No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    লেপচা জগৎ : পাইনে ঘেরা মেঘাচ্ছন্ন পথ আর স্পষ্ট কাঞ্চনজঙ্ঘা

    লেপচা জগৎ : পাইনে ঘেরা মেঘাচ্ছন্ন পথ আর স্পষ্ট কাঞ্চনজঙ্ঘা

    Story image

    কালে ছিল দুধ সাদা রং। বেলা বাড়ার পর কেমন যেন নীলাভ চেহারা নিল। সন্ধের আগে রং বড়ো আবছা, বিষণ্ণ। শহরের কোলাহল মানুষকে ব্যস্ত রাখে, মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেয়; অথচ পাহাড়ের উদাত্তচরিত্র জীবনকে বড়ো হতে শেখায়, উদার করে। হিমালয়ের কোলে ছোট্ট গ্রাম লেপচা জগৎ তেমন এক জায়গা। যে জগতে বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী ও দীক্ষিতদের বাস৷ বিভিন্ন সূত্র মারফত জানলাম, ‘লেপচা’ (Lepcha) শব্দটি নেপালি ‘লাপচে’ নামের এক প্রকার অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির মাছের নাম থেকে এসেছে। মূলত লেপচারা অত্যন্ত নিরীহ জাতি, বোধহয় সেই কারণে নিজেরাই এ নাম দিয়েছেন। বর্তমানে নেপাল ছাড়াও সিকিম, দার্জিলিং ও ভুটানে লেপচাদের নিয়মিত উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। লেপচা জগৎ আসলে লেপচাদের নিজস্ব স্বর্গরাজ্য।

    দার্জিলিংয়ের (Darjeeling) অদূরে লেপচা জগৎ (Lepcha Jagat)। সেখানে যেন কেউ অতিথি নয়, আন্তরিকতায় পূর্ণ লেপচা জগতে সবাই সবার আত্মীয়। হাতে গোনা কয়েকটা হোম-স্টে। সেখানে আরাম করে দিন তিনেক কাটিয়ে দিতে পারেন। বলা বাহুল্য, আতিথেয়তায় কোনো ঘাটতি হবে না। নেই কোনো লোক ঠকানো ব্যবসাও। এছাড়াও লেপচায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের নেচার রিসর্ট।

    লেপচা জগতে আপনাকে স্বাগত

    ঘন পাইনের সারি

    ঢালু রাস্তা বরাবর হাঁটলে দুই দিকে ঘন সবুজ পাইন গাছের সারি। কখনও মেঘাচ্ছন্ন, কখনও মৃদু আলোর ঝলকানি। হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যাওয়া যায় কোন সুদূর। তবে খবরদার! রাত ৮টার পর হেঁটে হেঁটে বেশি দূর নয়। স্থানীয় লোকজন বলেন লেপার্ডের ভয়।

    ঢালু রাস্তা বরাবর হাঁটলে দুই দিকে ঘন সবুজ পাইন গাছের সারি। কখনও মেঘাচ্ছন্ন, কখনও মৃদু আলোর ঝলকানি। হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যাওয়া যায় কোন সুদূর।

    সাধারণত এইসব জায়গা যাওয়ার আদর্শ সময় জিজ্ঞাসা করলে অনেকেই বলবেন অক্টোবর-নভেম্বর। কিন্তু বিশ্বাস করুন বর্ষায় অপরূপ লেপচা জগৎ আপনাকে মোহগ্রস্ত করবে। মেঘ আর রোদের খেলায় কখন যে আপনার হোম স্টের জানলা থেকে একফালি কাঞ্চনজঙ্ঘা (Kangchenjunga) উঁকি দেবে, বুঝতেই পারবেন না। আকাশ পরিস্কার থাকলে লেপচা জগৎ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার আদর্শ জায়গা পাইন বনের চূড়া। তার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট পথ। তবে বর্ষায় জোঁক হইতে সাবধান।

    দৃশ্যমান কাঞ্চনজঙ্ঘা

     

     

    লেপচা জগতে সামান্য হাঁটাহাঁটি আর পাইন বনের সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি মাত্র আধ ঘণ্টার জার্নি করে চলে যান সীমানা (Simana) অর্থাৎ নেপাল বর্ডার (Nepal Border)। নাহ, এখানে যেতে কোনো পাসপোর্ট লাগবে না। লাগবে শুধু দেখার চোখ। বারোমাস মেঘেদের অবাধ্য ভেসে যাওয়া হয়ে উঠবে রোমহষর্ক। সীমানায় স্থানীয় একটি বাজার বসে প্রতিদিন সকালে। গরম জামাকাপড়, টুপি, ঘর সাজাবার সামগ্রী, বুদ্ধের মূর্তি আর নেপালি চকোলেট আপনাকে কাছে ডাকবে। দূরে চোখ মেললে দেখা যাবে সুদৃশ্য নেপাল, সেখানকার বাড়িঘর, রাস্তা, চা-বাগান। কফির কাপে চুমুক দিয়ে আর অতি অবশ্যই নেপালি চকোলেটকে সঙ্গী করে সীমানা থেকে চলে যান জোড়পোখরি।

    দূরের নেপাল

    সীমানা বাজার

    জোড়পোখরির (Jorepokhri) অসামান্য এক ইতিহাস রয়েছে। নেপালি ভাষায় ‘জোড়’ শব্দের অর্থ জোড়া বা দুই, ‘পোখরি’ অর্থে জলাশয় বা লেক। দুটি জলাশয়ের সংযোগস্থলে কৃত্রিমভাবে নির্মিত হয়েছিল এই বনভূমি। শোনা যায়, ১৯৬৪ সালে প্রথম বিলুপ্তপ্রায় সালামান্ডার্স (Salamanders) দেখা গিয়েছিল এখানে। ১৯৮৫ সালে জোড়পোখরিকে অভয়ারণ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। জোড়পোখরি অভয়ারণ্যের অন্যতম আকর্ষণ বিলুপ্তপ্রায় টিকটিকি প্রজাতির স্যালামান্ডারের। পূর্ব হিমালয়ের চার হাজার থেকে আট হাজার ফুট উচ্চতায় তাদের মূল বসতি। ডায়নোসর যুগের আগে থেকে যে সব প্রাণীর রাজত্ব ছিল পৃথিবীর বুকে, তাদের মধ্যে অন্যতম এবং প্রাচীন এই স্যালামান্ডার। মেঘ গায়ে মেখে, ঝিঁঝির সুরেলা আওয়াজের মধ্যে জঙ্গলে পায়চারি করলে মন দ্রুত ভালো হয়ে যাবে নিশ্চিত।

    জোড়পোখরি

    বর্তমানে নেপাল ছাড়াও সিকিম, দার্জিলিং ও ভুটানে লেপচাদের নিয়মিত উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। লেপচা জগৎ আসলে লেপচাদের নিজস্ব স্বর্গরাজ্য।

    এর পাশাপাশি লেপচা জগৎ থেকে কয়েক ঘণ্টায় যাওয়া যায় তাকদা বাজার (Takdah), বড়ো ও ছোটো মাঙ্গোয়া, লামাহাট্টা (Lamahatta), মিরিক (Mirik) এবং তিনচুলে (Tinchuley)। আবার ঘুরে আসা যায় দার্জিলিং থেকেও। লেপচায় সর্বসাকুল্যে চারটে দোকান। সেখানে খাবার বলতে চা, কফি, মোমো, ম্যাগি, পানীয় জল আর সিগারেট। লেপচায় সন্ধে নামলে হীরের মতো জ্বলজ্বল করে দূরের দার্জিলিং শহর।

    লেপচা জগৎ থেকে রাতের দার্জিলিং

    লেপচা জগৎ মুড়ে রেখেছে ঘন পাইনের সারি। সেখানে সারা বছরই কুয়াশা আর মেঘের চাদরে মোড়া। ছোঁয়া যায় আকাশের মেঘ, হাত ভিজে যায়। নাম না জানা কত কত পাখির দল উড়ে বেড়ায় এখানে। চোখে পড়ার মতো বিষয়, প্রায় প্রত্যেক হোম স্টে-তেই একটি করে পোষ্য আছে। সকলেই কী ভীষণ শান্ত। মানুষের মতো ওরাও আপনাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাবে। 

       কীভাবে যাবেন   

    শিয়ালদহ বা হাওড়া থেকে যেকোনো উত্তরবঙ্গগামী ট্রেন ধরে শিলিগুড়ি জংশন অথবা নিউ জলপাইগুড়ি। তারপর সেখান থেকে গাড়ি রিজার্ভ করার ব্যবস্থা আছে৷ খরচ মোটামুটি ২০০০ টাকা। খরচ কমাতে চাইলে শেয়ার গাড়ি ধরুন। মাথাপিছু খরচ পড়বে ২৫০-৩০০ টাকা। প্রায় তিন ঘণ্টার জার্নি করে পোঁছে যান ঘুম স্টেশনে। সেখান থেকে আবার শেয়ার গাড়ি ধরে পৌঁছান লেপচা জগৎ। এক্ষেত্রে খরচ মাথাপিছু ৫০ টাকা। ঘুম থেকে লেপচা জগৎ মাত্র ৭ কিলোমিটারের পথ।

       কেমন খরচ   

    অফ সিজনে খরচ যৎসামান্য। পুজোর আগে ভ্রমণ করতে চাইলে সামান্য খরচে ঘোরা যায় লেপচা জগৎ। হোম স্টে-তে এক রাতের জন্য খরচ পড়তে পারে ২০০০-৩০০০ টাকা। চার বেলা খাবার পাবেন এই টাকার মধ্যেই।

    _______

    ছবিঃ সুমন সাধু

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @