কলকাতার একমাত্র ‘ক্যাফে’ আর পুডিং-এর গল্প

কলকাতার একমাত্র ‘ক্যাফে’। না না, চমকে ওঠার কিছু নেই। সত্যিই তাই। ক্যাফে তো এমনি কতই আছে কলকাতায়। শুধু আছে বললে ভুল হবে, এখন রোজই প্রায় ছত্রাকের মতো নতুন ঝাঁ-চকচকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্যাফেরা জন্মাচ্ছে শহরের অলিতে-গলিতে। বেশ দামি সন্ধে কাটাতে সেখানে ভিড়ও জমাচ্ছে প্রেম ফুরিয়ে আসা কলকাতার যুবতী-যুবকরা। এইসব ক্যাফের আড্ডাগুলোর গন্ধ আলাদা, মেজাজ আলাদা। একটা পুরোনো শহরের বদলাতে থাকা চরিত্রের সঙ্গে এরা দিব্বি মানানসই। কিন্তু, কলকাতা ভারি মজার একটা শহর তো। এখানে নানা জায়গায় এখনো পুরোনো সময়গুলোও মুখ গুঁজে আছে। হঠাৎ করে হয়তো দেখা হয়ে গেল রাস্তায় আপনার সঙ্গে। অপ্রস্তুত আপনি চমকে উঠলেন। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন হঠাৎ। তেমনভাবেই দেখা হয়ে যেতে পারে এই ‘ক্যাফে’-র সঙ্গেও। যা বলছিলাম, কলকাতার একমাত্র ‘ক্যাফে’।
সব ক্যাফেরই একটা নাম থাকে। ক্যাফে হল অনেকটা পদবির মতো। অথচ, এই ক্যাফের নামই ‘ক্যাফে’। কোনো পদবিও নেই। অতএব, শুধুই ‘ক্যাফে’। কলকাতার আদি-অকৃত্রিম-একমাত্র ‘ক্যাফে’। হাজরা চৌমাথায় যতীন দাশ পার্কের উল্টোদিকে মেট্রোর একখানি গেটের পিছনে আটপৌরে সাবেক চেহারা নিয়েই সে আজো দাঁড়িয়ে। এবং এর কোনো শাখা নেই।
বুড়ো হয়েছে ‘ক্যাফে’। বাইরে সাইনবোর্ড অনুযায়ী দোকানের জন্মকাল ১৯৩৯। কিন্তু দোকানের বর্তমান মালিক সিদ্ধেশ্বর ব্যানার্জি বলছিলেন, আদতে ‘ক্যাফে’-র জন্ম তারও ২ বছর আগে। অর্থাৎ এখন তার ৮২ বছর বয়স। এই ৮২ বছরে দোকানের চেহারায় বা মেনুতে কোনো বদল আসেনি। সিদ্ধেশ্বর বাবুর দাবি, বদল আসেনি স্বাদেও। দোকানের ভিতরেও যেন একটা বহমান সময় ঘূর্ণীর মতো আটকে আছে। ছোটো ছোটো গুমটির মতো খোপ। সরু টেবিল, চেয়ার। বহুকৌণিক গড়নে বিছোনো সেইসব টেবিল-চেয়ার। ঢুকলেই একটা চেনা গন্ধ এসে লাগে নাকে। সেই গন্ধ কলকাতার নিজস্ব পোশাকের গন্ধ।
শহরের সেরা পুডিং হয়তো পাওয়া যায় এখানেই। পুডিং-এর ভিতরে ড্রাই ফ্রুট। ওপরে ফোম। এমন স্বাদের পুডিং খুব দামি ঠেকেও মিলবে কিনা সন্দেহ। অথচ, দোকানের মতো পুডিং-এর দামটিও মধ্যবিত্তের তরে। দোকানে ঢুকতেই চোখে পড়বে কাঠের মেনুবোর্ড। প্রতিটা মেনু আলাদা আলাদা কাঠের সরু স্ল্যাবে লেখা। ফিস ফ্রাই, ফিস রোল, চিকেন কাটলেট, ফিস কবিরাজি, পুডিং, চিকেন আফগানি, গ্রেভি মটন চাপ, চিকেন ও মটন স্টু ড্রাই চাঁপ... সঙ্গে চা আর কফি তো আছেই।
টেবিলে-টেবিলে চেনা মানুষরা আসেন। ভিতরে ধূমপান নিষেধ, তাই সিগারেটের নেশা ডাকলে বাইরে যেতে হয়। তারপর ফের জমে ওঠে আড্ডা। কাউকে নতুন করে অর্ডার দিতে হয় না। কিচেনের ঠিক মুখে দাঁড়িয়ে অমল সাউ। মেদিনীপুরের মানুষ, তেতাল্লিশ বছর হয়ে গেল এই ‘ক্যাফে’-তে। তিনি জানেন, কোন টেবিলে চা-টোস্ট যাবে, কোন টেবিলে ফিস ফ্রাই বা চিকেন স্টু। নতুন কেউ এলে অবশ্য আলাদা কথা। শঙ্করদা, শঙ্কর সাউ, একমুখ হাসি নিয়ে তখন এসে দাঁড়াবেন সামনে। বড়ো যত্নে প্রতিটা পদের বিশেষত্ব বুঝিয়ে দেবেন। উর্দি পরা মাজা পেশাদারিত্বের আন্তরিকতা নয়, তাঁর গা থেকে উজিয়ে আসবে কাসুন্দির গন্ধ। ক’দিন আছেন এখানে। তিনি হেসে বলবেন, ‘কুড়ি বছর তো হবেই। আচ্ছা, আপনি চিকেন আফগানিটা টেস্ট করতে পারেন। কবিরাজির ওপরে গ্রেভি দিই আমরা। গ্রেভিতে মশলা থাকে না। কিন্তু দারুণ টেস্ট। দেব?’
আরও পড়ুন
একশোর বেশি ধরনের চা আর বই-তরণীর ঠেক
আপনার না বলতে ইচ্ছে করবে না। ততক্ষণে পুডিং-ও এসে গেছে আপনার টেবিলে। চামচ বড়ো মসৃণভাবে চিড়ে দিচ্ছে তার বুক। কফিতে চুমুক দিতে দিতেই আপনি খেয়াল করবেন, বড়ো সাদামাটা সজ্জার এই ‘ক্যাফে’-তে যেন এক অদ্ভুত মায়া লেপ্টে আছে। যতটুকু না হলেই নয় ততটুকু সাজ। ঠিক মাঝখানে একটা টেবিলে বসে ক্যাশ সামলাচ্ছেন সিদ্ধেশ্বরবাবু। আলাপ জমাতে চাইলে বিরক্ত হবেন না। জানাবেন, খাঁটি উত্তর কলকাতা থেকে এই ঘোরতর দক্ষিণে এসে ‘ক্যাফে’ খুলেছিলেন তাঁর বাবা অমরনাথ ব্যানার্জী। নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন সমস্ত পদের রেসিপি। এমনকি পুডিং-এরও। সেই রেসিপি আজো বদলাতে দেননি সিদ্ধেশ্বরবাবু।
‘ক্যাফে’-র রাঁধুনি-সহ সমস্ত কর্মচারীরাই পুরোনো। দোকানের মতোই তাঁদেরও শিকড় গাঁথা হয়ে গেছে। ফলে, চরিত্র বা ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে অসুবিধে হয়নি। সিদ্ধেশ্বরবাবু বলছিলেন, আজো এই ‘ক্যাফে’-তে ব্রয়লার মুরগি ঢোকে না। চিকেনের পদ মানেই দেশি মুরগি। মশলার ব্যবহার প্রায় নেই কোনো পদেই। তবুও স্বাদের জাদু অক্ষুণ্ণ। ‘কী করে পারেন?’ হাসেন সিদ্ধেশ্বরবাবু। ‘বাবার রেসিপির গুণ বলতে পারেন।’
বাইরে থেকে দেখলে চারখানা নীল দরজা এই ‘ক্যাফে’-র। এককালে এখানেই আড্ডা জমাতেন উত্তমকুমার, সত্যজিৎ রায়ের মতো বিখ্যাত মানুষরা। ‘ক্যাফে’-র ফিশ ফ্রাই, কাটলেট আর পুডিং-এর তো ভিন্ন কদর ছিল। তারপর শহরটা বদলাল। শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত ঝাঁ-চকচকে নামধারী ক্যাফেদের ভিড়ে কেমন ব্যাকডেটেড হয়ে গেল এই ‘ক্যাফে’। চট করে ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে স্থানীয় অনেকেই মাথা চুলকোন। গুগল থেকে ছবি বের করে দেখালে চিনতে পারেন।
অথচ, তারপরেও ‘ক্যাফে’-তে সান্ধ্য-আড্ডাগুলো আজো ঘন হয়। মানুষজন আজো আসেন। আজো পুডিং-এর খোঁজ করেন অনেক নতুন মুখ। খেয়ে মুগ্ধ হন। পুরোনো মুখদের সমস্ত রুচিই জানা হয়ে গেছে অমলদা-র। নতুন কেউ এলে তাই চোখ চকচক করে ওঠে শঙ্কর দা-র। মেনুর প্রতিটি পদের গল্প বলতে থাকেন অক্লান্তভাবে। নতুনরা এলেই তো বেঁচে থাকবে বুড়ো ‘ক্যাফে’-টা। ‘ক্যাফে’-র ওপর তাঁদের অধিকারবোধ, মমত্ব নেহাত কম নয়।
অন্যান্য ক্যাফের সঙ্গে প্রতিযোগিতা নেই এই বুড়ো ‘ক্যাফের’। যা আয় হয়, যত মানুষ আসেন, তাতেই খুশি সিদ্ধেশ্বরবাবু। তাঁর নিজের আজো একটিও স্মার্টফোন নেই। নেই ই-মেইল, হোয়াটস-অ্যাপ। এই ক্যাফেকেও স্মার্ট হতে শেখাননি তিনি। “আচ্ছা, আপনার পরের প্রজন্ম বাঁচিয়ে রাখবে তো ‘ক্যাফে’-কে?” জিজ্ঞেস করলে ম্লান হাসেন সিদ্ধেশ্বরবাবু। বলেন, ‘জানি না ঠিক। তবে, রাখা তো উচিত। এমন চালু একটা ক্যাফে। এত পুরোনো...’
ম্যাজিকের মতো আচমকা হলুদ হয়ে আসা সন্ধেতে তাঁর কথাগুলো বড্ড বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে তখন।