No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    নজরুলের কাছে শ্যামা মা হয়ে উঠেছিলেন স্বয়ং দেশমাতৃকা  

    নজরুলের কাছে শ্যামা মা হয়ে উঠেছিলেন স্বয়ং দেশমাতৃকা  

    Story image

    কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহ শুধু ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে ছিল না, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও ছিল তাঁর সংগ্রাম। দাঙ্গাবাজ মৌলবাদীদের সম্পর্কে তিনি ‘মন্দির মসজিদ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “ইহারা ধর্ম-মাতাল। ইহারা সত্যের আলো পান করে নাই, শাস্ত্রের অ্যালকোহল পান করিয়াছে।” গানে কবিতায় তাঁর অমোঘ ঘোষণা, “‘হিন্দু না ওরা মুসলিম’– ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? / কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র!” 
        
    নজরুল ছিলেন ভক্তিবাদী। পুজোর বাহ্যিক আড়ম্বরে তাঁর বিশ্বাস ছিল না। “তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার, / তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার। / কেন খুঁজে ফেরো দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি-কঙ্কালে? / হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে!” – এমনই ছিল তাঁর মত। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একক সত্যকে তিনি উপলব্ধি করতে চেয়েছিলেন, যা সব রকম ভেদাভেদের ঊর্দ্ধে। তিনি জন্মসূত্রে ছিলেন মুসলিম। হিন্দুদের সঙ্গেও অন্তরঙ্গভাবে মিশেছেন ছোটোবেলা থেকেই। মক্তবে শিখেছেন ইসলাম ধর্মের যাপন, লেটো গানের দলে যোগ দিয়ে জেনেছেন হিন্দু ধর্মের নানা ঐতিহ্য। পরবর্তীকালে মানবতাবাদী কমিউনিস্ট মতাদর্শের সংস্পর্শেও এসেছিলেন। তাঁর হৃদয়ে সব মতেরই সহাবস্থান ঘটেছিল। তাই সাবলীলভাবেই সৃষ্টি করে গিয়েছেন একের পর এক দেশাত্মবোধক গান, গজল, ইসলামি গান, শ্যামাসংগীত, ভজন, কীর্তন ও আরও নানা ধরনের গানের বৈচিত্রময় সমাহার। 

    বঙ্গভূমি প্রাচীন কাল থেকেই শক্তি উপাসনার জন্য প্রসিদ্ধ। শক্তি পূজিতা হন মাতৃরূপে। বহু মাতৃদেবীর বন্দনায় মুখরিত এই বাংলা। সেই মাতৃশক্তিরই এক বিশেষ রূপ কালী বা শ্যামা। তাঁকে নিয়ে প্রাগাধুনিক কাল থেকেই রচিত হয়েছে প্রচুর গান। সাধক কবি রামপ্রসাদের গান তো সর্বজন বিদিত। এছাড়া কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, দাশরথি রায়, অ্যান্টনি কবিয়াল, গিরিশচন্দ্র ঘোষের মতো পদকর্তারাও শ্যামাসংগীত রচন করে খ্যাতি পেয়েছেন। বাংলা গানের এমন ঐতিহ্যময় ধারায় আকৃষ্ট হয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলামও। দেবী কালীর আরাধনায় তিনি ব্রতী হয়েছেন। গৃহী যোগী বরদাচরণ মজুমদারের কাছে তন্ত্রসাধনা করেছিলেন তিনি। নজরুলের কয়েকটি গানে তান্ত্রিক ভাবধারার পরিচয় মেলে। যেমন – “শ্যামা নামের লাগল আগুন আমার দেহ ধূপ–কাঠিতে। / যত জ্বলি সুবাস তত ছড়িয়ে পড়ে চারিভিতে।।/ ভক্তি আমার ধূমের মতো / ঊর্দ্ধে ওঠে অবিরত, / শিব–লোকের দেব–দেউলে মা’র শ্রীচরণ পরশিতে।।” তন্ত্র মতে দেহই সব রকম সাধনার আধার। কুলকুণ্ডলিনী শক্তি জাগরিত হয় নিচু থেকে ওপরের দিকে। গানটিতে সেই কথাই রূপকের আকারে প্রকাশিত।

    স্বাধীনতা সংগ্রামী নজরুলের কাছে শ্যামা মা হয়ে উঠেছিলেন স্বয়ং দেশমাতৃকা। শক্তি আরাধনার প্রভাব তাঁর কবিতাতেও পড়েছে। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতায় লিখেছিলেন, “অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা, / আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা। / দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা/ দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা।” এটি লেখার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে কারাবন্দি করে।

    অবশ্য শুধু মাতৃরূপে নয়, কন্যারূপেও নজরুল কালীর বন্দনা করেছেন, “আদরিণী মোর শ্যামা মেয়েরে / কেমনে কোথায় রাখি। / রাখিলে চোখে বাজে ব্যথা বুকে / (তারে) বুকে রাখিলে দুখে ঝুরে আঁখি।।”

    নজরুলের এই সমন্বয়পন্থী উদ্যোগকে মৌলবাদীরা আঘাত করেছে বারবার। কট্টর হিন্দুদের কাছে তিনি ছিলেন বিজাতি। কট্টর মুসলমানরা তাঁকে কাফের আখ্যা দিয়েছিল। পূর্ববঙ্গের রেডিওতেও এক সময়ে নজরুলের শ্যামাসংগীত বাজানো নিষিদ্ধ হয়েছিল। এত কিছুর পরেও নজরুলের ভাবাদর্শকে ধ্বংস করা যায়নি। বাংলার মাটি চিরকাল সম্মিলন এবং ঐক্যের বার্তাকেই প্রাধান্য দেয়।

    তথ্যঋণ – অভীক চট্টোপাধ্যায়, রিফাত বিন সালাম রূপম। 
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @