প্রাচীন সিংহবাহিনী দেবীই কি আধুনিক জগদ্ধাত্রী?

দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী। একই মাতৃশক্তির তিন রূপ। দুর্গা রণরঙ্গিনী মহিষমর্দিনী যুদ্ধদেবি। কালী রক্তপিপাসু রনোন্মত্ত উগ্রচন্ডা।কিন্তু জগদ্ধাত্রী জগৎধারিনী। শান্ত প্রসন্নময়ী। সিংহবাহিনী মাতৃমূর্তি। তিনদেবী যথাক্রমে রজো, তমো আর সত্ত্বগুণের প্রতীক। বঙ্কিমচন্দ্রের স্বদেশভাবনাতেও এই ত্রয়ীমাতৃশক্তির প্রভাব পড়েছে। তবে মূর্তি সাক্ষ্যে কালীর মতো জগদ্ধাত্রীও অর্বাচীন দেবী।বরিশাল থেকে প্রাপ্ত যে প্রস্তরমূর্তিটি জগদ্ধাত্রীর বলে দাবী করা হয় বিশেষজ্ঞদের মতে চতুর্দশ শতকের। সেই দিক থেকে দুর্গার প্রাচীনত্ব অনেক দিনের।
অথচ জগদ্ধাত্রী যে প্রাচীন দেবী সন্দেহ নেই। পঞ্চদশ বা ষোড়শ শতকের স্মার্তপণ্ডিত শূলপাণি তাঁর ‘কালবিবেক’ গ্রন্থে কার্তিকমাসে জগদ্ধাত্রী পুজোর উল্লেখ করেছেন।
কার্তিকেহমলপক্ষস্য ত্রেতাদৌ নবমেহহনি।
পূজয়েত্তাং জগদ্ধাত্রীং সিংহপৃষ্ঠে নিষেদুষীম।।

শূলপাণির পূর্বে রচিত স্মৃতিসাগরগ্রন্থে কার্তিকমাসে উমাপুজোর উল্লেখ রয়েছে। মহামহোপাধ্যায় পঞ্চানন তর্করত্ন মনে করেন কেনোপনিষদে উল্লিখিত উমা-হৈমবতীই হলেন জগদ্ধাত্রী। (দ্রষ্টব্যঃ হিন্দুদের দেবদেবী উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ তৃতীয় পর্ব, হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য পৃ--৩০৮) কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। তাঁকে অষ্টাদশ শতকের বলে মনে করা হলেও অনেকেই দাবী করেছেন তিনি ষোড়শ বা সপ্তদশ শতকের তন্ত্রসাধক। তাঁর লেখা জগদ্ধাত্রীর ধ্যানমন্ত্রে দেবীর রূপটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেবী ত্রিনেত্র, চতুর্ভূজা, দুটি বামহাতে যথাক্রমে শঙ্খ আর ধনুক। ডানহাত দুটিতে চক্র ও তীর। দেবীর বাহন সিংহ। ললিতাসনে উপবিষ্ট। দেবী করিন্দ্রাসুরকে নিহত করেছিলেন। তাই পদতলে হস্তীমুণ্ড। মোটামুটি এই ধ্যানের বর্ণনানুযায়ী জগদ্ধাত্রীর প্রতিমাগুলি আজও নির্মিত হচ্ছে। তবে সহায়ক মূর্তির বৈচিত্র দেখা যায়। কোথাও কোথাও জয়া বিজয়া। কোথাও নারদ ও বশিষ্ঠমুনি। সাধারণ ভাবে এদেরকে মু্নি ঋষি বলা হয়। অনেক মূর্তিতে চালির দুপাশে চামর হাতে উড়ন্ত জোড়া বিদ্যাধরী। লোকমুখে যার পরিচিতি পরী বা অপ্সরা।
জগদ্ধাত্রীকে দেবীদুর্গার অবতার বা নামান্তর বলা হয়। তবে বোধন ষষ্ঠাদি সংকল্প আর নবপত্রিকার বিষয়টি নেই। সপ্তমী, অষ্টমী আর নবমীর পুজো হয় একদিনে। যথারীতি দুর্গাপুজোর মতোই কুমারীপুজো সিঁদুরখেলা ও বিজয়া দশমী রয়েছে। এছাড়া দুর্গা যেমন মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন, জগদ্ধাত্রী তেমনি করিন্দ্রাসুরকে নিহত করেছিলেন। অনেকেই বলেন দেবীদুর্গার অপর নাম জগদ্ধাত্রী।পার্থক্য বলতে জগদ্ধাত্রীপুজো হয় দুদিনে আর দুর্গাপুজো চারদিনের।
প্রচলিত কিংবদন্তীতে জগদ্ধাত্রীপুজোর উদ্ভবের প্রেক্ষাপটেও দুর্গার যোগ নিবিড়। কথিত আছে নদিয়াধিপতি কৃষ্ণচন্দ্র রায় একবার মুর্শিদাবাদে নবাবের কোষাগারে সময় মতো রাজস্ব দিতে না পারার জন্য কাররারুদ্ধ হন। তখন ছিল দুর্গাপুজোর সময়। দুর্গাভক্ত রাজা অত্যন্ত ব্যথিত হলেন দেবীপুজো যথাসময়ে না করতে পারার জন্য। দেবীদুর্গা স্বপ্নে রাজাকে জানিয়ে দিলেন চিন্তার কিছু নেই। কার্তিক নবমীতে তাঁকে জগদ্ধাত্রী রূপে আরাধনা করলেই চতুর্বর্গ লাভ করবেন। লোকবিশ্বাস-সেই থেকে বাংলাদেশে জগদ্ধাত্রীর পুজো চালু হয়ে যায়; বিশেষ করে জমিদারি মহলে ও ধনাঢ্য শাক্তপরিবারে।
দেবীর আরেক নাম শাক্তপ্রিয়া। নবমীতিথি শাক্তসংস্কৃতিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ। আষাঢ় নবমী তিথিতে অধিকাংশ গ্রাম্যদেবী চণ্ডীর পুজো হয়। এই তিথিতে রাঢ় অঞ্চলে যোগাদ্যা গন্ধেশ্বরী শিবাখ্যা শাকম্ভরী প্রভৃতি প্রাচীন শাক্তদেবীর বিশেষ পুজো হয়। সবমিলিয়ে দুর্গাপুজো বছরে তিনবার হলো যথা বসন্তকালে বাসন্তি দুর্গা। শরৎকালে শারদ দুর্গা। আর হেমন্তকালে হৈমন্তিক দুর্গা অর্থৎ জগদ্ধাত্রী পুজো।

তবে দুর্গার সঙ্গে জগদ্ধাত্রীর পার্থক্য আছে যথেষ্ট। জগদ্ধাত্রী রণরঙ্গিনী যুদ্ধদেবী নন। তিনি প্রসন্ন মাতৃমূর্তি। দুর্গাপুজো রাজসিক উৎসব। দশেরা উৎসবে দশ দিন ধরে এই যুদ্ধাদেবীর পুজো হয়। যদিও বাঙালীর কাছে দুর্গা ক্রমশ ঘরের মেয়ে উমা হয়ে উঠেছে। তবে যতই আদরের কন্যা হয়ে উঠুক দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনী রূপেই পূজিত। কিন্তু জগধাত্রী সাত্ত্বিক পুজোর দৃষ্টান্ত। প্রসন্নময়ী মাতৃ রূপে তিনি ধরা দিয়েছেন। কার্তিক পুজো বা রাস উৎসবে দেবদেবীকে নিয়ে নাটকীয় ভাবে মূর্তি সাজিয়ে যে বিশেষ শিল্পরূপ "থাকা"র আয়োজন করা হয় তার সর্বোচ্চে থাকে থাকেন শিশুকোলে জগদ্ধাত্রী।
পুরাতাত্ত্বিকদের মতে মূর্তিগত দিক থেকে দুর্গার মহিষমর্দিনী ও মহিষাসুরমর্দিনীমূর্তির পার্থক্য আছে। মহিষমর্দিনীমূর্তিতে মহিষকে দেবী নিহত করেছেন। এই মূর্তি প্রাচীন। মৌর্য পরবর্তী যুগ থেকে ভাস্কর্যে দেখা গেছে। তারপর সময়ের অগ্রগতিতে মহিষ থেকে ক্রমশ মহিষাসুরে পরিণত হয়েছে। ফলে দেবীর পরিচিতি তখন মহিষাসুরমর্দিনী।এই মূর্তি অপেক্ষাকৃত নবীন। দেবীর বাহন সিংহও বদলেছে। প্রচলিত সিংহর পরিবর্তে ঘোড়ামুখো সিংহ হয়েছে। যা টেরাকোটা দুর্গাফলকে বা বনেদি বাড়ির দুর্গা মূর্তিতে আজও দেখা যায়।
পাশাপাশি চতুর্ভূজা আরেক ধরনের পাথরের তৈরি মাতৃমূর্তি গুপ্ত পরবর্তী সময় থেকেই মিলেছে। পুরাতাত্ব্বিকের মতে দেবীর নাম- সিংহবাহিনী। বাংলাদেশ ও বিহার ঝাড়খন্ডে প্রচুর এই 'সিংহবাহিনী' মূর্তি পাওয়া গেছে। কাটোয়া থানার কড়ুই গ্রামে সংরক্ষিত আনুমানিক দশম শতকের একটি সিংহবাহিনী মূর্তি রুদ্রানী নামে পূজিত হয় এখানে দেবীর বাহন সিংহ রয়েছে। এই মূর্তি মহিষমর্দিনীর মতোই প্রাচীন। দিল্লীর এ এস আই ডেপুটি সুপারেনটেনডেন্ট আর্কোলজিস্ট শুভ মজু্মদারের মতে -"মহিষমর্দিনী বা মহিষাসুরমর্দিনী নয়; প্রাচীন সিংহবাহিনীর দেবীর সঙ্গেই আধুনিক জগদ্ধাত্রীর প্রভূত মিল রয়েছে। জগদ্ধাত্রীকে মহিষমর্দিনী বা মহিষাসুরমর্দিনীর সংগে একাত্ম করার জন্যই পরবর্তীকালে মহিষাসুরের সাদৃশ্যে করিন্দ্রাসুরের প্রসঙ্গ আনা হয়েছে। "বলা বাহুল্য মহিষাসুরের মতো পূর্ণাঙ্গ পৌরাণিক পরিচিতি নেই করিন্দ্রাসুরের ।