কলকাতায় মুখ লুকিয়ে পর্তুগিজ গির্জাও

তার ভালোনাম ক্যাথিড্রাল অব দ্য মোস্ট হোলি রোজারি। আর ডাকনাম পর্তুগিজ চার্চ। আরো একটা ডাকনাম আছে অবশ্য—মুরগিহাটার গির্জা। কলকাতার পর্তুগিজ চার্চ স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে আছে এই শ্বেতকায় গির্জাটি। এমনিতে গির্জা শব্দটিই বাংলা শব্দভাণ্ডারে ঢুকেছিল পর্তুগিজদের হাত ধরে। এছাড়া আরো হরেক শব্দ- আলমারি আলপিন আনারস- সবই পর্তুগিজদের বদান্যতা। ইংরেজদেরও ঢের আগে কিন্তু বাংলায় এসেছিল পর্তুগিজরা। তার চিহ্ন হিসেবে যেমন রয়ে গেছে বাংলা শব্দভাণ্ডারের অগুন্তি শব্দ, রয়ে গেছে কলকাতার একটি গির্জাও।
কলকাতার ব্যস্ত রাজপথে গির্জাটির অবস্থিতি। ব্রেবোর্ন রোড আর ক্যানিং স্ট্রিটের ক্রসিঙে। কাছেই জৈন মন্দির, আর্মেনিয়ান গির্জা, ওল্ড চিনা বাজার। এছাড়া বড়োবাজারের হইহট্টগোল তো রয়েইছে। তবে সবকিছু ছাড়িয়েও এই গির্জা চোখ টানে। জোব চার্নক নাকি দশ বিঘা জমি দিয়েছিলেন রোমান ক্যাথলিকদের একটি প্রার্থনাকক্ষ নির্মাণের জন্যে। কিন্তু ১৬৯৩-তে স্যার জন গোল্ডসবোরোগের আমলে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। গোল্ডসবোরোগের মৃত্যুর পরে আবার একটি কাঠের প্রার্থনাগৃহ নির্মিত হয়। ১৭৫৬-তে সিরাজ-উদ-দৌল্লার কলকাতা আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায় সেন্ট অ্যানিস চার্চ। তারপর, ইংরেজরা সাময়িকভাবে মুরগিহাটায় পর্তুগিজ চার্চের দখল নিয়ে প্যারিস চার্চ হিসেবে ব্যবহার করত। কিন্তু তিন বছর পরে ১৭৫৯ সালে লন্ডনের কোর্ট অব ডিরেক্টরের আদেশে সেটি পুনরায় পর্তুগিজদের দখলে আসে।
এখানে প্রার্থনা কক্ষও তৈরি করেন কলকাতার পর্তুগিজ বাসিন্দারা। তবে বর্তমানে গির্জাটির যে আকৃতি দেখা যায়, অর্থাৎ বিশাল গম্বুজ, মাথায় মূর্তির কারুকাজ- এসবের নির্মাণ শুরু ১৭৯৭-তে। ১৭৯৯ সালের ২৭ নভেম্বর, প্রার্থনাগৃহ নির্মাণ শেষ হয়। এটির নকশা করেছিলেন জেমস ড্রিভার। গির্জাটি নির্মাণে তৎকালীন যুগে খরচ হয়েছিল প্রায় ৯০,০০০ টাকা। সেই ব্যয়ভার বহন করেছিলেন বিখ্যাত ব্যবসায়ী জোসেফ ব্যারেটো। গির্জাটি উৎসর্গ করা হয়েছিল রোজারি ভার্জিন মেরিকে।
গির্জাটি অপূর্ব কারুকার্যময়। দূর থেকেই চোখে পড়বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ত্রিকোণা ছাদ। তাকে ভর দিয়ে আছে দুটি বিশালাকৃতি থাম। একটি বিশাল পোর্টিকো রয়েছে গির্জার সম্মুখভাগে। এছাড়া অন্দরে রয়েছে কাচের রঙিন জানালা। সেসব রঙ ছিটকে এসে পড়ে গির্জার অন্দরেও। অসংখ্য কনফেশন বক্স রয়েছে দেওয়াল জুড়ে। রয়েছে মেরি জোসেফ যিশু ও বাইবেলের অন্যান্য অনেক চরিত্রের অনিন্দ্যসুন্দর মূর্তি।
দেওয়ালের গায়ে রয়েছে অনেকগুলি স্মৃতিফলক। তারমধ্যে একটি হল কলকাতার আর্চ বিশপ পল গোয়েথালসের। তিনি ছিলেন বেলজিয়ামের বাসিন্দা। বইয়ের এক সুবিশাল সংগ্রহ ছিল তাঁর। যা তিনি দান করেছিলেন পার্কস্ট্রিটের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজকে। তাঁর নামেই সেখানকার গোয়েথালস লাইব্রেরি। আর মিসেস মেরি ক্যারির সমাধিও রয়েছে এই গির্জায়। মিসেস মেরি ক্যারি নাকি ছিলেন সিরাজের অন্ধকূপ হত্যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। অন্ধকূপ হত্যাকাণ্ড গল্প না সত্যি-- তা নিয়ে ধন্ধ আজও রয়েছে অবশ্য। কিন্তু ক্যারিরা সেই জবাব দেওয়ার জন্যে নেই।
এছাড়া গির্জাটিতে রয়েছে ম্যাডোনা এন্ড চাইল্ডের বিখ্যাত ছবিও।
শুধুমাত্র স্থাপত্য দিয়ে তো ইতিহাসকে, তার সংস্কৃতিকে বাঁচানো যায় না। সে থাকে প্রতিদিনের জীবনে। তার বহমানতায়। কলকাতার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অনেকটা এমনি। যে সাহেবি কেতা কলকাতা শহর রপ্ত করেছিল, তার সমস্তটাই ইংরেজদের থেকেই আসা, এমনটা নাই হতে পারে। তার অন্দরে মিশে থাকতেই পারে পর্তুগিজ। তবে পর্তুগাল যে কলকাতাসহ গোটা বাংলার সঙ্গেই বেশ লিপ্ত-- তার প্রমাণ দেয় বাংলা ভাষা নিজেই। কিছুতেই তাকে আর পৃথকভাবে চেনা যায় না, সে মিলন এমনই গভীর। তাই শুধু চার্চ দিয়ে নয়। একটা আস্ত পর্তুগালকে, তার স্মৃতিকে এমনভাবেই আমরা নিত্য বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি।