Parted Crafts : দুই বাংলার কারুশিল্পে দেশভাগ-ভিটে-পরিজনের স্মৃতি

শতবর্ষ পেরনো বেনারসি শাড়ি
কোথাও বিছিয়ে রয়েছে মা-বোনেদের হাতে বোনা শাড়ি, যার আঁচল জুড়ে কারিগর বুনে দিয়েছেন তাঁর জীবনের নানা রঙের গল্প। কোথাও বা দেওয়াল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ফ্রেমে বন্দি হয়েছে দেশভাগের সময়কার নানান দলিল, চিঠি, জরুরি নথিপত্র। চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সাতচল্লিশের দেশভাগ, ছিন্নমূল মানুষের যন্ত্রণার ইতিহাস। আবার নতুন জায়গায় চলে এসে একটু একটু করে আস্তানা গড়ে তোলা, নতুন বন্ধু-নতুন পড়শি জুড়ে দিল খাসগল্প, ঠিক যেন অদৃশ্য সেলাই। কলকাতা সাক্ষী থাকল এমনই এক আশ্চর্য কারুশিল্পের সেতুবন্ধনে। আইসিসিআর-এ প্রদর্শিত হল অর্চি ব্যানার্জির পরিচালনায় ‘পার্টেড ক্রাফটস’ (Parted Crafts) নামের এক অসামান্য প্রদর্শনী।
গ্রাম-বাংলার মাটির কাজ
দেশভাগের সময় একদল মানুষ এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে এসেছিলেন, তাঁরা কেন এসেছিলেন? কী মনে করেই বা থেকে গিয়েছিলেন বাকিরা? থেকে যাওয়া বা চলে আসায় পরবর্তী কী কী অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁদের? আর ঠিক কীভাবে এই অভিজ্ঞতাগুলো প্রভাবিত করেছিল তাঁদের শিল্পকে? এমনই হাজারও প্রশ্নের উত্তর শিল্পের মোড়কে মানুষের সামনে নিয়ে এসেছেন অর্চি ব্যানার্জি (Archi Banerjee)। চেন্নাই থেকে ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশুনো করেন অর্চি। তারপর পাড়ি দেন লন্ডনে। সেখানকার ইউনিভার্সিটি অফ দ্য আর্টস থেকে মেড ফেলোশিপ পান, যার পর ফিরে আসেন ভারতে।
চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সাতচল্লিশের দেশভাগ, ছিন্নমূল মানুষের যন্ত্রণার ইতিহাস। আবার নতুন জায়গায় চলে এসে একটু একটু করে আস্তানা গড়ে তোলা, নতুন বন্ধু-নতুন পড়শি জুড়ে দিল খাসগল্প, ঠিক যেন অদৃশ্য সেলাই।
গত বছর জানুয়ারি নাগাদ শুরু হয়েছিল অর্চির বাংলার কারুশিল্প-অভিযান, যা এক বছরের কিছু সময় পরে অবশেষে এই প্রদর্শনী আকারে দর্শকদের সামনে প্রকাশিত হল। দুই বাংলার আর্ট ও ক্রাফটস নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন অর্চি। অনুসন্ধানের জন্য প্রথমেই এপার বাংলার শিল্পীদের কাছে গিয়েছেন তিনি। তারপর এখানকার শিল্পীদের উৎস সন্ধানে পৌঁছে গিয়েছেন বাংলাদেশ। ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে ৬টি শিল্প গোষ্ঠীর প্রায় ১০০ জন কারিগরের সঙ্গে বিশদে আলোচনা করেছেন তাঁদের শিল্পের উত্থান ও পরিবর্তন নিয়ে। জোগাড় করেছেন তাঁদের তৈরি দুষ্প্রাপ্য শিল্পদ্রব্য।
শীতলপাটির কাজে দৃশ্যমান বঙ্গবন্ধু
১৯৫০ নাগাদ বরিশাল থেকে এপার বাংলায় বসতি গড়ে তুলেছিল অর্চির পরিবার। ছোটো থেকেই দেশভাগের গল্প শুনে বড়ো হয়েছেন। নিজেদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের গল্পগুলো ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল তাঁকে। কেমন ছিল পূর্ব প্রজন্মের সেলাইকাজ? কেমন ছিল নকশিকাঁথার বুনন বা শাড়ির পাড়ের অলংকরণ? অনুভব করেন অর্চি। বহু প্রিয় জিনিস পিছনে ফেলে এলেও, তাঁদের শিল্পকলা সঙ্গে করে বয়ে এনেছেন দুই দেশের মানুষ। আর এই শিল্পই বেঁধে রেখেছে ব্যারাকপুরের সঙ্গে বরিশালকে, শান্তিপুরের সঙ্গে টাঙ্গাইলকে।
দুই দেশ ঘেঁটে অর্চি তুলে এনেছেন সাধারণ মানুষের তৈরি হস্তশিল্প, কারুশিল্প, বয়নশিল্প, মৃৎশিল্পের নানান নিদর্শন। ‘পার্টেড ক্রাফটস’-এর দৌলতে একাত্ম হওয়ার সুযোগ পেয়েছে শোলা, শাঁখ, বেনারসির সূক্ষ কাজ।
দুই দেশ ঘেঁটে অর্চি তুলে এনেছেন সাধারণ মানুষের তৈরি হস্তশিল্প, কারুশিল্প, বয়নশিল্প, মৃৎশিল্পের নানান নিদর্শন। ‘পার্টেড ক্রাফটস’-এর দৌলতে একাত্ম হওয়ার সুযোগ পেয়েছে শোলা, শাঁখ, বেনারসির সূক্ষ কাজ। অর্চি ব্যানার্জি বঙ্গদর্শনকে জানান, “প্রদর্শনীতে রাখা প্রতিটি শিল্পের পিছনে রয়েছে কোনো না কোনো গল্প, যা সেই শিল্পকে জুড়ে রেখেছে দেশভাগের সঙ্গে।”
শাঁখের করাত (রেপ্লিকা)
পুরাণ-ঢাকার শাঁখারি বাজার
শাঁখের এইসব সামগ্রী এভাবেই ট্রাঙ্কে ভরে শাঁখারিরা ফেরি করতেন
এমনই একটা জিনিস হল শাঁখের করাত। সাধারণত ‘শাঁখের করাত’ শব্দটা মানুষের মুখে মুখে প্রবাদ হিসাবে শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু ঠিক কোথা থেকে উৎপত্তি হয়েছিল এই শব্দের? বাংলাদেশের শাঁখারিবাজারে গিয়ে সত্যিকারের শাঁখের তৈরি করাতের দেখা পান অর্চি। লোকমুখে শোনা যায়, এই করাতের ভয়েই নাকি শাঁখারিবাজারে প্রবেশ করতে ভয় পেত দাঙ্গাবাজেরা। অর্চি অবশ্য সেটিকে তুলে আনার বদলে, সেটির আদলে তৈরি করেন একটি রেপ্লিকা, যা রাখা হয়েছিল প্রদর্শনীটিতে।
বেনারসি ব্রোকেট শাড়ির নিদর্শন
ইতি বিশ্বাস (ঘিন্না)-এর তৈরি টাঙ্গাইল জামদানি
প্রদর্শনীর আরেকদিকে ছিল ফুলিয়ার ইতি বিশ্বাসের হাতে বোনা একটি টাঙ্গাইল জামদানি শাড়ি। নদিয়া জেলার ফুলিয়া, সুতি ও সিল্কের তৈরি টাঙ্গাইল শাড়ির জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে এই ধরনের বুনন শুরু হয়েছিল বলে পরবর্তীকালে শাড়ি তৈরির এই ঘরানা টাঙ্গাইল নামেই পরিচিতি লাভ করে। ইতি তাঁর জীবনের জয়, পরাজয়, হতাশা, বিচ্ছেদ ও বঞ্চনার কাহিনি বুনেছেন শাড়িটির আঁচলে। সূত্র টেনে অর্চি ব্যানার্জি জানান, “বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান ছিলেন ইতি বিশ্বাস। অবাঞ্ছিত হওয়ার কারণে নাম হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘ঘিন্না’ (অর্থাৎ ‘ঘৃণা’)। ‘ঘিন্না’ ক্রমে ভুলে যেতে বসেছিল তাঁর স্কুলের নামটি। একসময় এই মেয়েটিই হয়ে উঠল সুকারিগর। পরিবারের দায়ভার তুলে নিলো নিজের কাঁধে।” ইতির শাড়ির বুননে তাই লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ লাল নয়, কালো। এ যেন তাঁর জীবনের প্রতিচ্ছবি।
দেশভাগের সময় এই ট্রাঙ্কগুলিতে ভরা ছিল ভিটের সমস্ত স্মৃতি
প্রদর্শনী-কক্ষের এক জায়গায় যাতায়াতের পথে রাখা রয়েছে একটা জরাজীর্ণ ট্রাঙ্ক। জং ধরে গেছে। ধুলো মুছলেই কত কত ইতিহাস সেখানে। দেশভাগের সময় এই ট্রাঙ্কগুলিতে ভরা ছিল ভিটের সমস্ত স্মৃতি। তারপর সেই ট্রাঙ্ক নিয়েই উদ্বাস্তু হয়ে নতুন জীবনযুদ্ধের শুরু। লাল পাড় সাদা শাড়ি ট্রাঙ্ক ভেদ করে লুটিয়ে আছে৷ এ দৃশ্য শুধুমাত্র চোখে দেখার নয়, ছুঁয়ে দেখারও। দর্শকদের জন্য সেই ব্যবস্থাই করেছিলেন অর্চি।
দেশভাগের ৭৫ বছরে শিল্প কতখানি বদলেছে, দেশভাগের হাহাকার, শিল্পীদের জীবনযাত্রার রকমফের কতখানি প্রভাব ফেলেছে তার উপর, এসবই একত্রিত হয়ে আকার নিয়েছে প্রদর্শনীর। অর্চির নিজস্ব মতামত কী? জিজ্ঞেস করতে, স্মিত হেসে অর্চি জানান, “দুই বাংলা এক হয়েছে না আলাদা, সে বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই আমার। আমি শুধু খুঁজতে চেয়েছিলাম, দেশভাগ ও পরবর্তীকালে ঠিক কেমন প্রভাব পড়েছিল বাংলার শিল্পীদের উপর। আমি মনে করি, সেই প্রভাব এখনও শেষ হয়ে যায়নি। সাতচল্লিশের দেশভাগকে এখনও ভিতরে করে বয়ে নিয়ে চলেছি আমরা।” তিনি মনে করেন, তাঁর কাজ এখানেই শেষ নয়। বরং এই প্রদর্শনী তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছানোর দিকে প্রথম ধাপ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দর্শকদের সুবিধার জন্য প্রদর্শনীতে অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যমের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছিল।
____
অর্চি ব্যানার্জির সাক্ষাৎকার ও ছবি - সুমন সাধু, সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লেখা - উৎসা তরফদার, অতিরিক্ত ছবি - মৌনী মণ্ডল