মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং সমতার মৌলিক ধারণাগুলো আজ কোথায়?

ছবি- সংগৃহীত
রবীন্দ্রনাথই শেষ কথা বলে গেছেন।
“হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!
মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।”
ইউনাইটেড নেশনস বা রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ১০ ডিসেম্বর, ১৯৪৮ মানবাধিকারের উপর সার্বজনীন ঘোষণার খসড়া সিদ্ধান্তটি অনুমোদিত হয়। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র (Universal Declaration of Human Rights অথবা UDHR) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত একটি ঘোষণাপত্র বা আন্তর্জাতিক দলিল, যা সমস্ত মানুষের অধিকার এবং স্বাধীনতাকে আইনসম্মত একটা চেহারা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাক্টিভিস্ট ফার্স্ট লেডি ইলেনর রুজভেল্টের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রসঙ্ঘের এক কমিটি কর্তৃক খসড়া তৈরি করা হয়, এবং প্যারিসে ইউ এন’এর তৃতীয় অধিবেশন চলাকালীন সাধারণ পরিষদ কর্তৃক রেজোলিউশন ২১৭ হিসাবে গৃহীত হয়।
প্রত্যেক মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে এই সনদ ঘোষিত হয়।
ঘোষণাপত্রে নিম্নলিখিত ক্লজগুলি রয়েছে:
ঘোষণাপত্র অনুচ্ছেদ ১-২ – মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং সমতার মৌলিক ধারণাগুলি প্রতিষ্ঠা করে।
অর্থাৎ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ও জীবনচর্যা যাই হোক না কেন, মানুষের অধিকারকে বঞ্চিত করা চলবে না। (রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর একবার দ্রষ্টব্য।)
সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং প্রতিষ্ঠানগত সমাজবাদের পতনের পর সমানাধিকারের সংজ্ঞা একটু একটু করে লোপ পেয়ে গেছে, এ আমরা নিজের চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। তার জন্যে কমিউনিস্ট হওয়ার দরকার নেই। ঘটনা হলো, বার্লিন ওয়াল পতনের পর বিশ্বজুড়ে বৈষম্য প্রবলভাবে এবং দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনৈতিক সমানাধিকার, সামাজিক সমানাধিকার, এবং লিঙ্গ সমানাধিকারের যে কনসেপ্ট একটু একটু করে আমজনতা তৈরি করেছিল, যেসব মৌলিক মানবাধিকার একটু একটু করে অর্জন করেছিল, তা দ্রুত অবলুপ্ত হয়েছে – বিশেষ করে আমেরিকা, ব্রিটেন এবং ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে সেসব দেশের মেয়েরা। অর্থনৈতিক চাপে সর্বস্ব খুইয়ে পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক, লিথুয়ানিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ, হাঙ্গেরির মেয়েরা বিশাল সংখ্যায় দেহপজীবিনী হতে বাধ্য হয়েছে – এ কথা সর্বজনবিদিত। হিউমান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ইত্যাদি সংগঠনের পাতা ওল্টালেই দেখা যায়।
ঠিক যেমন নেপালের ভূমিকম্প বিপর্যয়ের পরে কলকাতার রেড লাইট এলাকায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সেক্স ওয়ার্কার আজ নেপালি ইমিগ্র্যান্ট সম্প্রদায়ের।
মানবাধিকার কোথায়?
ঘোষণাপত্র অনুচ্ছেদ ১২-১৭ – প্রতিটি রাষ্ট্রের মধ্যে চলাচল ও বসবাসের স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার এবং জাতীয়তার অধিকার সহ যে কোনো সম্প্রদায়ের যে কোনো ব্যক্তির অধিকারগুলি নির্ধারণ করে।
মনিপুরের ঘটনাই রয়েছে চোখের সামনে। এবারে ভেবে দেখুন, শবরীমালা মন্দিরে নারীদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা। ভেবে দেখুন, গুজরাট, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং আরো অনেক জায়গায় আজ এই দুহাজার তেইশের ডিসেম্বরেও কেবলমাত্র দলিত হওয়ার জন্যে ব্রাহ্মণ বা অন্য উঁচু জাতের লোকেরা তাদের রাস্তায় শুইয়ে রেখে তাদের পিঠের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে।
আমাদের এখানে এই আমেরিকাতেও নিজের চোখে দেখেছি, নিম্নবর্ণের শ্রমিকরা মন্দির তৈরি করে দিলো। কিন্তু তার ভিতরে তাদের প্রবেশাধিকার নেই। প্রচণ্ড শীতেও মন্দিরের বাইরে বসে লাঞ্চ খাচ্ছে ব্রাউন ব্যাগ থেকে বের করে।
তারপর আছে কৃষ্ণবর্ণের মানুষদের ওপর আমেরিকার পুলিশের নির্মম অত্যাচার – এই দুহাজার তেইশের ডিসেম্বর মাসেও। একশো, দুশো বছর ধরে যে অবর্ণনীয় অত্যাচার ব্ল্যাকরা সহ্য করেছে, তার নিরসন এখনো হয়নি, তা সে রাষ্ট্রসঙ্ঘ যতই সনদ প্রকাশ করুক না কেন।
এবারে ভেবে দেখুন, শবরীমালা মন্দিরে নারীদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা। ভেবে দেখুন, গুজরাট, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং আরো অনেক জায়গায় আজ এই দুহাজার তেইশের ডিসেম্বরেও কেবলমাত্র দলিত হওয়ার জন্যে ব্রাহ্মণ বা অন্য উঁচু জাতের লোকেরা তাদের রাস্তায় শুইয়ে রেখে তাদের পিঠের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে।
উগ্র ধর্মান্ধ প্রজাতির হিন্দুরা এই আরএসএস বিজেপি জমানায় মুসলমানদের ওপর যে অত্যাচার নতুন করে শুরু করেছে, তার কথা তো মহাভারত। সে বলতে গেলে আর একটা বই লেখা হয়ে যাবে।
ঘোষণাপত্র অনুচ্ছেদ ১৮-২১ – তথাকথিত “সাংবিধানিক স্বাধীনতা” এবং আধ্যাত্মিক এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা, যেমন চিন্তা, মতামত, মতপ্রকাশ, ধর্ম ও বিবেকের স্বাধীনতা, সমাজ ও ব্যক্তির শান্তিপূর্ণ সংগঠন এবং যে কোনও মিডিয়ার মাধ্যমে তথ্য এবং ধারণা গ্রহণ ও প্রদানকে অনুমোদন করে।
মিডিয়ার কথা একটু বিশেষভাবে বলা দরকার। আজকের পৃথিবীতে প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়া প্রায় সম্পূর্ণভাবেই কর্পোরেট জগতের হাতে চলে গেছে। যেদিন থেকে সমাজবাদ ও সমাজবাদ-পথানুসারী রাষ্ট্রের অবক্ষয় শুরু হয়েছে, বে-লাগাম বেসরকারিকরণ শুরু হয়েছে সেই সময় থেকেই। এবং সংবাদমাধ্যম তার সবচেয়ে বড়ো শিকার। কমিউনিস্ট দেশগুলোতে মিডিয়া কাজ করতো কেবলমাত্র রাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসেবে। সেখানে একধরনের কঠিন নিষ্পেষণ এবং নিয়ন্ত্রণ ছিল, বলাই বাহুল্য। কিন্তু একটা জিনিস ছিল, তা হলো, খবর এবং তথ্য প্রচারের আগে একটা ব্যালান্স ছিল, একটা কোয়ালিটি কন্ট্রোল বা গুণগত মান নির্ণয়ের ব্যাপার ছিল। এবং সত্য ও মিথ্যা যাচাইয়ের একটা ব্যাপার ছিল। আজ আর তা নেই এই কর্পোরেট বাণিজ্যের মিডিয়ার দিনে। প্রাইভেট মিডিয়া এখন আর জনমুখী সংবাদ প্রচারের কোনো দায়িত্ব নেয় না, কারণ একমাত্র লক্ষ্য হলো খোলা বাজারে সংবাদ নামক পণ্য বিক্রি করে মুনাফা করা।
আরও পড়ুন: যখন শিশুদের ঘুম ভাঙে গুলি-গোলার আওয়াজে
আমি আগেও অনেকবার বলেছি আমার বিভিন্ন আলোচনায় যে সিএনএন, নিউ ইয়র্ক টাইমস, টাইমস নাও, ইন্ডিয়া টুডে, এবিপি আনন্দ, বিবিসি, ভারত বাংলাদেশের যে কোনো প্রাইভেট মিডিয়া সত্যভিত্তিক এবং নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনের কোনো দায়িত্ব আর নেবে না। কারণ, মিডিয়া এখন আর সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেই। তার সম্পূর্ণ প্রাইভেট মালিকানার হাতে। মিডিয়ার ড্রাইভিং ফোর্স অর্থাৎ চালিকাশক্তি মালিক এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের হাতে।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের এই অনুচ্ছেদ আজ প্রায় সম্পূর্ণ অর্থহীন। বিশেষ করে মার্কিনি কর্পোরেট মডেলে যে মিডিয়া হাউসগুলো চলছে, তাদের মুনাফা এবং টিআরপির চাপ এতই মারাত্মক যে একদিকে জনপ্রিয়তার প্রবল মোহ, অন্যদিকে যে কোনো খবরকে উত্তেজক প্যাকেজে পরিবেশন করা ঝাঁ চকচকে গাড়ি, পটেটো চিপস অথবা সুপারমার্কেট মলের বিক্রি ও মুনাফার সঙ্গে বিন্দুমাত্র পার্থক্য নেই। দুই দিকেই আছে একধরনের ফেটিশ, দুই দিকেই আছে অন্তঃসারশূন্যতা।
এবং দুই দিকেই আছে ব্যক্তিসর্বস্ব জীবনযাত্রার নতুন বাইবেল, বেদ, কোরান। এই ব্যক্তিসর্বস্বতা পশ্চিমী সভ্যতার সবচেয়ে বড়ো অবদান বলে আমি মনে করি।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার সনদ ইলেনর রুজভেল্ট তৈরি করেছিলেন পুঁজিবাদী কাঠামোর মধ্যে থেকেও একটা সমানাধিকারের কনসেপ্ট মানবজাতির কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে। গণতান্ত্রিক সমাজবাদী ইলেনর, তাঁর স্বামী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিরিশ দশকের মাঝামাঝি থেকে চল্লিশের মাঝামাঝি পর্যন্ত থাকা প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাংকলিন ডি রুজভেল্ট দুজনেই ছিলেন পুঁজিবাদী দেশের দুই বৈপ্লবিক ব্যক্তিত্ব। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের আমলে আমেরিকায় যেসব আইন পাশ হয়, তা সাধারণ মানুষের এবং শ্রমিক পুরুষ ও মহিলার প্রভূত কল্যাণসাধন করে। ঊনিশশো ঊনত্রিশের ওয়াল স্ট্রীট ক্র্যাশ এবং তার পরের কয়েক বছরের তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট – যা দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন বলে ইতিহাসে পরিচিত, তার থেকে আমেরিকাকে বের করে আনার পিছনের রুজভেল্টের জনমুখী আইন সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল। এবং গণতান্ত্রিক সমাজবাদী এক অর্থনৈতিক মডেল, যা জন মেনার্ড কেইন্স’এর নামানুসারে কেইন্সিয়ান অর্থনীতি বলে পরিচিত, তা বাস্তবায়িত হয়েছিল। এই অর্থনৈতিক মডেলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রমশঃ তার মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়কে দারিদ্র্য থেকে তুলে এনে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করে।
অর্থাৎ, রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার সনদ এবং গণতান্ত্রিক সমাজবাদী অর্থনীতি একে ওপরের পরিপূরক – এ কথা বললে কোনো ভুল হবে না। এই ক্রিটিক্যাল বিশ্লেষণ আজকের দিনে অত্যন্ত জরুরি।
সোশ্যাল মিডিয়ার দিবারাত্র ক্যাকোফোনিতে এসব বিশ্লেষণ প্রায় অনুপস্থিত। মানুষকে ক্রিকেট, বলিউড, আরো হাজার বিলাসিতার লোভ দেখিয়ে, মাদকাসক্ত করে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমাজবাদের পতনের পর থেকে এক তথাকথিত গ্লোবালাইজড, বিশ্বায়িত অর্থনৈতিক মডেল আমাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার আসল লাভ তুলেছে আজ আমরা যাকে বলি ওয়ান পার্সেন্ট, তারা, ফলে বৈষম্য তীব্রগতিতে বেড়ে গেছে। এবং এই বৈষম্য বেড়েছে মার্কিনি মডেল অনুসরণ করা দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি। যেমন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, এবং কিছুটা হলেও বাংলাদেশ।
সঙ্গে সঙ্গে সে বৈষম্য গ্রাস করেছে অনগ্রসর শ্রেণীগুলোকে সবচেয়ে বেশি। সঙ্গে সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে বড়ো শিকার হয়েছে তারাই। ভারতে মুসলমান, দলিত। আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ এবং প্রায় এক কোটি কুড়ি লক্ষ গরিব ইমিগ্রেন্ট – মেক্সিকান, ল্যাটিন আমেরিকান, বাংলাদেশী, ক্যারিবিয়ান, আফ্রিকান, চীনা। ব্রাজিলে এই সেদিন পর্যন্ত আর এক স্বৈরতান্ত্রিক জায়ের বোলসোনারো সেখানকার গরিবের গরিব আমাজন উপজাতিদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে, তাদের বাড়িঘর জঙ্গল জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় সেই নিকৃষ্টতম মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী দুই জাতি ব্রিটিশ ও আমেরিকান শাসকের মদতে বর্ণবৈষম্যবাদী বোথা কৃষ্ণাঙ্গদের মনুষ্যেতর জীবের মতো নির্যাতন করেছে।
এতো বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে সারা পৃথিবী জুড়ে যে একটা লেখায় সব কথা লেখা যায় না।
ঘোষণাপত্র অনুচ্ছেদ ২২-২৭ – স্বাস্থ্যসেবা সহ কোনও ব্যক্তির অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকারকে অনুমোদন করে। জীবনযাত্রার মানের বিস্তৃত অধিকারকে এই সনদ সমর্থন করে, এবং মাতৃত্ব বা শৈশবে দেওয়া যত্নের বিশেষ উল্লেখ করে।
তা, সেসব কথা আবার পরে বলা যাবে এখন। তারপর আছে, সুস্থ পরিবেশ ও জলবায়ুর অধিকার। রাষ্ট্রসঙ্ঘ যেসব কথা সে সময়ে বলার প্রয়োজন অনুভব করেনি। আজ সে মানবাধিকার এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার।
“মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছো যারে ...”