বাড়ির দেওয়াল থেকে উঠোন, সর্বত্র পটের ছোঁয়া – ‘পিংলা’র পটকথা

হারিয়ে যাওয়া লোকশিল্পের সন্ধানে এবার পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলায়। হাওড়া থেকে ট্রেনে বালিচক, বালিচক থেকে বাসে কিংবা প্রাইভেট গাড়িতে পিংলার কমবেশি দূরত্ব ১৩০ কিমি। পিংলার ‘নয়া’ রাজ্যের একমাত্র পটগ্রাম। আর এই গ্রামের বাসিন্দাদের একটাই পরিচয়, ওরা ‘চিত্রকর।’ ওরা ‘ধর্ম’ মানে না অনেকটা বাউলদের মতো। কারণ হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের বাড়িতেই যেহেতু পট দেখানোর সূত্রে তাঁদের যাতায়াত, তাই তাঁরা দুই সম্প্রদায়েরই আচার-বিধি পালন করে থাকেন। কেউ কেউ বলেন পটুয়ারা আসলে ‘বিশ্বকর্মার বংশধর’। ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ’ অনুসারে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার ঔরসে স্বর্গের সঙ্গীত পটীয়সী অপ্সরা ঘৃতাচীর গর্ভে নয় দক্ষ শিল্পীর জন্ম হয়- মালাকার, কর্মকার, শঙ্খকার, কুবিন্দকার বা তন্তুবাঈ, কুম্ভকার, কংসকার বা কাঁসার, সূত্রধর, চিত্রকর এবং স্বর্ণকার। এরমধ্যে চিত্রকর হলেন অষ্টম গর্ভের সন্তান। আবার কারো কারো মতে ‘ফকির পটুয়া’ নামে এক চিত্রকর এক নরখাদক দৈত্যের ছবি এঁকে সেই দৈত্যকে বোকা বানিয়ে হত্যা করেছিল। সেই ‘ফকিরপটুয়া’র নাম থেকেই নাকি এই সম্প্রদায়ের উৎপত্তি। সহিষ্ণুতা-অসহিষ্ণুতা শব্দগুলি পিংলার পটশিল্পীদের কাছে একেবারেই অপরিচিত। আসলে ‘চিত্রকর’ পদবির আড়ালে পিংলার এই মানুষগুলির ধর্মীয় পরিচয়ও এক্কেবারে ঢাকা পড়ে গেছে৷
গ্রামে ঢুকলেই মনপ্রাণ ভরে যায়। বাড়ির দেওয়াল থেকে উঠোন, সর্বত্র পটের ছোঁয়া। শিল্পীরা বাড়ির সামনেই নিজেদের আঁকা পটচিত্রের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। কেউ কেউ ছবি আঁকছেন। পরিবারের খুদে সদস্য থেকে বাড়ির কর্তা, সকলেই এই শিল্পে সামিল। মাটির সরা, কেটলি, শাড়ি বা হাল ফ্যাশনের টি-শার্টেও জায়গা করে নিয়েছে এই পটচিত্র। পিংলার পটচিত্র ক্রাফটমার্কও পেয়েছে। গবেষকদের কেউ কেউ বলেন নেপাল, হিমাচল ও পাহাড়ি এলাকায় মোঙ্গলীয়রা তিব্বতীয় স্টাইলে যে ‘থাঙ্কাচিত্র’ করে থাকেন, বাংলার পটেও তারই প্রভাব রয়েছে। যেভাবে লামাদের মুখোশ নৃত্য ‘ছাম’ থেকে এসেছে আদিবাসী ‘ছৌ’ নাচ। এখানেও অনেকটা সেরকম। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, পিংলার পটের সঙ্গে মৈথিলীর যোগসূত্র রয়েছে। একটা সময় ছিল যখন সকাল হলেই পটের ঝোলা নিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন পটশিল্পীরা। ঝোলায় থাকত পটের ওপর আঁকা নানারকম চিত্র। পিংলার নয়াগ্রাম থেকে বেরিয়ে তাঁদের গন্তব্য হত আশেপাশের গড়বেতা, মেদিনীপুর শহর, খড়গপুর বা জামবনির মতো এলাকা। কারও বাড়িতে ঢুকে শিল্পীরা ঝোলা থেকে বার করতেন চাঁদ সদাগরের বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর, কিংবা চণ্ডীমঙ্গল বা সাবিত্রী সত্যবানের মতো পুরাণকাহিনি নিয়ে নিজেদের আঁকা পটের ছবি। আর সেই ছবি দেখিয়ে গান গাইতেন শিল্পীরা। গানের পর শ্রোতারা যা দিতেন তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হত। যার ফলে কোনওদিন আধপেটা অথবা প্রায় না খেয়েই থাকতে হত শিল্পীদের।
দিন বদলেছে চিত্রকরদের। এখন শিল্পীরা মেলায় যান, দেশ-বিদেশ ঘোরেন নিজেদের পসরা নিয়ে। পিংলার ‘নয়া’তে শিল্পীদের বাড়িতেই গড়ে উঠেছে হোম-স্টে। খরচও খুব একটা বেশি না, ৭০০-৮০০ টাকার মধ্যে সঙ্গে মিলবে তিনবেলা খাওয়া-দাওয়া। আর চাইলে দিনের বেলার মধ্যাহ্নভোজনও সারতে পারেন শিল্পীদের বাড়িতে। সব মিলিয়ে ‘নয়া’গ্রামের পটশিল্পীরা আজ স্বাবলম্বী। মন্টু চিত্রকরের কথায়, “বাংলা নাটক ডট কম নামের সেচ্ছাসেবী সংস্থা আমাদের পাশে দাঁড়ানোর পর থেকে আমরা স্বাবলম্বী হতে শিখেছি। আজ আমরা বাংলা লিখতে পারি বা না পারি ইংরেজিতে কিন্তু আমরা বেশ সড়্গড়।” এই গ্রামের সব বাড়িতেই রয়েছে কর্মশালা। কাজ চলছে দিন-রাত। এই গ্রামেরই বাহাদুর চিত্রকর নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন সংগ্রহশালা। এককথায় অসাধারণ। মন ভরে যায়, দেশ বিদেশের নানান মুখোশ, মুদ্রা, পুঁথি, পটের পাশাপাশি রয়েছে একটি দুষ্প্রাপ্য বইয়ে ঠাসা লাইব্রেরি।
পটের অনেক গল্প যা বলে শেষ করা যায় না। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকাল। প্রধানমন্ত্রী চাণক্য বুঝলেন সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের ভিত মজবুত করতে হলে প্রয়োজন পুঙ্খানুপুঙ্খ খবরের। সাম্রাজ্যের প্রতিটি অংশ থেকে সংগ্রহ করতে হবে সেই খবর। প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে তুলে আনতে হবে হিংসা বিবাদ বিদ্রোহ নগরজীবন গ্রাম্যজীবনের সুখ দুঃখ ঘর গেরস্থালির খবরাখবর। তা না হলে রাজ্য চালানো বেশ মুশকিল। ডাক পড়ল কয়েকজন চিত্রশিল্পীর, তাঁরা শুধু ছবিই আঁকতে পারেন না, মুখে মুখে গানও বাঁধতে পারেন। চাণক্যের নির্দেশে চিত্রশিল্পীরা ছড়িয়ে পড়ল সাম্রাজ্যের চারিদিকে। তাঁদের হাত ধরে একে একে আসতে লাগল সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ নানান কথা ও চিত্র। শিল্পীরা সাম্রাজ্যের নানান প্রান্তের নানান ঘটনার ছবি এঁকে তা পাঠাতে লাগলেন চাণক্যের কাছে। সেযুগে প্রতিটি চিত্রকরই ছিলেন এক একজন গুপ্তচর। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সেই ছবির সঙ্গে কথা বলা বা গান গাওয়ার রেওয়াজ সম্ভবত সেই প্রথম। তারপর এই মাধ্যমই হয়ে উঠল রাষ্ট্র পরিচালনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। সংস্কৃত ‘পট্ট’ শব্দের অর্থ কাপড় বা থান, আর ‘চিত্র’ মানে ছবি অর্থাৎ কাপড় কিংবা থানের ওপর যে চিত্র বানানো হয় তা-হল ‘পটচিত্র’।
চন্দ্রগুপ্তের আমলে শুরু হওয়া চিত্রের এই মাধ্যম ধীরে ধীরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন চিত্রকরেরা। শুধু রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নয়, এর প্রভাব পড়ল ধর্মীয় ক্ষেত্রেও। জৈনদের চব্বিশতম বা শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীরের উপদেশাবলী সমৃদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ ‘কল্পসুত্রে’ও উল্লেখ রয়েছে এই চিত্রকরদের। লোকচক্ষুর আড়ালে অজন্তা-ইলোরা গুহা নির্মাণেও এই চিত্রকরদের হাত ছিল। কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ ও ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’ নাটকে, বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ এবং বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষসে’ চিত্রকরদের কথা রয়েছে। ‘আকবরনামা’-সহ একাধিক মোঘল গ্রন্থে রয়েছে চিত্রকরদের প্রসঙ্গ।
মন্টু চিত্রকরের পরিবারের সঙ্গে লেখক
কেউ কেউ বলেন আজকের এই পটশিল্পের শুরু ওড়িশায় কারণ, ওড়িশার রঘুরাজপুরের পটশিল্প হাজার বছরেরও প্রাচীন। ওড়িশা থেকেই নাকি ধীরে ধীরে এই পটশিল্প ছড়িয়ে পড়ে বাংলা-সহ বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের কিছু অংশে। যাঁরা পটচিত্র আঁকেন তাঁদের বলা হয় ‘পটুয়া’। পিংলার পটশিল্পীদের রঙে আছে মাটির গন্ধ। আর তাঁরা সব রং তৈরি করেন প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে। গাছের সিম দিয়ে শিল্পীরা তৈরি করেন সবুজ রং। ভুষা কালি দিয়ে কালো। অপরাজিতা ফুল দিয়ে নীল। সেগুন গাছের পাতায় হয় মেরুন রং। আর লাল রং হয় পান-সুপারি-চুন দিয়ে। আবার পুঁই মিটুরি দিয়ে গোলাপি রং তৈরি হয়। হলদের ক্ষেত্রে রয়েছে কাঁচা হলুদ। পুকুর খোঁড়ার সময় যে মাটি পাওয়া যায় তা দিয়েই হয় সাদা রং। স্থানীয় কথায় যাকে ‘কুসুম-মাটি’ বলা হয়। তিন ধরনের পট বাংলায় দেখা যায় ‘জড়ানো’ বা ‘গোটানো’ পট, ইংরেজিতে যাকে বলে স্ক্রল। ‘আড়েলাটাই’ পট বা আয়তকার পট, আর রয়েছে ‘চৌকোস’ পট বা বর্গক্ষেত্রকার পট।‘জড়ানো’ বা ‘গোটানো’ পটগুলি বেশ লম্বা আকারের হয়। একটি গল্পকে বর্ণনা করে লম্বা পটে পরপর পনেরো থেকে কুড়িটির কাছাকাছি ছবি আঁকা থাকে। পটশিল্পীরা সেই কাহিনির বর্ণনা দিয়ে গান ধরেন। পটশিল্পী রোল খুলতে থাকেন এবং একেকটি করে ছবি দর্শকদের সামনে মেলে ধরেন ও গানের মাধ্যমে গল্পটি বর্ণনা করেন। এভাবে পট প্রদর্শনকে বলা হয় ‘পট খেলানো’। একসময় পটুয়ারা এই ধরনের পট নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন আর পটচিত্র দেখিয়ে আর গান শুনিয়ে মানুষের মনোরঞ্জন করে উপার্জন করতেন। মাঝেমাঝে বিভিন্ন রাজা মহারাজা, জমিদার কিংবা বিত্তবান মানুষদের বাড়ির পুজোপার্বণে পটুয়াদের ডাক পড়ত পট খেলানোর জন্য। এখন আর সেভাবে পট খেলানো হয় না, পটুয়াদের ডাকও পড়ে না। দিন বদলেছে শিল্পীদের। এখন তাঁরা অনেকটাই স্বাবলম্বী, কর্পোরেট ছোঁয়া লেগেছে শিল্পে। মাটির বাড়ি পাকা হয়েছে। দেশে-বিদেশে তাঁদের শিল্পী সত্ত্বা ছড়িয়ে পড়ছে। একজন শিল্পীর কাছে অর্থের চেয়েও সম্মান অনেক বেশি কাম্য। আর তার থেকেও বেশি কাম্য তাঁর শিল্পসত্ত্বার কদর করার লোকজনের। পটগ্রামের জনা ষাট-সত্তর লোক আজও সব ছেড়ে অন্য পেশার সন্ধান না করে নিজেদের এলাকায় থেকে এই শিল্পকে বিশ্বের দরবারে যেভাবে পৌঁছে দিচ্ছেন তাকে কুর্ণিশ।
ছবি সৌজন্য- মৌমিতা ভৌমিক