No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    পাঁচকেদারের সবচেয়ে দুর্গম রুদ্রনাথের উদ্দেশ্যে...

    পাঁচকেদারের সবচেয়ে দুর্গম রুদ্রনাথের উদ্দেশ্যে...

    Story image

     চামোলী থেকে গোপেশ্বর

    গত পর্বের (তুঙ্গনাথ) পর

    রু দ্র না থ

    পাখির চোখে পঞ্চকেদার দেখতে বেরিয়েছি আমরা, বেশ কয়েকদিন হল। এই পর্বে আমাদের গন্তব্য পাঁচকেদারের সবচেয়ে দুর্গম রুদ্রনাথ (Rudranath)। গাড়োয়াল হিমালয়ের কঠিন কঠিন ট্রেকগুলোর মধ্যে একেবারে প্রথম দিকে আছে এই রুদ্রনাথ ট্রেক। অচেনা পাহাড়ি পথ যে কতটা ভয়ংকর সৌন্দর্যময় হতে পারে তার হাতে গরম প্রমাণ পঞ্চকেদারের চতুর্থ কেদার রুদ্রনাথ। যাত্রাপথের দুর্গমতা এবং ট্রেকিং পথ লম্বা সময় সাপেক্ষ হওয়ায় তীর্থযাত্রীদের সংখ্যা এখানে হাতেগোনা। সারাবছরের মাত্র ছ’মাস এই পথ খোলা থাকে ট্রেকারসদের জন্য। তাই বোধহয়, এখানকার প্রকৃতি আজও আদিম গন্ধমাখা। কী নেই সে পথে! আছে ভয়ংকর কষ্টসাধ্য চড়াই, আছে পৃথিবীর সেরা সেরা সুন্দরী বুগিয়াল, আছে চিরতুষারাবৃত হিমালয়ের অপূর্ব রূপ দর্শন, আছে অসংখ্য ঝর্ণা আর আছে ঘন জঙ্গল পথের বুনো ভাল্লুকের ভয় আর কানে তালা লাগানো ঝিঁঝির একটানা ডাক।

    পঞ্চকেদার যাত্রার একেবারে শুরুতে, পঞ্চকেদারের সঙ্গে মাইথোলজি নির্ভর মহাভারতের যে সংযোগের উল্লেখ করেছিলাম, সে কথা মাথায় রাখলে মনে পড়বে ভ্রাতৃহত্যা ও স্বজনহত্যার পাপমুক্তির জন্য পঞ্চপাণ্ডব আদিদেব মহাদেবের স্মরণ নিতে গেলে, ভক্তের পরীক্ষা নিতে শিব বৃষরূপে লুকিয়ে পড়েন। দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের উদ্যোগেই পঞ্চপাণ্ডব, গাড়োয়াল হিমালয়ের বিভিন্ন স্থানে, শিব শরীরের বিভিন্ন অংশ প্রকট হতে দেখেন৷ রুদ্রনাথে প্রকাশ হয় মহাদেবের মুখমণ্ডল। সেই হিসাবে রুদ্রনাথে আজও পূজিত হন মুখমণ্ডলের আকৃতি বিশিষ্ট রুদ্রশিলা। হাত, পা, শরীরের অন্যান্য অংশের পর এবার পূর্ণ রূপে হাজির হচ্ছে জ্যোতির্ময়ী মুখ। স্বভাবতই পঞ্চকেদারের অন্যতম মুখ্য কেদার হয়ে তাই বিরাজ করছে এই রুদ্রনাথ।

    গোপেশ্বরের গোপীনাথ মন্দির

    যাত্রাপথের দুর্গমতা এবং ট্রেকিং পথ লম্বা সময় সাপেক্ষ হওয়ায় তীর্থযাত্রীদের সংখ্যা এখানে হাতেগোনা। সারাবছরের মাত্র ছ’মাস এই পথ খোলা থাকে ট্রেকারসদের জন্য। তাই বোধহয়, এখানকার প্রকৃতি আজও আদিম গন্ধমাখা।

    রুদ্রনাথ ট্রেকিংই পাঁচকেদারের সেই পথ, যেখানে পৌঁছাতে হলে অবশ্যই প্রয়োজন গাইড (পথপ্রদর্শক) কাম পোর্টার (মালবাহক)। রুদ্রনাথের উদ্দেশ্যে, উত্তরাখণ্ড সরকার নির্দেশিত যে তিনটি পথ আছে সেগুলি হল –
     
    ১. হেলং থেকে উর্গম ভ্যালি পৌঁছে কল্পেশ্বর দর্শন করে দুমক, বংশী নারায়ণ (Bansi Narayan), পানার বুগিয়াল পেরিয়ে রুদ্রনাথ। সবচেয়ে লম্বা এই পথটি, প্রায় ৩৪ কিলোমিটার ট্রেক করতে হয় পায়ে হেঁটে।
        
    ২. সাগর গ্রাম থেকে লিট্টি বুগিয়াল, পানার বুগিয়াল, পিত্রাধর টপ পেরিয়ে রুদ্রনাথ। কমবেশি ২০/২২ কিলোমিটার হাঁটতে হয় এই পথে। এই পথেই সবচেয়ে কঠিন চড়াই ভাঙতে হলেও এই পথটিই সর্বাধিক পরিচিত।

    ৩. মণ্ডল থেকে অনসূয়া মন্দির পেরিয়ে ঘন জঙ্গলের পথে হংস বুগিয়াল, দুর্গম চড়াইয়ের নওলা পাস পেরিয়ে রুদ্রনাথ। এই পথে পথ হারানোর সম্ভবনা আর ভাল্লুকের ভয় পরিচিত সঙ্গী।

     সাগর গ্রাম

    এই তিন পথের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ও তুলনায় বেশি আলোচিত দ্বিতীয় পথটিকেই বেছে নিলাম আমরা। আর এই পথে আমাদের প্রথম গন্তব্য গোপেশ্বর। ভোরবেলা হরিদ্বার থেকে বেরিয়ে, হৃষিকেশ, রুদ্রপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ, নন্দপ্রয়াগ হয়ে চামোলী পৌঁছে এখানকার সবচেয়ে বড়ো জনপদ গোপেশ্বর যেতে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয়ে যাবে। গোপেশ্বরে পাহাড়ের কোলে অবস্থিত বারোশো শতাব্দীর প্রাচীন গোপীনাথ মন্দিরই রুদ্রনাথের শীতকালীন আবাসস্থল। পুরাণ মতে কৃষ্ণের নাম থেকে জায়গার নাম গোপেশ্বর হলেও এই গোপীনাথ মন্দিরের স্বয়ম্ভূ শিব গোপীনাথই রক্ষা করছেন গোপেশ্বরকে। প্রাচীন বিশ্বাস, কামদেব এই গোপীনাথজীর ধ্যান ভাঙাতে এখানে এসে, শিবের কোপে ভস্ম হয়ে গেলে, কামদেবের স্ত্রী রতি মহাদেবের কাছে তাঁর স্বামীর পূর্বাবয়ব ফিরে চাওয়ার তপস্যা করেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শিবের অনুগ্রহে রতি অবশেষে কামদেবকে এখানেই ফিরে পান। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের রক্ষণাবেক্ষণে ধ্যানগম্ভীর এই মন্দির আজও তার প্রাচীন চেহারাটি ধরে রাখতে পেরেছে। গোপেশ্বরের এই গোপীনাথ মন্দির দর্শন করে সেখান থেকে গাড়িতে পাঁচ কিলোমিটার এগিয়ে সাগর গ্রামে পৌঁছাতে দিনের আলো প্রায় মিইয়ে যাবে। তবু, পাহাড়ে যেহেতু অনেক দেরি করে সন্ধে হয়, তাই সাগরে পৌঁছেই আগ্রহীরা দেখে নিতে পারবেন সগরেশ্বর মন্দির।

     গোপীনাথ মন্দির

    সূর্যবংশীয় রাজা ‘বাহু’র পুত্র মহারাজ সগরের জন্ম, বেড়ে ওঠা, শিক্ষালাভ ও উপাসনাস্থল এই সাগর গ্রাম। সগর রাজা শিব ও শক্তির (মা চণ্ডিকা) উপাসনা করে পুনরায় অযোধ্যা রাজ্য জয় করেন। সেই তপস্যা স্থলেই রয়েছে প্রাচীন সকলেশ্বর (সগরেশ্বর), মা চণ্ডিকা ও লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির। পাহাড়ের গায়ে ঝুম চাষের ধাপ বরাবর নিচে ঘুরে ঘুরে সিঁড়ি নেমে গেছে মন্দির পর্যন্ত। মন্দির দর্শন করে সেদিনের মতো আমাদের রাতের আস্তানা হবে সাগরের হাতে গোনা হোমস্টে বা হোটেলের যে কোনও এক নিরিবিলি পাহাড়ি ঘর।  পরদিন ভোরে শুরু হবে সারাদিনের ১৪/১৫ ঘণ্টার লম্বা হাঁটা পথ। অতএব, চটপট রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে  অপেক্ষা গাইডের ডাকে ভোরবেলায় যাত্রাশুরুর। আপাতত, তাই বিশ্রাম।

    চলবে...

    _______________________

    *কেদারনাথ, মদমহেশ্বর, তুঙ্গনাথ, রুদ্রনাথ, কল্পেশ্বর - পঞ্চকেদারের রোমহর্ষক ভ্রমণকাহিনি এবার বঙ্গদর্শনে। পড়ুন পিয়ালী বসুর (Piyali Basu) ধারাবাহিক ‘পাখির চোখ পঞ্চকেদার’। প্রতি শুক্রবার, দুপুর ৩টেয়।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @