No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ‘ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতা এক নয়’ — বলেছিলেন পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি  

    ‘ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতা এক নয়’ — বলেছিলেন পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি  

    Story image

    সাধারণের কল্পনায় ‘গন্ধর্বলোক’ সুর দিয়ে ঘেরা । সুখ, দুঃখ, আনন্দ বিষাদের আলাদা করে কোনো খাপ সেখানে নেই। যা আছে তার পুরোটাই সুর ও স্বর। কিন্তু কখনও অতি সাধারণ মানুষের সামনেও হঠাৎ এসে দাঁড়ায় কোনো অপার্থিব তান। চঞ্চল মন নিমেষে শান্ত, সমাহিত হয় তাতে। চোখের সামনে উন্মোচিত হয় ‘সুরলোক’-কে উপলব্ধির এক পরম পথ। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সমৃদ্ধ জগতে কিংবদন্তি সেতার বাদক পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি তেমনই এক অবিসংবাদিত, অবিস্মরণীয় পথ। যে ব্যথা বুকে ধারণ করে আজীবন এক ধ্রুবসত্যের খোঁজে চলেন সাধক, আলতো করে, যত্ন করে সেই ব্যথাকেই হৃদয়ে ধারণ করতে বলে নিখিল ব্যানার্জির সেতার। তাঁর হাতের ছোঁয়ায় এক্কেবারে অ-সুরের হৃদয়তন্ত্রীতেও কী এক আশ্চর্য দোলা লাগে। একবার তাঁকে শুনে নিলে মোহিত না হয়ে উপায় থাকে না। ভারতীয় রাগ সংগীতের সুবিস্তৃত আঙিনায় এমন মানুষ খুব কমই এসেছেন।

    খেলনা নিয়ে খেলার বয়সেই পণ্ডিতজি হাতে তুলে নিয়েছিলেন সেতার। সে বড়ো অাশ্চর্য সময়। ১৯৩১-এর ১৪ অক্টোবর কলকাতার এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম তাঁর। বাড়িতে ঠাকুরদা ছিলেন গানবাজনার লোক। বাবা জিতেন্দ্রনাথও তখন মঞ্চে সেতার বাজান, সারাদিন বাড়িতে আসা যাওয়া বিখ্যাত সব মানুষের। এরই মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেওয়াজ করেন জিতেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। পুত্র নিখিল তখন বছর চারেকের, সেইসময় থেকেই এই তিনতারের যন্ত্রটার ওপর বিশেষ টান তার। সুযোগ পেলেই হাত দিয়ে একটু ছুঁয়ে দেখে সে। ছোটো ছেলে, হাতে সেতার দিলে সামলাতে না পেরে ফেলে দেবে কি তার ছিঁড়ে দেবে এই ভয়ে বাবাও তার থেকে দূরে রাখেন সেই যন্ত্র। আর দূর থেকে লক্ষ্য করেন ছেলের আগ্রহ। এসবের মাঝেই যখন বছর পাঁচেকের হল পুত্র নিখিল, তখন একদিন সত্যিই ছেলেকে শেখাতে শুরু করলেন, কীভাবে ধরতে হয় সেতার, কেমন করে রাখতে হয় হাত, কেমন করে সুর তুলতে হয় তারে। ছোটোবেলার এই শিক্ষা এত সঠিকভাবে পেয়েছিলেন সেতারী পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি, যে তাঁর পরম গুরু মাইহার ঘরানার উস্তাদ বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব পরে তাঁকে একবার শুনেই বলেছিলেন 'তোমার হাতের সেটিং খুব ভালো।' সারাজীবন এভাবেই নিখিল ব্যানার্জির সঙ্গে রয়ে যান তাঁর বাবা, তাঁর প্রথম গুরু।

    জীবনে বহু গুণীজনের কাছে নানা সময় নাড়া বেঁধেছেন পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি। আগুনের আঁচে নানাভাবে পুড়ে খাঁটি সোনার আঙুল দিয়ে স্পর্শ করেছেন সেতার। আর তাইতো এত পবিত্র, এত বিশুদ্ধতায় ভরা তাঁর সুর। বাবার বাল্যবন্ধু শ্রী বংশীধর রাও, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব স্যার জন অ্যান্ডেলস্ গোমেজ, চল্লিশের দশকের কলকাতার বিখ্যাত শিল্পী উস্তাদ মুস্তাক আলি খাঁ সাহেব, পণ্ডিত রাধিকামোহন মৈত্র, গৌরিপুরের মহারাজা শ্রী বীরেন্দ্র কিশোর চৌধুরী প্রমুখ সেইসময়ের দিকপালদের কাছে প্রাথমিকভাবে শিখেছিলেন নিখিল ব্যানার্জি। কিন্তু এসব থেকে অনেক দূরে তাঁর জন্য সবার অজান্তে বুঝি অপেক্ষা করছিলেন আর একজন। তিনি,  ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত জগতের অন্যতম স্তম্ভ উস্তাদ বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব

    রাগ মিয়াঁ কি মল্লার | পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি 

    মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোরজি'র নির্দেশেই মাইহারে গিয়ে বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছে গান্ডা বাঁধেন নিখিল। তখন তার ১৫/১৬ বছর বয়স।  অথচ এরও ঢের আগে মাত্র ন'বছর বয়সে নিখিল ব্যানার্জি সর্বভারতীয় সেতার প্রতিযোগিতায় সফল হয়ে সর্বকনিষ্ঠ শিল্পী হিসাবে 'অল ইন্ডিয়া রেডিও'-তে নিযুক্ত হন। মাইহার ছিল পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জির হয়ে ওঠার সাধনস্থল। গুরুজির নির্দেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে রেওয়াজ করতেন তখন। মাঝে শুধু স্নান খাওয়ার জন্য সাময়িক বিরতি, তারপর আবার শুরু। উস্তাদজির বাড়িতে তখন সরোদে পুত্র উস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেব, সেতারে পণ্ডিত রবিশংকর, কন্যা বিদূষী অন্নপূর্ণাদেবী সুরবাহারে, বাঁশিতে পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষ এঁদের সঙ্গে নিখিল ব্যানার্জির অপূর্ব সুরসাধন মাইহার ঘরানার আলাপকেই বিস্তৃত করেছিল। বিশেষ করে এইসময় এবং পরবর্তীতে প্রায় আজীবন নিখিল ব্যানার্জি তাঁর স্বভাবচিত আন্তরিক বিনয় ও নিষ্ঠা নিয়ে শিখেছেন উস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেব ও গুরুকন্যা অন্নপূর্ণাদেবীর কাছে। প্রভাবিত হয়েছেন ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, ফৈয়াজ খাঁ, কেশরিবাই কেরকার, রোশনারা বেগমের সুরযাপনে।

    আর এসবের মাঝেই সর্বক্ষণ মাথায় রেখেছেন পরম গুরু বাবা আলাউদ্দিনের শিক্ষা, "যখনই তুমি কিছু উপস্থাপন করবে, প্রথমেই গুরুর ধ্যান করবে, অনুভব করবে তিনিই তোমার হাত ধরে তোমায় এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। গুরু যখন বাস করবেন তোমার হৃদয়ে তখনই সৃষ্টি হবে সংগীত''। ছোটো থেকেই 'দর্শন' খুব প্রিয় ছিল নিখিল ব্যানার্জির। ভারতীয় সংগীতের মধ্যে যে আধ্যাত্মিকতা তাঁকেই খোঁজার ব্যকুলতায় যেন সেতার ধরতেন মানুষটি। শিক্ষা, অভ্যাসকে পেরিয়ে তার ওপরে কোথাও একটা পৌঁছে যায় তাঁর বাজনা। নিজেই বলেছেন, “ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতা এক নয়। পরম সত্যকে জানার আগ্রহ থেকেই ভারতীয় সংগীত শেখা হয়, অনুশীলন করা হয়”। বলেছেন, “ছোটো থেকেই করুণ রসের প্রতি ঝোঁক আমার। ওই মাধুর্যকে স্বরের মধ্যে প্রস্ফুটিত করে মহাশূন্যে যাওয়ার চেষ্টা করি, কোথায় যে যাই তা বলতে পারি না, কেবল ওই চেষ্টাটা থাকে।” এই মাধুর্যই খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি উস্তাদ আমির খাঁর কণ্ঠে। তাঁর দ্বার বিশেষভাবে প্রাণিত পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি। সাধক তিনি, নিরবিচ্ছিন্ন সাধনায় সৃষ্টি করেছেন ‘হেমললিত’, ‘হেমকেদার’, ‘চন্দ্রকৌশিকী’, ‘মনোমঞ্জরী’-র  মতো বহু স্বতন্ত্র রাগ।

    রবীন্দ্রনাথের গান বড়ো ভালোবাসতেন তিনি। ‘আজি এ আনন্দ সন্ধ্যায়’ এই গানটিতে পূরবীর শুদ্ধ ধৈবতের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে নিজে জন্ম দিলেন ‘পূরবীকল্যাণ’। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন গানবাজনার মধ্যে যে স্বর্গীয় অনুভব আছে, সেখানে ক্ষুদ্র এই মানুষের কোনো অহংকার স্থান পেতে পারে না।  তাই পরবর্তীতে তাঁর সতীর্থ, ছাত্র থেকে শুরু করে বহু বিশিষ্ট শ্রোতা একবাক্যে স্বীকার করেছেন কারোর কোনো সমালোচনা তিনি কখনও করেননি, তাঁর সামনে অন্য ঘরানার শিল্পীকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্যকে তিনি প্রশয় দেননি কখনওই। আদ্যন্ত সৎ, পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান সাধনাকেই সবার আগে গুরুত্ব দিয়েছিলেন নিখিল ব্যানার্জি। তাই অবলীলায় বলতে পেরেছিলেন, “আমি যেন এক গণ্ডির মধ্যে, যার চতুর্দিকে রয়েছেন উস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ, রবিশংকর, উস্তাদ আলি আকবর খাঁ, উস্তাদ আমির খাঁ। আমার কী সাধ্য এদের পেরিয়ে যাব আমি!”  তবু ,স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, নিখিল ব্যানার্জি একজনই। তিনি স্বতন্ত্র, নিজের অন্তরের আলোয় উদ্ভাসিত এক বিরল শিল্পী, সাধক তিনি।

    চাঁদের জ্যোৎস্নায় চরাচর ভেসে যাওয়ার যে অনুভব তা রূপ পায় নিখিল ব্যানার্জির ‘চাঁদনীকেদারে’। তাঁর হাতে ‘দরবারী কানাড়া’র ব্যথা, ‘মিয়াঁ কি মল্লার’, ‘পুরিয়া কল্যাণ’, ‘রাগেশ্রী’, কিংবা ‘শিবরঞ্জনী’র আকুলতা হৃদয়ের প্রত্যকটা তারে বিশেষ করে বেজে ওঠে। পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জির বাজনায় চারপাশে যেন এক সুরের বর্ম তৈরি হয়। পৃথিবীর কোনো কলুষের সাধ্য নেই সে বর্মকে ভেদ করে। তিনি সরস্বতীর বরপুত্র। তিনি নরম হাতে তারের ওপর আঙুল বুলিয়ে দিতেই মিঠাস সুরে ঘর ভরে ওঠে।  নিখিল ব্যানার্জি সেতার বাজালেই পৃথিবীর সবচেয়ে নাস্তিক মানুষটির নাকেও আসে ধ্যানের গন্ধ, ধূপের সৌরভ।

    তথ্যঋণঃ 
    আকাশবাণী কলকাতা, পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জির সাক্ষাৎকার

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @