর কারণ হল যদি তিনি ধরা পড়েন তাহলে মারের মুখে বিপ্লবী দের অনেক তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে।এই সিধান্তে যখন ঠিক করে ফেলেন, তখন তিনি দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েন। পুলিশ খুব কাছে চলে এল। সেই মুহুর্তে মধ্যে পকেটে থাকা রিভালবার বার করে নিজের মাথায় দু’বার গুলি করেন। মারা যান প্রফুল্ল চাকী।