পোর্সিলিন সুন্দরীর দিশি কথা

কলকাতার গল্প বোনা হতে থাকে এক্কা দোক্কা খেলার চেহারায়। বড় কর্তার শখে কিম্বা একেবারে কথা না ফোটা ছেলের বউয়ের জন্য সে কলকাতার অনেক বাড়িতেই সেদিন জড়ো হচ্ছে সাগর পাড়ের ওপাড় থেকে আসা নরম পেলব পাথরের মতো দেখতে পোর্সিলিনের গাউন পড়া বিলিতি মেম পুতুল। বউমাদের খেলার জন্যে সেদিন এমন পুতুলের দেদার আয়োজন। আর সেসব পুতুল দেখতে দেখতেই বাড়ির ছেলেদের মনের আড়ালেও বোনা হয়ে চলেছে এক অদ্ভুত স্বপ্ন কথা।

প্রথমে শিশু ললনাদের একটা তালিকা দেওয়া যাক। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ১৪/১৫ বা গড়ে ১২ বছর আন্দাজ বয়সে বিয়ে করছেন তখন তাঁর স্ত্রী-র বয়স ৬। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন ১৪ বছর বয়সে বিয়ে করলেন তখন তাঁর স্ত্রী-র বয়স হল ৮। বঙ্কিমচন্দ্র যখন ১১ বছর বয়সে বিয়ে করলেন তখন তাঁর স্ত্রী-র বয়স মাত্র ৫। এরকম একটা দিনেই আলমারিতে শোভা পেতে লাগলো বিলিতি পোর্সিলিনের পুতুল। সময় সময় তা নেমে আসতো পুতুল খেলুড়ির হাতে। তাই একদিকে পোর্সিলিন সুন্দরীরা সেদিন বধূর খেলার সাথী, আবার অন্যদিকে হয়তোবা বাঙালি ছেলেদের স্বপ্নে বোনা শ্বেতাঙ্গিনী। কিন্তু এবার শুরু হল এক নতুন কাহিনী।

সে কাহিনী পোর্সিলিনের সামগ্রী নির্মাণে বাঙালি উদ্যোগের কাহিনী। পোর্সিলিন সামগ্রী কিনতে বিলিতি নির্ভরতা থেকে বেড়িয়ে আসার কাহিনী। পুতুলের সংগ্রহে হগ মার্কেটের তালিকার অপেক্ষায় না থাকার কাহিনী অথবা ইংল্যান্ড থেকে বিলিতি পুতুল কবে আসবে তার জন্যে জাহাজ ঘাটায় বিলিতি জাহজের ভোঁ এর অধীর অপেক্ষা না করার এক বিরল গল্প।

১৮৯১। শুরু হল বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল কনফারেন্স। ওই সময় স্থাপন করা হল ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাসোসিয়েশন। এই সংস্থা বেশ কয়েকজন বাঙালি প্রযুক্তিবিদকে বিদেশে শিক্ষা লাভের জন্যে বৃত্তি দিয়েছিলো। এবং তাঁরা দেশে ফিরে কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের পত্তন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ক্যালকাটা পটারি ওয়ার্কসের স্থপতি ছিলেন সত্যসুন্দর দেব। ১৯০১ সালে রাজমহলের কাছে যখন চীনামাটির আবিষ্কার হল তখন কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী ও বহরমপুরের বৈকুণ্ঠনাথ সেন আর হেমচন্দ্র সেন চীনামাটির ব্যবসা শুরু করলেন। আর ১৯০৬ সালে সত্যসুন্দর দেব জাপান থেকে সিরামিক বিদ্যার প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এলেন। ৪৫ নম্বর ট্যাংরা রোডে স্থাপন করলেন ক্যালকাটা পটারি ওয়ার্কস। সেখানেই একে একে তৈরি হতে লাগলো পুতুল, গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যাওয়া অস্টিন ট্যাক্সি গাড়ি-র মডেল, দোয়াত, ইন্সুলেটর প্রভৃতি। দেখতে দেখতেই বনেদি বাড়ির টেবিলে উঠলো দোয়াত আর আলমারিতে বিলিতি পুতুলকে টেক্কা দিয়ে নিজের স্থান করে নিলো দিশি পোর্সিলিনের পুতুল। বলতে গেলে বাঙালির উদ্যোগেই ছোট্ট নব বঁধুটি পেলো দিশি সই আর বাড়ির ছেলের চোখে তখন নতুন ভাবে ফিরে এলো দিশি মেমের স্বপ্ন আর ‘ট্যাক্সি’- বলে ডাক দেওয়ার রেওয়াজ। তাই বলতেই হয় আজও বিলিতি আর দিশি সেসব পুতুলের গায় জড়িয়ে আছে একটা সময়কাল আর বিলিতির বিপ্রতীপে বাঙালির উদ্যোগের এমন জাতীয় চেতনার ইতিহাস।