প্রথম দিকে ধারণা ছিল ‘মেয়েলি’ বাহন, পরে পালকির প্রেমে পড়েন পর্তুগীজ পুরুষরা

পালকি (palanquins) চলছে। কাহাররা (বেহারা) মাঝে মাঝে হাঁক দেয়, রাস্তা খালি করে। অচেনা দেশে অজানা যানে ভয় করতে থাকে সাহেবের। দুলকি চালে হুমহুমনা শুনতে শুনতে তাঁর মনে হয়, কাহাররা বোধহয় পথের ক্লান্তিতে এমন শব্দ করছে মুখে। তাদের রেহাই দেওয়ার জন্য তড়িঘড়ি পালকি থেকে নেমে পড়েন সাহেব। ভাবেন কাহারদের ক্লিষ্ট মুখ দেখবেন, হয়তো বা কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিন্তু কোথায় কী! কাহাররা তো বেজায় খুশি। তাদের মুখে কোথাও কোনও ক্লান্তির ছাপ নেই। দেখেশুনে আবার পালকিতে ফিরে যান সাহেব, পালকি চলতে শুরু করে। কিন্তু ফের একই ধুকপুকানি। এই টেনশন বেশিক্ষণ না নিতে পেরে, পালকি থামিয়ে কাহারদের হাতে টাকা গুঁজে দৌড় লাগান সাহেব।
তখনও কলকাতা ‘কলকাতা’ (Kolkata) হয়ে ওঠেনি। ব্রিটিশ (British) রাজের কাজে ভারতে এসে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন অগাস্টাস ক্লিভল্যান্ড (উল্লিখিত পলাতক সাহেব), লিখেছিলেন তাঁর প্রথম পালকি সফরের কথা। “কাঠের তৈরি ছোট্ট খাঁচার মত ঘর। দু’পাশে দন্ড। জনা কয়েক পালোয়ান চেহারার পুরুষ সেই যান বয়ে নিয়ে যায়। নাম তার পালকি।”
পালকি চড়তে গিয়ে ক্লিভল্যান্ড সাহেব পালিয়ে বেঁচেছিলেন ঠিকই, তবে পালকির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেও বাকি রাখেননি সাহেবসুবোরা। বৈকালিক ভ্রমণের সঙ্গী ছাড়াও সকাল থেকে বিকেল অবধি অফিস, তার মধ্যে একবার লাঞ্চ করতে বাড়ি ফেরা - ভরসা ছিল পালকিই। পালকি নিয়ে আদিখ্যেতার অন্ত ছিল না তাঁদের।
বিখ্যাত ইউরোপিয়ান সাহিত্যিক স্যামুয়েল জনসনের দেওয়া ডাকের পালকির বর্ণনা অনুয়ায়ী, তীর্থভ্রমণের প্রতি এশীয়দের দুর্বলতা টের পেতে সময় লাগেনি সাগরপারের শাসকদের। অতএব, পোস্টঅফিসগুলিতে ব্যবস্থা করা হল ডাক-পালকির। কেউ তীর্থভ্রমণে যাবেন কিংবা অন্য কোনও কাজে - ডাক-পালকিতে খবর দিলেই কেল্লা ফতে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির দোরগোড়ায় হাজির হয়ে যেত সরকারি ডাক-পালকি। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকের কথা। কলকাতা থেকে কাশীর ডাক
পালকির ভাড়া তখন পাঁচশো টাকা। আর মাঝপথে নেমে গেলে মাইল প্রতি এক টাকা দুই আনা কিংবা ক্রোশ প্রতি দুই টাকা চার আনা - যে কোনও একটা হিসেব মেনে নিলেই হল। শৌখিন লোক কি আর এত হিসেব করে চলে!
এক ধরণের পালকি ছিল, নাম ‘মহনা’ বা ‘মিয়ানা’। এই পালকি যেন ছোটোখাটো বিছানাই। ভেতরে বিছানা-বালিশ সব মজুত। শুয়ে শুয়ে যেতেও যাত্রীর অসুবিধা হত না। বোঝাই যাচ্ছে, এই পালকি ছিল বিলাসিতার চূড়ান্ত। বাংলার কারিগররাই শুধু জানতেন মিয়ানা তৈরির কৌশল। কলকাতার বিদেশি 'কোচ মেকার'রা বাংলার কারিগরদের কাছ থেকে শিখে নেন সেই বিদ্যা। নেটিভ রাজা-মহারাজাদের কাছে বিলাসবহুল মিয়ানার চাহিদা তখন আকাশছোঁয়া। বলা বাহুল্য, মিয়ানা বিক্রি করে বিদেশি কোম্পানিগুলো মুনাফা লুটেছিল ভালোই।
পালকি থেকে উপার্জনের পাশাপাশি পালকির পিছনে বিপুল পরিমান খরচা করতেও পিছুপা হতেন না সাহেবরা। সেসময় অনেকেই ‘প্রাইভেট’ পালকি রাখতেন। আর এক সাহেব, জর্জ ডব্লিউ জনসন - পেশায় কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, কলকাতায় এসেছিলেন ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে। মাত্র তিন বছর ছিলেন কলকাতায়। প্রাইভেট পালকির প্রতি ইউরোপীয়দের পক্ষপাতিত্ব জনসনের নজর এড়ায়নি। তাঁর মতে, প্রতিদিন ব্যবহারের প্রয়োজন না থাকলে এই বাহুল্য থেকে দূরে থাকাই ভালো। পালকি পোষার হাঙ্গামা তো আর কম নয়, এ দিকে শহরে ঠিকা পালকিরও অভাব নেই। প্রয়োজনে ডেকে পাঠালেই হল। পাঁচ মিনিটেই বাড়ির দোরগোড়ায় হাজির।
এদিকে পালকি প্রেমের অন্ত নেই, ওদিকে পালকির ভেতর বসার প্রাচ্য ভঙ্গিটি আর কিছুতেই সাহেবদের রপ্ত হয় না। এই বসা নিয়ে আবার সাতকাণ্ড রামায়ণ করেছিলেন তাঁরা। প্রথমদিকে পর্তুগীজদের মনে হত পালকি ‘মেয়েলি’ বাহন। পরে অবশ্য সেই ‘মেয়েলি’ বাহনই পর্তুগিজ পুরুষদের পছন্দের বাহন হয়ে উঠেছিল। আসলে, নেটিভরা যেভাবে বসে, তা অনুকরণ করতে গিয়ে সাহেবরা বুঝতে পেরেছিলেন, কাজটি বড়ো সহজ নয়। তা না-ই বা গেল নেটিভদের মতো বসা। তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে আধশোয়া ভঙ্গিটাই বা কী এমন নিন্দনীয়! অতএব প্রচেষ্টা চলতেই থাকে। যতই অসুবিধে হোক, এই পোড়া দেশে বেড়াতে এসে একে ছাড়া এক পা এগোয় কার সাধ্যি! বাহনটিকে নিঃসংকোচে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ, এমনই সব শলাপরামর্শ দিয়ে ভারতভ্রমণে ইচ্ছুক পর্যটকদের ঋদ্ধ করেছিলেন জনৈক সাহেব টমাস বেকনও।
ডাক-পালকি, প্রাইভেট পালকি, ঠিকা পালকি, মিয়ানা… শুধু পালকি নয়, পালকি বেহারারাও মুগ্ধ করেছিল সাহেবদের। ‘মাত্র’ চারশো বছর আগের কথা। দিল্লির সিংহাসনে তখন বাদশাহ জাহাঙ্গীর। সেই সময় ভারতে এসেছিলেন ইতালিয়ান পর্যটক পিয়েত্রো দেলা ভাল্লে (Pietro Della Valle)। স্বদেশে তিনি সুরকার, সংগীততাত্ত্বিক এবং লেখক হিসেবে বিখ্যাত। পিয়েত্রোর মনে জায়গা করে নিয়েছিল পালকি। বেহারাদের প্রশংসা করে বলেছিলেন: ‘The men who bear such satisfied with a very small reward.’
অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকেই ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী বালসাজার এসেছিলেন কলকাতায়। তিনি পালকি সম্বন্ধে অনেক কিছুই লিখে গেছেন। লিখেছেন, পালকির গড়নটা বড়ো ভালো। চারজন বেহারা বয়ে নিয়ে যায় এই পালকি। এদের আগে আগে চলে হরকরা আর পেয়াদার দল। বেহারারা মাইলের পর মাইল পাড়ি দেয়, অথচ ভেতরে বসে বোঝার উপায় নেই যে, কারও ঘাড়ে চেপে যেতে হচ্ছে। চলতে চলতে ওরা কখন যে ঘাড় বদল করে, যাত্রীরা টেরই পায় না। আবার, চলতে চলতেই কী সুন্দর গান গায়, নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে। মাইলের পর মাইল হাঁটলেও তারা ক্লান্তিহীন। যেন এই পথ চলাতেই আনন্দ।
গ্রন্থঋণঃ
বিনয় ঘোষ, টাউন কলকাতার কড়চা, পালকি ও ল্যাণ্ডোর যুগ, বিহার সাহিত্য ভবন প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৬১
হরিসাধন মুখোপাধ্যায়, কলিকাতা সেকালের ও একালের, পি এম বাগচী অ্যান্ড কোং, ১৯১৫
সাহেবসুবোর পালকিপ্রীতি, জয়তা দাস, গাঙচিল পত্রিকা, ২০১৭