No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    তৈরি করেছেন টোটো জনজাতির নিজস্ব বর্ণমালা, সেই ধনীরাম টোটোর হাতে আজ ‘পদ্মশ্রী’

    তৈরি করেছেন টোটো জনজাতির নিজস্ব বর্ণমালা, সেই ধনীরাম টোটোর হাতে আজ ‘পদ্মশ্রী’

    Story image

    ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত অর্থ পৌঁছে যাবে পিছিয়ে পড়া মেধাবী টোটো উপজাতির ছাত্রছাত্রীদের কাছে – এমনটাই ভেবেছেন সদ্য পদ্মশ্রীপ্রাপ্ত শিক্ষক-লেখক ধনীরাম টোটো। তাঁর আবেদন, টোটোদের জন্য আলাদা একটি পর্ষদ গঠন করা হোক, তাতে অনগ্রসর টোটো সমাজ-সংস্কৃতির উন্নয়নে নতুন অধিকার তৈরি হবে। টোটো হরফ ও অক্ষর তৈরির ক্ষেত্রে নজির গড়েছেন ধনীরাম।

    লেখক ধনীরাম টোটো উত্তরবঙ্গের মাটির মানুষ। আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাট থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে রয়েছে প্রান্তিক টোটোপাড়া। এলাকাটি ভুটান সীমান্তের কাছে। সেখানেই বাস করেন ধনীরাম। বাবা-মায়ের মেজো ছেলে তিনি। বাবা প্রয়াত আমিফা টোটো ছিলেন টোটোপাড়ার একজন মনোনীত পঞ্চায়েত আর মা ছিলেন প্রয়াত লক্ষ্মিনী টোটো। ধনীরামেরা ছই ভাই, চার বোন। তাঁর ঠাকুরদাও ছিলেন পঞ্চায়েত। স্ত্রী চম্পা টোটোও প্রয়াত হয়েছেন কিছু বছর আগে। ধনীরামবাবুর এখন বয়স ৫৯। তিন ছেলে, এক মেয়ে। নাতি-নাতনি ছয় জন। বড়ো পুত্র সঞ্জয় এবং মেজো রঞ্জয় কৃষিকাজে যুক্ত। ছোটো পুত্র ধনঞ্জয় উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাইব্রেরি সায়েন্সে স্নাতকোত্তর পাশ করে বর্তমানে বেকার বসে রয়েছেন।

    লেখক ধনীরাম টোটো উত্তরবঙ্গের মাটির মানুষ। আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাট থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে রয়েছে প্রান্তিক টোটোপাড়া। এলাকাটি ভুটান সীমান্তের কাছে। সেখানেই বাস করেন ধনীরাম।

    সাহিত্য ও শিক্ষায় পদ্মশ্রী পেলেন ধনীরাম টোটো

    একেই অনগ্রসর দুর্গম টোটোপাড়া, তারপর আবার সেখানে উচ্চশিক্ষা, ভাবা যায় না। কিন্তু পড়তে তাঁকে হবেই – এই ভাবনা থেকেই অল্পবয়সে লড়াই শুরু হয় ধনীরামের। তাঁর মাতৃভাষা টোটো। কিন্তু প্রাথমিকে ভর্তি করা হয় বাংলা স্কুলে। সেখানে বাংলা ভাষা কিছু বুঝতে পারতেন না, তবু জেদ নিয়ে পড়েছেন। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় কোচবিহারে যেতে হয়। স্কুলে কোনো কথার উত্তর দিতে পারতেন না। কারণ বাংলা ভাষাটা রপ্ত করতে পারেননি তখনও। পঞ্চম শ্রেণিতেই আবার রাজবংশী ভাষা পড়তে হয়। ফলে সে ভাষা শিখে নেওয়ার পালাও চলতে থাকে। এভাবে ৬০টি ভাষা এখন শিখে ফেলেছেন বলে ধনীরাম জানান। লেখাপড়া শিখতে গিয়ে তাঁর কষ্টের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। বঙ্গদর্শন.কম-কে ধনীরাম জানান, “দিনহাটার জমাদারবসে ২২ জন ছাত্রকে ২৫০ গ্রাম ডাল ভাগাভাগি করে খেতে হত। দিনে চারটে রুটি পাওয়া যেত, আর তা খুব পাতলা। ২ কেজি সবজি ২২ জন ছাত্র মিলে খেতে হত চাটনির মতো করে। ছোটো শালিমার নারকেল তেলের কৌটা থেকে এক কৌটা চালের ভাত, তাতে পেট ভরতো না।”

    টোটো ভাষায় লিখিত বর্ণপরিচয়

    টোটোদের জন্য বর্ণমালা ছাড়াও টোটোদের জেনেটিক্স, সমগ্র টোটোপাড়ার ইতিবৃত্ত, সকলের বংশ পরিচয়ের এক দলিলও লিখেছেন তিনি। তৈরি করেছেন বিশেষ টোটো ক্যালেন্ডার।

    পরে মাধ্যমিকে কম্পার্টমেন্টাল পেলে রবীন্দ্র মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করতে হয় দ্বিতীয় বিভাগে। বহু দিন ধরে তিনি মনে মনে স্বপ্নের জাল বুনতেন, যদি পৃথিবীর সব জনজাতির পৃথক অক্ষর ও ভাষা থাকতে পারে, তবে তা থেকে টোটোরা কেন বঞ্চিত হবে? ধনীরাম চেয়েছিলেন নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে। আর শেষপর্যন্ত তিনি তা করে দেখিয়েছেন। ৩৭ শব্দের অক্ষর রাশি তৈরি করেছেন ধনীরাম টোটো। তার সঙ্গে টোটো সাহিত্যে প্রচুর কবিতা, উপন্যাস লিখেছেন। রম্যরচনাতে পটু তিনি। কথা বলে বোঝা যায়, তিনি আদতে আত্মভোলা গোছের মানুষ।

    টোটোপাড়ার জনসংখ্যা (২০১১)

    টোটোদের জন্য বর্ণমালা ছাড়াও টোটোদের জেনেটিক্স, সমগ্র টোটোপাড়ার ইতিবৃত্ত, সকলের বংশ পরিচয়ের এক দলিলও লিখেছেন তিনি। তৈরি করেছেন বিশেষ টোটো ক্যালেন্ডার। টোটো ভাষায় ১৩টি লোকগল্প রচনা করেছেন। রয়েছে অনেক রম্যরচনা, টোটো জনজাতির কথা। প্রয়াত স্ত্রীকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা ‘প্রিয়তমার স্বপ্নভূমি’।

    ধনীরাম টোটো এবং তাঁর স্ত্রী

    ১৯৯৭ সালে রাজ্য সরকার তাঁকে তাম্রপত্র দিয়েছিল। ১৯৯৩ সালে প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওয়ের আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত তো বটেই, বিশ্বের অনেক দেশেও তাঁর টোটো সাহিত্য এবং টোটো পাড়া নিয়ে প্রচার করেছেন। অস্ট্রেলিয়াতে তাঁর বন্ধু টনি এন্ডারসন, ইংল্যান্ডে লিজার্ড ডেভিস, নিউজিল্যান্ডে ক্যাথরিনার মতো অসংখ্য বিদেশি বন্ধুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। তিনি বলেন, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত টোটো জনজাতির জন্য কাজ করে যেতে চান।

    ধনীরাম চান টোটো জনজাতির মধ্যে থেকে আগামীতে আইএএস, আইপিএস বেরিয়ে আসুক। এর জন্য রাজ্য সরকারের কাছে টোটো পর্ষদ গঠনের আবেদন জানান তিনি। পৃথিবীর আদিম জনজাতি এই টোটো সম্প্রদায়। পাশাপাশি ভারতের অতি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার উত্তর প্রান্তে ভুটান সীমান্তে তোর্ষা নদীর ধারে টোটোপাড়া গ্রামে এঁদের বাস। টোটোরা তাঁদের এই গ্রামের বাইরে অন্য কোথাও বাস করেন না। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, টোটো উপজাতি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে তাঁদের সংখ্যা এখন দুই হাজারের কিছু বেশি। বিপন্ন এই জনজাতিকে এগিয়ে দিতে টোটোদের কাছে ‘বিদ্যাসাগর’ হয়ে উঠেছেন ধনীরাম টোটো। তাঁকে শুভেচ্ছা, কুর্নিশ জানাচ্ছে সারা দেশ।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @