শিশু অপরাধী বেড়েছে দ্রুতহারে

নির্ভয়াকাণ্ড থেকে কৃষ্ণনগরের দেবাশিস হত্যাকাণ্ড দেখিয়ে সমাজের কিছু মানুষ(বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ, বিত্ত নির্বিশেষ) শিশু অধিকারের কিছু দিক নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলছেন। প্রশ্ন তোলার অধিকার তো আছেই, কিন্তু আমরা যারা মনে করি যে, বিশ্বজুড়ে অনেক আলাপ-আলোচনা শেষে শিশু কী এবং তার সুরক্ষায় সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা কী তা নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে সিদ্ধান্ত যা হয়েছে, এবং যা ভারত সরকার মেনে নিয়েছে তা কেন সকলে খোলামনে মেনে নেবেন না ? সেটাই তো গণতন্ত্র তাহলে? কেন প্রশ্ন তুলবেন বারেবারে? তাহলে কী এরপর আর প্রশ্ন নয়?
তা নয়, প্রশ্ন উঠতেই পারে বারেবারে। - সেটাও গণতন্ত্র। বিশেষত যদি নৃশংস অপরাধমূলক ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়ে কোনও এক বা একাধিক শিশু।
কৃষ্ণনগরের ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে – এমন সুপরিকল্পিত নৃশংস হত্যা যারা করে তাদের কেন শিশু সুরক্ষা আইনের সুযোগ দেওয়া হবে? আরও সাধারণ একটা প্রশ্নও উঠেছে – শিশু অপরাধীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে দ্রুত, নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন নেই?
এখানে কিছু তথ্য দেখে নেওয়া যাক। ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে দেশে মোট যত অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে তার ১ থেকে ১.২ শতাংশ অপরাধে শিশুরা যুক্ত; হত্যাকাণ্ডে জড়িত শিশু অভিযুক্তরা সংখ্যায় ১.২%, ধর্ষণকাণ্ডে ৩.০৪%। কিন্তু এও সত্য যে শিশু অপরাধী বেড়েছে দ্রুতহারে, প্রায় ৪৭%। [সূত্রঃ NCRB(National Crime Records Bureau)] এবং এও সত্য যে, দেশের জনসংখ্যায় ০-১৮ বয়সী মানুষের তথা শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে।
অপরাধী যেই হোক – শিশু, বালক বা বুড়ো – বিচার হবে, শাস্তি পেতেই হবে। ছাড় নেই কারোরই। শিশুদের শাস্তি তুলনায় অনেকটা কম, তাই নিয়েই যত আপত্তি, আইন সংশোধনের দাবি। আইন সংশোধন হল একবার,পেলাম Juvenile Justice Act, 2015 – কিন্তু তাও যথেষ্ট নয়, আরও কঠোর আইন চাইছেন অনেকে। যারা মনে করেন অপরাধ দমনে কঠোর শাস্তি, এমনকি মৃত্যুদণ্ড, কাজে আসে তাদের সাথে একমত না হলেও, তথ্য তাদের পাশে না থাকলেও দাবি তোলার অধিকার তাদের থাকে, এবং, পালটা প্রশ্নের অধিকারও থাকে। এমন দু-একটি প্রশ্ন বিবেচনায় রাখতে চাই।
শিশু অপরাধ করে কেন?
চারটি প্রধান কারণঃ ১) দারিদ্র, ২) অশিক্ষা, ৩) পারিবারিক সঙ্কট ও
৪) এলেক্ট্রনিক মিডিয়া।
তথ্য বলছে, শিশু অপরাধীরা যে পরিবারের থেকে আসে সেই সব পরিবারের ৫৬% -এর বার্ষিক আয় ২৫০০০ টাকার মধ্যে। মাত্র ২৫০০০ টাকা বছরে! আর, ৫৩% শিশুর শিক্ষা প্রাথমিক স্তর ডিঙ্গোয়নি বা নিরক্ষর। স্বাধীনতার প্রায় ৭০ বছর পর এই তথ্য আমাকে ও আপনাকে লজ্জা দেয় নাকি? এর দায় রাষ্ট্র অস্বীকার করতে পারে কী?
অন্যদিকে পারিবারিক সমস্যা বেড়েই চলেছে। পরিবার থেকে মুছে যাচ্ছে দাদু, দিদিমা, ঠাকুমার উপস্থিতি – তাঁদের সোহাগ। শিশুরা চোখের ওপর দেখছে পরিবারের সাবালক সদস্যরা তাদের বাবা, মা ও অন্য বড়দের অসম্মান - অবহেলা করছে। আজকের শিশুরা পরিবারের ভেতরে থেকে শিখছে না যে বড়দের সম্মান দিতে হয়, মর্যাদা দিতে হয়। তারা দেখছে বড়রা নানা অনৈতিক কাজে যুক্ত হয়ে পড়ছে। শিশুদের জীবন থেকে ভালবাসা হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবার ভাঙ্গছে, পারিবারিক বিচ্ছেদ, বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে। পারিবারিক হিংসা, দাম্পত্যকলহ থামাতে আইন আছে, সে আইনে শিশু সুরক্ষার কোনও সুযোগ নেই অথচ আমরা জানি, পরিবারের যে কোনও বাদ-বিতণ্ডায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু। তারাও ভালবাসা না পেয়ে হিংস্র হয়ে উঠছে, সামাজিক সুস্থতায় আস্থা হারাছে।
ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স ঠেকাতে জেলায় জেলায় একজন করে আধিকারিক থাকলেও তাদের না আছে চাকুরীর নিরাপত্তা, না ঢাল-তরোয়াল। শিশুরা যদি দেখে যে বড়রা মিথ্যা বলছে, মিথ্যাচার করছে তাহলে শিশুদের কাছে আমরা কী আশা করব? সরকারি তথ্য বলছে প্রায় সব শিশু এখন স্কুলে আসছে। এই তথ্য প্রায় অভ্রান্ত, কিন্তু যারা স্কুলে যায় তারা জানে স্কুলে যথেষ্ট বা প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই; স্কুলের টয়লেট নানা কারণে ব্যবহারযোগ্য নয়। অথচ সরকারি তথ্য বলছে একেবারে উল্টো কথা – শিশু প্রশাসনের মিথ্যা বা ভ্রান্ত দাবি হজম করবে কেন?
সমাজ এক মহাসঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলেছে। অপরাধ বাড়ছে। এর সমাধান দিতে পারে বড়রাই, শিশুরা নয়। শিশু-বান্ধব পরিবেশ দিতে পারছি না আমরা।
আর আছে এলেক্ট্রনিক মাধ্যমের উৎপাত।
বাংলা চ্যানেলগুলি সাধারণ সময়ে যে খবর পরিবেশন করে সারাদিন তার অন্তত ৭৫% খুন-ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধের খবর। অপরাধ, অপরাধের নাট্যরূপ এসবও আছে। আছে নানা প্রমোদমূলক চ্যানেল যেখানে হিংসাশ্রয়ী সিনেমার আধিক্য। এসব কী শিশুমনে প্রভাব ফেলে না? ইন্টারনেটে পাওয়া যায় সহজেই ধর্ষণ ও রমণ দৃশ্য। সমাজে সাইবার ক্রাইম বেড়েই চলেছে। এসবেরও প্রভাব আছে বৈকি।
সমস্যার সমাধান কী? শিশুবয়সের সংজ্ঞা বদল? নতুন আইনে( J J ACT, 2015) বলা হয়েছে জঘন্য অপরাধে অপরাধীর বয়স ১৬-র বেশি হলে বোর্ড প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে বিচারের জন্য তাকে ঠেলে দিতে পারে সাবালকদের জন্য প্রচলিত বিচারকাঠামোতে। অর্থাৎ, নির্ভর করতে হবে বোর্ডের বিবেচনাবোধ ও তার অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও দক্ষতার ওপর। অন্তত এই রাজ্যে এখনও বোর্ডে পূর্ণ সময়ের বিচারক মেলে না, অন্য সদস্য নির্বাচনেও স্বচ্ছতার অভাব স্পষ্ট। অতএব, বোর্ড তথা শিশু বিচারব্যবস্থাই দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য। তাহলে?
বয়স ১৮ ছোঁয়ার আগে পর্যন্ত সকলকে যে শিশু বলে গণ্য করা হয় তার পেছনে রয়েছে বিশ্বব্যাপী দীর্ঘকালীন গবেষণা। জানা গেছে যে মানব-মস্তিষ্কের পূর্ণতা পেতে ঐ বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। অপূর্ণ অপরিণত মস্তিষ্ক নিজেকে শুধরে নিতে পারে সুযোগ পেলে। তাইতো তাকে সুযোগ দেওয়া। কিন্তু কেবল আইনি সুযোগ শিশু অপরাধ কমাতে পারে না, পারবেও না। শিশুকে দিতে হবে শিশুবান্ধব সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ এবং ভালবাসা। দিতে হবে ভালোমানের শিক্ষা। সাংস্কৃতিক অবক্ষয় একালের শিশুকে অপরাধ ও অপরাধজগতের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে। এই অবক্ষয় কেন এবং উদ্ধারের পথ কী তা না বুঝে আপাতকঠোর শাস্তি দিয়ে অপরাধ বা তার নৃশংসতা কমানো যাবে না।