একটি রাত জঙ্গুতে

গ্যাংটক থেকে ৭০ কিমি দূরে উত্তর সিকিমের মঙ্গন হেডকোয়ার্টারের অন্তর্গত ছোট্ট লেপচা অধ্যুষিত গ্রাম জঙ্গু । লাচুং থেকে চুংথাং হয়ে আমরা যখন মঙ্গন পৌঁছলাম তখন প্রায় দুপুর ২:৩০টে। সেখান থেকে "সিকিম প্রশাসন বিভাগের" অনুমতি নিয়ে আমরা ৮ কিমি দূরে জঙ্গুতে পৗছলাম; দুপুর ৩:৩০টে। এপ্রিল মাস বলে এখানে ঠাণ্ডা নেই। মোটামুটি হাল্কা জামাকাপড়েই চলে যাচ্ছিল। আমাদের "জঙ্গলী হোমস্টে" কলকাতা থেকে বুক করা ছিল। সেইমত আমরা সোজা পৌঁছে গেলাম। জঙ্গু এখনও অবধি সেভাবে পর্যটকদের পরিচিত হয়ে ওঠেনি। তাই সেভাবে হোটেলও গড়েনি এখানে। শুধুই "হোমস্টে"। সাধারণত এখানকার হোমস্টেগুলো মেয়েরাই চালান। আমাদের হোমস্টের মালিকের নাম রিয়ংজি। উনি গল্প করলেন "লি" মানে থাকার জায়গা। ভীষণ আলাপী। অভ্যর্থনা একেবারে ঘরের মত।
রেল - হাওড়া বা শিয়ালদা থেকে নিউ জলপাইগুড়ি রেলস্টেশন
বিমান - দমদম থেকে বাগডোগড়া বিমানবন্দর
স্টেশন বা বিমানবন্দর থেকে ভাড়া করা জীপ বা ট্যাক্সি তে গ্যাংটক-মঙ্গন হয়ে ৫-৬ ঘণ্টার যাত্রা জঙ্গু। হোমস্টে বুক করা থাকলে সেখানের লোক এসেও নিয়ে যেতে পারে মঙ্গন থেকে।
গ্যাংটক–জঙ্গু: দূরত্ব ৭০ কিমি
মঙ্গন–জঙ্গু: দূরত্ব ১০ কিমি
জঙ্গু যাওয়ার অনুমতিপত্র মঙ্গন থেকে সিকিম প্রশাসনের দপ্তর থেকে নিতে হবে।
হোমস্টে - ৮-১০ টা | আগে থেকে বুক করে যেতে হবে |
জঙ্গুতে কোনও এটিম বা ব্যাঙ্ক নেই । তাই সেইমত ব্যবস্থা মঙ্গন থেকে করে নিতে হবে ।গাইড আগে থেকে বুক করে যেতে হবে ।
দু’কামরার ছোট্ট কাঠের বাড়ি পাথরের উপরে। একটা ছোট্ট জানলা দিয়ে বাইরের পাহাড় দেখা যায়। ফ্রিলের পর্দা দিয়ে ঢাকা। ঘরের ভিতর আসবাবপত্র বলতে ছোট্ট একটা কাঠের খাট। আমাদের ঘরের সামনেই একটা ছোট্ট বারান্দা। দু’টো বেতের চেয়ার রাখা ছিল সেখানে। সামনে ঘন সবুজ জঙ্গল ঘেরা পাহাড়। আর দূরে অস্পষ্ট কুয়াশা ঘেরা কাঞ্চনজঙ্ঘা। অনেক নীচে বয়ে যাচ্ছিল সরু তিস্তা।

তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। রিয়ংজি আমাদের চা আর ঘরে বানানো নোনতা বিস্কুট এনে দিলেন। আমরা খেয়ে গ্রাম দেখতে বেরোলাম। বেড়িয়ে দেখলাম সামনে সাদা পাথুরে রাস্তা পাহাড়ের গা বেয়ে লালগোলাপ– সূর্যমুখী আর ফুলে-ফুলে প্রজাপতি। মনে হচ্ছিল স্বর্গ কি এর চেয়েও সুন্দর হয়? আমরা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে অনেক উপরে পৌঁছলাম- "জঙ্গু মনেস্ট্রীতে"। সবার এখানে নিজস্ব শস্যের ক্ষেত রয়েছে। লালশাক-লাউ-ধান-পালংশাক-রাইশাক-আলু-ভুট্টা-কলমীশাক-সীম-ভেষজ ওষুধ-আরও কত কী।

আমাদের গাড়ীর চালক বেশ নেপালি ভাষায় সবার সাথে আলাপ জমিয়ে নিচ্ছিল। শহরের সমস্ত কোলাহল - আর ব্যস্ততা থেকে দূরে এত সুন্দর শান্ত ছবির মত যে সাধারণ জীবন হতে পারে সেটা আমি কখন কল্পনাও করতে পারিনি। এত চাওয়াহীন-আকাঙ্ক্ষাহীন-প্রত্যাশাবিহীন জীবন এদের। তাই বোধহয় এরা এত খুশী নিজেদের মধ্যে।

প্রায় দেড় ঘণ্টা হেঁটে আমরা পৌঁছলাম মনেস্ট্রীতে। এখনও মনেস্ট্রীটা তৈরি হচ্ছে। একটা বছর উনিশের ছেলে খুব মন দিয়ে ধীরে ধীরে দেওয়ালের গায়ে নক্সা আঁকছে। বুদ্ধের ছবি। অসাধারণ। আমরা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম। দেখলাম সমস্ত পুরোনো পুঁথি- বাদ্যযন্ত্র জমা করে রাখা আছে। এত উপরে দাঁড়িয়ে আমরা নীচের গ্রামটিকে দেখছিলাম প্রাণভরে। এখানকার বাতাস কি বিশুদ্ধ ! শহুরে কলুষতা এখনও ছুঁতে পারেনি একে। আমরা প্রাণভরে অক্সিজেন নিয়ে যাচ্ছিলাম বেঁচে থাকার। আর ফুলের গন্ধ- নদীর গন্ধ- ভেজা পাতারগন্ধ নিয়ে যাচ্ছিলাম আগামী দিনের জন্য। নীচে নামার সময় আমাদের মুখে কোনও কথা ছিল না। যে সৌন্দর্য আরোহণ করলাম ; তারই ভাবনায় বিভোর হয়ে ছিলাম।

যখন ঘরে ঢুকলাম তখন সন্ধ্যে নেমে গেছে। এমনিতেই জায়গাটা অসম্ভব নিস্তব্ধ। সন্ধ্যে হওয়ার সাথে সাথে সেই নিস্তব্ধতা আরও বেড়ে গেল। সামনের রাস্তাটায় কোনও আলো নেই। যতদূর দেখা যাচ্ছিল শুধুই অন্ধকার। কালো-নিকষ। বারান্দায় এসে বসলাম। অন্ধকারে ঘন সবুজ জঙ্গল আরও ঘন কালো হয়ে উঠছিল। বোঝা যাচ্ছিল না কিছুই। দেখলাম অনেক উপরে পাহাড়ের মাথায় ঠিক তিনটে হলুদ আলো। ওটা তিস্তার জলবিদ্যুৎ তৈরির প্রকল্প চলছে। তিস্তা নদীর সোঁ-সোঁ বয়ে চলার শব্দ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। আর সাথে অল্প-অল্প ঠাণ্ডা হাওয়া। এ রকম নিস্তব্ধতায় বুঝি সেই সমস্ত আওয়াজগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে; যা অন্য সময়ে কোলাহলের ভিড়ে হারিয়ে যায়| আমাদের সঙ্গী তখন একমাত্র চাঁদ। সাদা চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ছিল তিস্তার জলে। ভেসে যাচ্ছিল চরাচর জ্যোৎস্নার নরম আলোয়।

কিছুক্ষণ পরেই আমাদের ডাক পড়ল রাতের খাবারের জন্য। বাঁশের গ্লাসে দিল যবের তৈরি পানীয়- "চি"। সাথে নেটেল স্যুপ- বাঁশ পাতা ভাজা আর গরম ধোঁয়া-ওঠা সাদা ভাত। মাটিতে বিছানো তক্তা পোষে বসে খেলাম আমরা সবাই মিলে। ঘর থেকে দূরে বসেও যে এত সুন্দর আত্মীয়তা পাওয়া যায়; তা সেদিন প্রথম বুঝলাম। পরদিনই আমাদের ফেরার কথা কলকাতায়। ভোরবেলা সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই বেড়িয়ে পড়লাম আমরা ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।