No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ব্রজবুলি ভাষার উৎপত্তি ও বিবর্তন

    ব্রজবুলি ভাষার উৎপত্তি ও বিবর্তন

    Story image

    উত্তর বিহারের তিরহুত জেলা ও দক্ষিণ নেপালের একটা প্রাচীন রাজ্য ছিল, নাম ‘বিদেহ’। তার রাজধানী ছিল ‘মিথিলা’। সেখানে মৈথিলী ভাষায় কথা বলত মানুষজন। সে রাজ্যের মহাকবি ছিলেন বিদ্যাপতি, তিনি ‘মৈথিলী কোকিল’ নামেও সুপরিচিত। তিনি মৈথিলী ভাষা ও সংস্কৃত ভাষার একটা মেলবন্ধনে কবিতা লিখতেন। সে ভাষায় রাধা-কৃষ্ণ, সনাথ-ব্রজমণ্ডলের লীলা বিবৃত হত বলে সে ভাষার নাম দেয়া হল ব্রজবুলি।

    ব্রজবুলি ভাষা এরপরে অসমিয়া ও বাংলা - দুই ভিত্তিতে গড়ে উঠল। অসমিয়া ব্রজবুলি ভাষাতে বৈষ্ণব কবি ও নাট্যকারেরা শিল্পচর্চা শুরু করে দিলেন। অসমিয়া ব্রজবুলি’র ভিত রচনায় আরও ছিল আওয়াধী ভাষা ও ব্রজভাষা। ব্রজভাষা ও ব্রজবুলি ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা।

    অসমিয়া ব্রজবুলি ভাষাতে বৈষ্ণবী নাট্য(অঙ্কীয়-নাট্য) এবং স্তুতিমূলক কবিতা লেখা হত শুধু। অসমিয়া ভাষায় দেব-দেবীর স্তুতি রচনা করা হত না এই ভেবে যে, এটি যেহেতু সকল জনসাধারণের ভাষা, দেব-দেবী রুষ্ট হতে পারেন। সংস্কৃত ভাষা সাধারণের কাছে সহজবোধ্য না হওয়ায় তাঁরা অসমিয়া ব্রজবুলিতে স্তুতি রচনা শুরু করে দিলেন।

    শ্রীকৃষ্ণের পিতামহ ছিলেন শূরসেন। হরিয়ানা রাজ্যের কিছু অংশ, রাজস্থানের কিছু অংশ, মধ্য প্রদেশের গোয়ালিয়র, উত্তর প্রদেশের পশ্চিম অংশের পুরোটা এবং কুমায়ূন ও গাড়োয়াল নামক অংশ নিয়ে তিনি তৈরি করেন শূরাসেন প্রদেশ, যার আরেক নাম ‘ব্রজ’। শূরাসেন প্রদেশের ভাষা ছিল মূলত শূরাসেনী প্রাকৃত ভাষা। সেখানেই ব্রজ ভাষার উৎপত্তি, যা তিনটি স্তরের মাধ্যমে উৎপত্তি লাভ করে। অপভ্রংশ স্তর, দিঙ্গল স্তর এবং পিঙ্গল স্তর। ব্রজবুলি ভাষাটি যেখানে একটি আর্টিফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ বলে অভিহিত, ব্রজভাষা সেখানে অনেকটাই প্রাকৃতিক।

    বাংলা ভিত্তিতে গড়ে উঠা ব্রজবুলির খোঁজ পাওয়া যায় ১৩ থেকে ১৯ শতাব্দীতে। প্রাচীন মৈথিলী ও অবহট্টের উপর ভিত্তি করে বাংলা ব্রজবুলির উদ্ভব।

    অবহট্ট সম্পর্কে সংক্ষেপে বললে, পাঁচ হাজার বছর আগে ইন্দো–ইউরোপীয় যে ভাষা ছিল, আর্য ভাষা, সেটাই চার হাজার বছর আগে ভাগ হয়। ভাগ হয়ে ১০০০ বছর আগে আমাদের এদিকে আসে ভারতীয় আর্য। ভারতীয় আর্যের প্রধান শাখা দুটি - সংস্কৃত আর বৈদিক। কাহিনী হল, সমগ্র ভারতের মধ্য অংশে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা থেকে আসে মাগধী, ওড়িয়া, অসমিয়া ভাষা। মাগধীর অপভ্রংশের পরের রূপ অবহট্ট, এটি দুশ শতক স্থায়ী হয়েছিল, আর সেখান থেকে বাংলা।

    প্রথম দিকে রাজসভায় ব্রজবুলি (বাংলা) ভাষার চর্চা শুরু হলেও তা পরবর্তীতে জায়গা করে নেয় কবিদের কলমে। ষোড়শ শতাব্দীর শুরু থেকে এটি সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য জায়গা করে নেয়। বৈষ্ণব কবিতার একজন ভক্ত ছিলেন চৈতন্য। গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ তাঁকে কৃষ্ণের পূর্ণাবতার মেনে থাকেন। শ্রী চৈতন্যের ভক্তির কারণে বাংলা সাহিত্যে ক্রমশ পাকা স্থান করে নেয় ব্রজবুলি ভাষা।

    বিদ্যাপতি ছাড়াও অনেকেই এই ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেছেন। প্রাচীন বাংলার প্রথম ব্রজবুলি পদ রচনা করেন যশোরাজ খান। গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির ব্রজবুলিকে অনুসরণ করতেন। গোবিন্দদাসের কয়েকটি পঙক্তি -

    যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি।
    তাঁহা তাঁহা বিজুরি চমকময় হোতি॥
    যাঁহা যাঁহা অরুণচল চল চলই।
    তাঁহা তাঁহা থল-কমল-দল খলই॥

    অর্থ - রাধা তার সখিদের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে, যেখানে তার সৌন্দর্য ছলকে পড়ছে দেহ থেকে, সেখানেই যেন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যেখানেই রাধা আলতা পায়ে পা রাখছে, সেখানেই ঝরে পড়ছে লাল স্থলপদ্মের পাপড়ি!

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শৈশব ও কৈশোরে ভানুসিংহ ছদ্মনামে লিখতেন তিনি। ভানুসিংহের পদাবলিগুলি লেখা হয়েছিল এই ব্রজবুলি ভাষায়। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই শেষবারের মতো এই ভাষায় কাব্যচর্চা করে গিয়েছেন। কাদম্বরী দেবীর অনুরোধে তিনি ব্রজবুলি ভাষায় রচিত তাঁর লেখাগুলো “ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলি” নামে প্রচার করেন। আফসোসের ব্যাপার হল, কাদম্বরী দেবী তার আগের বছরই পরলোকগমন করেন, পরবর্তীতে গ্রন্থটি তিনি কাদম্বরী দেবীকে উৎসর্গ করেন।

    ভানুসিংহের পদাবলির অংশবিশেষ

    মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।
    মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজূট,
    রক্তকমলকর, রক্ত‐অধরপুট,
    তাপবিমোচন করুণ কোর তব
    মৃত্যু‐অমৃত করে দান॥
    আকুল রাধা‐রিঝ অতি জরজর,
    ঝরই নয়নদউ অনুখন ঝরঝর—
    তুঁহুঁ মম মাধব, তুঁহুঁ মম দোসর,
    তুঁহুঁ মম তাপ ঘুচাও।
    মরণ, তু আও রে আও॥

    (ঋণ – সরব.কম)

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @