No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বাঙালি লিপিকরকে দলে টানতে যুদ্ধ বাঁধল লালমুখোদের

    বাঙালি লিপিকরকে দলে টানতে যুদ্ধ বাঁধল লালমুখোদের

    Story image

    উইলিয়াম কেরি পঞ্চাননকে নিয়ে এলেন শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানায়। কোলব্রুক সাহেবের থেকে প্রায় ছিনিয়েই আনলেন বলা যায়। পঞ্চাননকে নিয়ে তখন কোলব্রুক সাহেব ও কেরি সাহেবের মধ্যে রীতিমতো দড়ি টানাটানি চলছে। জল গড়িয়েছে অনেকদূর। পঞ্চাননকে ছিনিয়ে আনতে কেরির নাকি সওয়াল ছিল ছাপার ক্ষেত্রে ইংরেজদের মনোপলি চলবে না। এমন কারিগরের ওপর একচ্ছত্র অধিকার চাপানোর কোনও অধিকার নেই ইংরেজদের। একজন লিপিকরকে নিয়ে এই লড়াই। ভাবা যায়!

    এমন লড়াই কেন? তার কারণ, উনিশ শতকে পা রাখতে চলা ভারতবর্ষে ছাপাখানার বিপুল গুরুত্ব। ছাপাখানা থাকলেই রাতারাতি হাজার হাজার বাইবেল অনুবাদ করে ছেপে পৌঁছে দেওয়া যায় বাঙালির ঘরে ঘরে। ধম্ম প্রচারের পথ সুগম হয়। ছাপাখানা থেকে বই ছেপে, তার ভিতর দিয়ে সুকৌশলে ‘নেটিভ’দের মগজে দ্রুত ঢুকিয়ে দেওয়া যায় সাহেব প্রভুদের উদ্দেশ্যের বীজ। তাছাড়া, আধুনিক শিক্ষায় আলোকিতকরণের গল্প তো আছেই। সব মিলিয়ে ছাপাখানা এক বিরাট ব্যাপার। আগেই বলেছিলাম, তা হল গিয়ে ‘সাহেবদের ঠাকুর’। তা ছাপাখানায় শুধু ছাপার কল থাকলেই চলে না, দক্ষ লিপিকরও চাই। যে অক্ষরের ছাঁদ গড়ে দেবে। তখনকার যুগে সে এক বিরাট কাজ। বঙ্গদেশে সে কাজে অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোক খুঁজে পাওয়াই কঠিন। তাই লিপিকরদের গুরুত্বও তখন বিরাট। তাদের নিয়ে দড়ি টানাটানি অসম্ভব কিছুই নয়।

    উইলিয়াম কেরি যখন শ্রীরামপুরের ছাপাখানার জন্য লিপিকর খুঁজছেন হন্যে হয়ে, তখনই পঞ্চানন কর্মকারের কথা কানে আসে। কেরি যদি পঞ্চাননকে খুঁজে না পেতেন, তাহলে কী হত? লিপিকর খুঁজে না পেয়ে কেরি হয়ত বাধ্য হতেন বিলেত থেকে কিছু পুস্তিকা ছাপিয়ে আনতে। এই কাজ সময়সাপেক্ষ তো বটেই, নানা হ্যাপাও আছে। এবং দেদার খরচ। হয়ত ব্যয়ের চাপে শ্রীরামপুরের ছাপাখানাই বন্ধ হয়ে যেতে পারত। তা নাহলে হয়ত অদক্ষ কোনও লিপিকরের গড়ে দেওয়া টলমলে ছাঁদেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ত বাংলা ছাপাখানা। আর একটা বড় ঘটনাও ঘটে যেতে পারত। বাংলা আধুনিক গদ্যের জন্ম ও বিকাশের গোটা ইতিহাসটাই যেতে পারত থমকে। অর্থাৎ, কেরি ও পঞ্চাননের এই সাক্ষাৎ ও যুগলবন্দি মোটেই খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল না, বলাই বাহুল্য। এই যুগলবন্দি যদিও খুব সহজে ঘটেনি। সেই গল্পেই ফিরে আসি।

    ত্রিবেণীর পঞ্চানন হরফ তৈরির কাজ শিখেছিলেন অ্যান্ড্রুজ সাহেবের ছাপাখানায় উইলকিন্স সাহেবের কাছে। তারপর উইলকিন্স সাহেব নিজের ছাপাখানা তৈরি করে চলে গেলেন মালদায়। পঞ্চানন কাজ নিলেন গার্ডেনরিচে কুলব্রুক সাহেবের কাছে। অক্ষর ঢালাইয়ের কাজ। কেরির কানে পৌঁছোল পঞ্চাননের কথা। ঠিক করলেন পঞ্চাননকে নিয়ে আসবেন শ্রীরামপুরে। শ্রীরামপুরের মিশনারিরা তখন ধরে পড়লেন কোলব্রুককে—আমরা পঞ্চাননকে চাই। মিশনারিদের করুণ আবেদনেও কিন্তু কোলব্রুক সাহেবের মন গলল না। তিনিও তখন পঞ্চাননকে ছাড়া প্রায় অন্ধ। এবার সরাসরি টোপ দিলেন কেরি। পঞ্চাননকে চিঠি দেওয়া হল—বেশি মাইনে দেওয়া হবে, চলে এস। কিন্তু পঞ্চানন নিরুত্তর। এতদিনের অন্নদাতাকে ছেড়ে অন্য চাকরিতে যাওয়ার লোভ নেই তাঁর।

    এত করেও যখন চিঁড়ে ভিজল না, তখন পরিকল্পনা বদলালেন কেরি। পঞ্চাননকে তাঁদের চাই-ই। কোলব্রুক সাহেবের কাছে ফের অনুরোধ গেল। “খুবই বিপদে পড়েছি। অন্তত দিন কয়েকের জন্য যদি পঞ্চাননকে ধার দেন আমাদের। কাজ হয়ে গেলেই ও আপনার কাছে ফিরে যাবে।” অনুরোধ তাঁর এড়ানো কঠিন বড়। কোলব্রুক এবারে আর না করতে পারলেন না। পঞ্চাননকে ক’দিনের ছুটি দিয়ে বললেন—একবার শ্রীরামপুর ঘুরে এস। কোলব্রুক দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি, পঞ্চাননের এই যাওয়াই অগস্ত্যযাত্রা। পঞ্চানন শ্রীরামপুর থেকে আর গার্ডেনরিচে ফেরেননি।

    কিছুদিন অপেক্ষা করার পর কোলব্রুক বুঝতে পারলেন, তাঁকে ঠকিয়ে পঞ্চাননকে চিরতরে বাগিয়ে নিয়েছেন কেরি সাহেব। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কোলব্রুক ভারত সরকারের কাছে আর্জি পেশ করলেন। কেরিও ছাড়ার পাত্র নন। পঞ্চানন হাতছাড়া হলে শ্রীরামপুরের ছাপাখানাও বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে কেরিও দিনেমার সরকারকে নামিয়ে দিয়েছেন আসরে। এক বাঙালি কারিগরকে নিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতির লড়াই শুরু হল। যে যুদ্ধে শেষ হাসি হাসলেন কেরিই।

    তারপর? শ্রীরামপুরের ছাপাখানায় পঞ্চানন প্রায় এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন। বাংলা অক্ষরের ছাঁদ তো বটেই, গড়ে দিলেন আরও নানা ভাষার অক্ষরের ছাঁদ। বাংলা অক্ষরের একটা সুদৃশ্য আদল জন্ম নিল। সেই অক্ষর গড়ার ঐতিহ্যকেই এরপর আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন তাঁরই জামাতা মনোহর এবং তাঁর বংশধরেরা। যে আদলকেই আরও ঘষে-মেজে পরিষ্কার করে আমরা আজও লেখা চালাচ্ছি।

    পঞ্চানন কর্মকার সম্পর্কে এই কাহিনি প্রথম শুনিয়েছিলেন শম্ভুচন্দ্র মুখার্জি। তিনি এই গল্প শুনেছিলেন পঞ্চাননের বড় নাতির কাছে। অনেকেই মনে করেন এই কাহিনি নেহাতই গালগপ্পো। কোলব্রুক বনাম কেরির এই মামলার কোনও নথিই খুঁজে পাওয়া যায় না। আর বাকিদের বক্তব্য, সম্ভাব্যতার বিচারে এমন ঘটনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না মোটেই। হয়ত মামলার কাগজপত্তর খোওয়া গেছে। কিংবা হয়ত পরে পাওয়া যাবে। কিন্তু, পঞ্চানন শ্রীরামপুরের মিশনারিদের কাছে কতটা গুরুত্ব পেতেন, তার হাজারো প্রমাণ ছড়িয়ে আছে তাঁদের লেখায়, চিঠিতে, পত্রিকায়। একজন লিপিকরকে নিয়ে কত গল্প, স্তুতি। একটা বদলাতে থাকা সময়ের মাঝে তাঁর ছেনি, হাতুড়ি আর হরফ গড়ে দেওয়ার অসামান্য দক্ষতা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন পঞ্চানন। যা তিনি গড়ে দিয়েছিলেন, তা নিছক ধাতুর তৈরি হরফ নয়—তা একটা জাতির আত্মপ্রকাশের ধরন।

    এমন মানুষদের নিয়েই কিংবদন্তিরা জন্ম নেয়।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @