অত্যাচারী জমিদারকে তাড়িয়ে স্বাধীন কৃষকরাজ্য তৈরি করেছিলেন টিপু পাগল

পলাশির যুদ্ধের পর আস্তে আস্তে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন বাংলায় জাঁকিয়ে বসতে থাকে। প্রথম দিকে কোম্পানি শাসন চালাত পরোক্ষে। একজন করে নবাবকে মুর্শিদাবাদের তখতে বসিয়ে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ত তারা। তারপর মুঘল সম্রাটের থেকে কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করল, বাংলায় শুরু হল দ্বৈত শাসন। অর্থাৎ নবাবের হাতে রইল প্রশাসনিক দায়িত্ব, আর রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পুরো ক্ষমতা পেল কোম্পানি। এতে বাংলার নবাব হয়ে পড়লে ঠুঁটো জগন্নাথ আর এই সুযোগে কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার চালাতে লাগল। বাংলার সমৃদ্ধ কৃষি অর্থনীতিতে ভাঙন দেখা দেয় ওই সময় থেকেই। ১৭৭২ সালে দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটিয়ে সরাসরি নিজেদের হাতে বাংলার শাসনভার তুলে নিল ব্রিটিশ কোম্পানি। ফলে কৃষকদের ওপর শোষণ আর অত্যাচার বেড়ে যায় আরও বহুগুণ।
বাংলার নিজস্ব কৃষি অর্থনীতি যত ভাঙতে থাকে, দিকে দিকে ততই জ্বলতে থাকে কৃষক বিদ্রোহের আগুন। তখনকার কৃষক বিদ্রোহগুলোতে ধর্মবিশ্বাস খুব ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিল। বিদ্রোহীরা মনে করতেন, রাজার কাজ প্রজাপালন, প্রজাদের অত্যাচার করা অধর্ম। অন্যায়কারী পাপী শাসকের একদিন পতন হবে। তাই অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধের লড়াই করা ধর্মযুদ্ধ ছাড়া কিছুই নয়। সন্ন্যাসী ফকিরদের বিদ্রোহে কীভাবে দলে দলে চাষিরা যোগ দিয়েছিল, তাতে ধর্মবিশ্বাসের কী ভূমিকা ছিল, সেই গল্প আগে বলেছি। আজ বলব পাগলপন্থী বিদ্রোহের গল্প।
পাগলপন্থী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন করম শাহ। তাঁর বাবা শের আলি গাজি ছিলেন উত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের গড়জরিপা আর দশকাহনিয়ার জমিদার। এই শের আলির থেকেই শেরপুর শহরের নামকরণ হয়েছে। অন্য এক জমিদার ষড়যন্ত্র করে তাঁর জমিদারি দখল করে নিয়েছিলেন। সর্বস্বান্ত অবস্থায় মৃত্যু ঘটেছিল তাঁর। শের আলি মারা গেলে তাঁর ছেলে করম শাহ নিজের মাকে নিয়ে গারো পাহাড়ের পাদদেশে শালকোনা গ্রামে চলে যান। সেখানে জীবন কাটাতে থাকেন সাধুসন্তের মতো করে। তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দূর-দূরান্তে, প্রচুর ভক্ত-অনুগামীও আসতে থাকে। করম শাহ পরিচিত হয়ে ওঠেন করম পাগল নামে, আর তাঁর অনুগামদের সবাই পাগলপন্থী বলে ডাকতে থাকে। করম শাহের দুই ছেলে। তাঁদের মধ্যে একজন টিপু শাহ বাবার মতোই আধ্যাত্মিক জীবন বেছে নিয়েছিলেন।
১৮২০ সালে শেরপুরের জমিদারির ভাগবাঁটোয়ারা হয়। শরিকরা নিজেদের মধ্যে জড়িয়ে পড়েন মামলায়। সেই মামলার খরচ তুলতে প্রজাদের ওপর বসানো হয় আবওয়াব, মাথটের মতো সব নতুন ধরনের কর। রাজস্বের পরিমাণও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে নাভিশ্বাস উঠতে থাকে কৃষকদের। খাজনা আদায়ের জন্য জমিদারের পাইক-পেয়াদা-বরকন্দাজরা অত্যাচার শুরু করে। খাজনা ঠিক সময়ে দিত না পারলে এরা চাষিদের বন্দি করত, এমনকি পুড়িয়ে দিত তাদের বাড়িঘর। কিছু চাষি পালিয়ে যায়, আর বেশিরভাগ কৃষক অত্যাচার সইতে না পেরে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এই বিদ্রোহী চাষিদের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন টিপু শাহ। হিন্দু-মুসলমান সব ধর্মের কৃষকরাই আধ্যাত্মিক সাধক টিপুকে ভক্তিশ্রদ্ধা করত। এদের একটা বড়ো অংশ টিপুর কথা মতো খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। জমিদারের পাইক-পেয়াদা-বরকন্দাজদের সঙ্গে এদের রক্তক্ষয়ী লড়াই চলতে থাকে। তখন ১৮২৪-২৫ সাল।
এরই মধ্যে টিপু একদিন হাজার হাজার দলবল নিয়ে জমিদারবাড়ি আক্রমণ করলেন। চলল ব্যাপক লুঠপাঠ, অগ্নিসংযোগ। জমিদাররা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন কালীগঞ্জের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ড্যাম্পিয়ারের কাছাড়ি বাড়িতে। এদিকে টিপু পাগলা গড়জরিপার দুর্গকে নিজের বাসস্থান করে নিলেন। পাগলপন্থীরা শেরপুর দখল করে নিজেদের স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের ঘোষণা করে। টিপু হয়ে ওঠেন তাদের রাজা। টিপুর উদ্যোগে তৈরি হয় নিজস্ব শাসন ও বিচারব্যবস্থা। খাজনার পরিমাণ অত্যন্ত কমিয়ে দেওয়া হয়। কৃষকদের এই স্বাধীন রাষ্ট্র মোটামুটি দু’বছর টিকে ছিল।
ইংরেজ শাসকরা এইরকম স্বাধীন কৃষকরাজ্যেকে কখনও মেনে নিতে চাইনি। কোম্পানির সৈন্যরা শেরপুর পুররুদ্ধার করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। পাগলপন্থীদের সঙ্গে ভয়ংকর যুদ্ধ হয় তাদের। অবশেষে ১৮২৭ সালে টিপু আর কয়েকজন পাগলপন্থীকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ সেনা। ময়মনসিংহ সেশন জজ আদালত তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি দেয়। কারাগারের মধ্যেই ১৮৫২ সালে মারা যান টিপু শাহ। টিপু পাগল ধরা পড়লে কিন্তু পাগলপন্থীদের বিদ্রোহ থেমে যায়নি। তখন ‘মা সাহেবা’ নামে পরিচিত টিপুর বিধবা মা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতেন। হঠাৎ করে জমিদারবাড়িতে হামলা, আগুন লাগিয়ে দেওয়া, লুঠপাট চলতে থাকে। ইংরেজ শাসকও পাল্টা নির্যাতন শুরু করে চাষিদের ওপর। এরই মধ্যে ময়মনসিংহের নানা অঞ্চলে কৃষকরা বিচ্ছিন্নভাবে অভ্যূত্থান চালিয়ে যায়। ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহ শুরু হলে এই সব আঞ্চলিক কৃষক বিদ্রোহ তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে দিকে দিকে।
তথ্যসূত্র- বাংলা লাইভ, আর্টস বিডিনিউজ, এনটিভি।