মোহনবাগান দিবস : প্রথম শিল্ড জয়ে এগারোর টিমে ছয়জনই ছিলেন কোচবিহারের!

কবি করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় মোহনবাগানের প্রথম জয়ের পর ‘মানসী’ (আশ্বিন, ১৩১৮) পত্রিকায় লিখেছিলেন, “জেগেছে আজ দেশের ছেলে পথে লোকের ভিড়,/ অন্তঃপুরে ফুটল হাসি বঙ্গরূপসীর।/ গোল দিয়েছে গোরার গোলে বাঙালির আজ জিত,/ আকাশ ছেয়ে উঠছে উধাও উন্মাদনার গীত।/ আজকের এই বিজয়বাণী ভুলবে নাকো দেশ,/ সাবাশ সাবাশ মোহনবাগান! খেলেছ ভাই বেশ!”
আজ ২৯ জুলাই, গর্বের মোহনবাগান দিবস (Mohun Bagan Day)। আজকের দিনটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেকের সমস্ত আবেগ, উচ্ছ্বাস, গর্ব। ১৮৮০-এর দশকে শুরু হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন। এই সময় ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বিদ্রোহ ভারতীয়দের কল্পনাশক্তিকে জাগরিত করেছিল। এই আন্দোলনকে সাহায্য করার জন্য উত্তর কলকাতার (North Kolkata) মোহনবাগান অঞ্চলের মিত্র ও সেন পরিবারের সাহায্যে ভূপেন্দ্রনাথ বসু (Bhupendranath Bose) ১৮৮৯ সালের ১৫ অগস্ট মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব (Mohun Bagan Sporting Club) প্রতিষ্ঠা করলেন। কথিত আছে, মোহনবাগান ভিলায় ইডেন হিন্দু হোস্টেলের বিরুদ্ধে এই দল প্রথম খেলেছিল। প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ঠিক আগে অধ্যাপক এফ. জে. রো জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই দল কোনো রাইফেল শ্যুটিং বা আংলিং বা এই জাতীয় খেলার সঙ্গে যুক্ত কিনা। মোহনবাগান এই জাতীয় খেলার সঙ্গে যুক্ত নয় জেনে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন দলের নাম পাল্টে ‘মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব’ (Mohun Bagan Athletic Club) রাখতে। সেই শুরু। তারপর একের পর এক ম্যাচ জেতা। বাকিটা তো ইতিহাস। তবে জানেন কি, মোহনবাগানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোচবিহারের নাম? কেমন ভাবে? সেই গল্পই থাকবে আজকের এই লেখায়।
উত্তর কলকাতার মোহনবাগান অঞ্চলের মিত্র ও সেন পরিবারের সাহায্যে ভূপেন্দ্রনাথ বসু ১৮৮৯ সালের ১৫ অগস্ট মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব প্রতিষ্ঠা করলেন। কথিত আছে, মোহনবাগান ভিলায় ইডেন হিন্দু হোস্টেলের বিরুদ্ধে এই দল প্রথম খেলেছিল।
১৯১১ সালে কলকাতা-সহ সারা ভারতের ফুটবল জগতে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে। আজকের দিনেই অর্থাৎ ২৯ জুলাই ইংরেজদের টিম ‘ইস্ট ইয়র্কায়র’-কে পরাজিত করে আইএফএ শিল্ড জয় করে মোহনবাগান। বাংলার ঘরে ঘরে খুশির মেজাজ। ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি। গোরাদের হারিয়ে দেওয়া গেছে। একদল গ্রাম্য বাঙালি তাক লাগিয়ে দিয়েছে বটে! তৎকালীন সাহেবি কাগজ ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’ ম্যাচ কভার করে লিখেছিল, “রাউট অব দ্য কিংস সোলজারস্ ইন বুটস অ্যান্ড সুজ বাই বেয়ার ফুটেড বেঙ্গলি ল্যাডর্স”। তখনকার ‘স্ট্যান্ডার্ড সাইকেল কোম্পানি’ বিজয়ীদের হাফটেন ফটো ছেপেছিল দুই লক্ষেরও বেশি। বিনামূল্যে সেগুলি ঘরে ঘরে বিতরণ করা হয়েছিল।
সেদিনের সেই খেলা ছিল দেখার মতো। কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ মোহনবাগানীদের বুট পরে খেলতে বললেও তাতে রাজি হননি খেলোয়াররা। তাঁরা খালি পায়ে খেলতেই পটু। ১৯১১ সালে নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপবাহাদুরের পোকার্স ইলেভেনের ছয়জন খেলোয়াড়ই ছিলেন কোচবিহারের। মোহনবাগান দলে তৎকালীন কোচবিহারের যে সমস্ত ছেলেরা খেলেছিলেন তাঁরা হলেন – ভূতি সুকুল, রাজেন সেনগুপ্ত, কানু রায়, অভিলাষ ঘোষ, বিজয় দাস ভাদুড়ী এবং শিবদাস ভাদুড়ী। যদিও ফাইনাল থেকে বাদ পড়েছিলেন শরৎ সিং।
ভূতি সুকুল ছিলেন জেনকিন্স স্কুলের ছাত্র। কোচবিহার স্টেশনের (Coochbehar Station) কাছে একটা দালান বাড়ি ছিল তাঁর। রাজেন সেনগুপ্তও জেনকিন্স স্কুলের হস্টেলে থাকতেন। তাঁকে বলা হত ‘মোহবাগানের সিংহ’। অভিলাষ ঘোষ হাজপাড়ার প্রবীণ ব্যক্তি রাজবাড়ি ‘হাউস হোল্ড’ বিভাগের কর্মচারী বিহারীলাল ঘোষের আত্মীয়। বিজয় দাস ভাদুড়ি (Bijay Das Bhaduri) বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর থেকে কোচবিহারের মাঠে খেলতে এসেছিলেন। বাংলাদেশে আর ফিরে যাওয়া হয়নি। শোনা যায় আইএফএ শিল্ডে ওই বছরই রয়্যাল ফুসিলিয়ার্সের বিরুদ্ধে একাই ছয় গোল দিয়েছিলেন। অন্যদিকে শিবদাস ভাদুড়িকে (Shibnath Bhaduri) মাসোহারা দেবার ব্যবস্থা করছিলেন মহারাজা স্বয়ং। মোহনবাগান টিমে বরাবরই কোচবিহারের খেলোয়াড়রা খেলতেন।
কোচবিহারের সঙ্গে তাই মোহনবাগানের নাম এবং জয় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। মোহনবাগান মানেই একদল ‘ঘটি’-র অহংকার, জেদ, লড়াই আর বেঁচে থাকার স্পর্ধার আরেক নাম। শোনা যায়, আইএফএ শিল্ড (IFA Shield) ফাইনাল শেষে বিজয় মিছিল যখন ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো, তখন অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়িকে এক জনৈক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করেন, “এরা, মানে এই ব্রিটিশরা কবে যাবে?” শিবদাসের উত্তর ছিল, “যেবার আমরা ফের শিল্ড জিতবো।” ভাবলে অবাক লাগে, মোহনবাগানের দ্বিতীয় শিল্ড ঘরে এসেছিল ১৯৪৭ সালে, ইংরেজদের হাত থেকে ভারত স্বাধীন হবার বছরেই।
____________
তথ্যঋণঃ
১। ‘মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ও উনিশশ’ এগারোর শিল্ডজয়ী মোহনবাগান ক্লাব’ নামক প্রবন্ধ – চিনতু সেন
২। বঙ্গদর্শন আর্কাইভ