রামমোহনের ওপর আক্রমণ আসলে বাংলার ইতিহাস বদলের চেষ্টা

সতীপ্রথা মোটে খারাপ ছিল না। মুঘল খিলজিদের আক্রমণ থেকে বাঁচতেই জহরব্রত নিতে বাধ্য হতেন পদ্মাবতীর মতো ভারতীয় নারীরা। পরে রাজা রামমোহন রায়ের মতো বিশ্বাসঘাতকদের সাহায্যে ব্রিটিশরা ষড়যন্ত্র করে সতীপ্রথাকে একটি নিষ্ঠুর প্রথায় পরিবর্তন করেন। মুঘল অনুপ্রবেশকারীদের বেশ্যায় পরিণত হওয়া থেকে বাঁচতেই ভারতীয় নারীরা স্বেচ্ছায় সতী হতেন। কেউ কখনো তাদের সতী হতে বাধ্য করেননি। ‘ব্রিটিশদের চামচা’ রামমোহনই সতীপ্রথা নিয়ে অপপ্রচার ও কুৎসা করে বেরিয়েছেন।
ওপরের কথাগুলোর মালকিন স্বনামধন্য অভিনেত্রী পায়েল রোহাতগি। স্বনামধন্য বলার পরেও যারা চিনতে পারছেন না, তাদের বলি-- কর্পোরেট, ঢোল, ৩৬ চায়না টাউন, দিল কবাড্ডি-র একাধিক বলিউডি সিনেমায় তিনি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছেন। এছাড়া মডেলিং করেছেন। তাঁর অভিনয়খ্যাতি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না, তার জন্যেও হয়তো বলিউডের নানা ‘বিশ্বাসঘাতক’ কিংবা বিরোধীপক্ষের ‘চামচা’ দায়ী। অভিনয়গুণে মাত না করলেও পায়েল বারবারই অবশ্য খবরের শিরোনামে এসেছেন।
ইদানীং, যেমন তিনি শিরোনামে থাকছেন টুইটারে বোমা ফাটিয়ে। তাঁর টুইটার হ্যান্ডেলের নাম ‘পায়েল রোহতগি অ্যান্ড টিম-ভক্তস অব ভগবান রাম’। রামভক্ত হওয়া মোটে দোষের নয়। এই বাজারে তো আরোই নয়। রামভক্ত এবং একইসঙ্গে রাজনীতি-সচেতন হিসেবে হিসেবে তিনি তাঁর পছন্দের দল নিয়েও নানা প্রশংসা-প্রচার করতে পারেন। গণতান্ত্রিক দেশে সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু, হঠাৎ করে তিনি রাজা রামমোহনকে পাকড়াও করতে গেলেন কেন, সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।
এই টুইটের পরে পায়েলকে এক হাত নিয়েছেন অনেকে। অনেকেই বলছেন, পায়েল সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে এইসব বকেন। এটাই তাঁর শিরোনামে থাকার স্ট্র্যাটেজি। অতএব, বেশি পাত্তা দিয়ে লাভ নেই। সত্যিই, এই টুইট-বোমার পর থেকে কীভাবে যেন রামমোহন রায় আর পায়েল রোহাতগি রীতিমতো জুটি বেঁধে ট্রেন্ডিং হয়ে গেছেন নেট দুনিয়ায়। গুগলে রাজা রামমোহন রায় লিখে সার্চ দিলে পায়েলের টুইট প্রসঙ্গ ভেসে আসছে। পায়েলকে নিয়ে সার্চ দিলে ভেসে আসছেন রাজা রামমোহন রায়। রামমোহন রায়ের অবশ্য এতে হাত নেই। তিনি ‘চামচাগিরি’ করে ইংরেজদের সঙ্গেও হাত মেলাবেন আবার মৃত্যুর ১৮৬ বছর পরে পায়েলের মতো নব্য দেশভক্ত (থুড়ি রামভক্ত)-র সঙ্গেও জুটি বাঁধবেন—তা কী করে হয়!
আরও পড়ুন
‘ট্রোলে’ ভুবন ভরিয়ে দেবে, ভেবেছিল...
মজা করেই গোটা ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু যাচ্ছে না। প্রথম কারণ, পায়েলের এই টুইটকে সমর্থন করেহেন অসংখ্য মানুষ। মানে তারাও মনে করেন, সতীপ্রথা ভালো। তারাও মনে করেন, মুঘল অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে বাঁচতেই ভারতীয় নারীরা স্বেচ্ছায় সতী হতেন। মনে করেন, এই প্রথায় কোনো জোরাজুরি, নিষ্ঠুরতা ছিল না। এমনকি তারা এটাও মনে করেন, যে সতীপ্রথাকে খারাপ করে দিয়েছেন ‘ব্রিটিশদের চামচা’ রামমোহন। যিনি আবার ‘বিশ্বাসঘাতক। টুইটারে নেই, এমন অনেক মানুষও নিশ্চয়ই পায়েলের মতের সমর্থক। তারা এই দেশেরই নাগরিক। একই ইতিহাসের শরিক। এইটা ভাবলেই আর ব্যাপারটা নিছক মজার থাকে না।
এতদিন আমরা জানতাম, রাজা রামমোহন রায় নবজাগরণের প্রথম ও অন্যতম প্রধান পুরুষ। যে নবজাগরণ এই দেশের ধর্মীয় গোঁড়ামির অন্ধকার দূর করে একটা নতুন আলোর দিশা দেখিয়েছিল। অবশ্যই তার আড়ালে ব্রিটিশ প্রভুদের পরিকল্পনা ও ছক ছিল। কিন্তু তারপরেও আধুনিক শিক্ষা, স্কুল-কলেজ, নারী শিক্ষা, যুক্তিবাদের জন্ম, বিজ্ঞান চর্চা, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জন্ম, সাহিত্যের বাঁকবদল—গোটাটাকে নস্যাৎ করা যায় নাকি! পায়েল নিজে যে শিক্ষা, স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে কথাগুলি লিখছেন, সেগুলি আদৌ আসত কি উনিশ শতকে রামমোহন ও অন্যান্যদের ভূমিকা অন্যরকম হলে? আর, সতীদাহ ভালোপ্রথা ছিল! এই কথার বিরোধিতা করব কোন যুক্তিতে, সেটাই জানা নেই আসলে। ভাবিই তো নি যে একদিন এমন মতামতও ফের উজিয়ে উঠতে পারে।
ইতিহাস বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এই যেমন, পায়েল আমাদের শেখালেন খিলজিরাও আসলে মুঘল। ১৩২০ সাল নাগাদ খিলজি সাম্রাজ্যের পতন আর ১৫২৬-এ মুঘল সাম্রাজ্যের শুরু। সে যাহোক, পায়েল আমাদের শেখালেন ‘মুঘলদের’ বেশ্যায় পরিণত হতে না চেয়েই স্বেচ্ছায় সতী হওয়ার ইতিহাস। আচ্ছা, নেপালে কি মুঘলরা গেছিল কখনো? সেখানে সতীপ্রথা চালু হল কেন? কাদের হাত থেকে বাঁচতে? গুপ্তযুগেও সতীপ্রথার ইতিহাস মিলছে। তখনো কি মুঘলরা ছিল? আর, রামমোহনের সময়েও কোন ‘মুঘল বামুন’-রা জোর করে সতীদের চিতায় তুলত? না, পায়েল কিছু বলছেন না।
ইতিহাস বদলে যাচ্ছে। তাই রামমোহন হয়ে উঠছেন ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘ইংরেজদের চামচা’। অনেকে হাততালি দিচ্ছেন। রামমোহন কেন পায়েলের মতো রামভক্তদের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, তা অবশ্য বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। একটা মানুষ সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। তাঁর বিরুদ্ধপক্ষ মোটে কম শক্তিশালী ছিল না। সেই পক্ষেও ইংরেজ প্রভুদের পা চাটা ‘রাজা বাহাদুর’ কম ছিলেন না। একটা জেদি মানুষ বেদ, উপনিষদ ছেনে ছেনে প্রমাণ করলেন সতীদাহ প্রথা বেদ-বিরোধী। শুধু একটা নিষ্ঠুর প্রথা নয়, ব্রাহ্মণ্যধর্মের আগ্রাসী চরিত্রটাকেই যেন আঘাত করলেন। ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা করলেন। এই দেশের আধুনিকতার ইতিহাস তাঁকে মাথায় করে রাখলেও পায়েলের মতো হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখা মানুষদের কাছে তিনি তো বিশ্বাসঘাতক, ব্রিটিশদের চর-ই হবেন। তা নাহলে ইতিহাস বদলে নেওয়া যাবে না তো।
পায়েল যাদের সমর্থক, যাদের পক্ষে খোলাখুলি কথা বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তাদের ব্রিটিশপ্রেমের ইতিহাস নিয়ে তিনি চুপ কেন? তার ফলোয়াররাই বা চুপ কেন? তখন অবশ্য, অন্য দ্বন্দ্ব সামনে চলে এসেছিল। মুসলমানরা প্রধান শত্রু, ব্রিটিশরা নয়।
আরও পড়ুন
সব মূর্তি নিছক ‘মূর্তি’ হয় না
সতীদাহ প্রথার সমর্থনে মুখ খোলা খুব সম্ভবত বেআইনি। তাতেও পায়েলের কিচ্ছু যায় আসে না। তিনি ও তার ফলোয়াররা বেপরোয়া। এবং হয়তো জানেন, তাঁর কোনো শাস্তিই হবে না।
কয়েকদিন আগেই বিদ্যাসাগর মূর্তি ভাঙা পড়েছে। তার কিছুদিনের মধ্যেই রামমোহনকে এই ভাষায় আক্রমণ। রাজনৈতিক পক্ষপাত ভুলে একটু ব্যাপারটার ভিতরে তাকাই চলুন। দেখব, বাংলার তথা ভারতের একটা গৌরবের ইতিহাসকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে আগ্রাসী হিন্দুত্বের বয়ান। সেই বয়ানের সামনে চ্যালেঞ্জ রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ। চ্যালেঞ্জ চৈতন্যদেব, বাংলার রেনেসাঁ। চ্যালেঞ্জ এই রাজ্যের ইতিহাসটিও। সবার ওপরই একে একে আক্রমণ নামবে। নানা দিক থেকে, নানাভাবে। ইতিহাস ভোলানোর খেলা শুরু হয়েছে যে।
অতএব, পায়েল রোহাতগি যতই সস্তা জনপ্রিয়তাপ্রেমী হোন না কেন, তাঁর বক্তব্যকে ছাড় দেওয়া যায় না। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রেনেসাঁ, বাংলার ইতিহাস—আক্রমণটা আসলে আমাদের ওপরেও নামছে।