No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ‘টিংটিং বাজে বেল’ –  সাবেক কলকাতার সাইকেল-কথা

    ‘টিংটিং বাজে বেল’ –  সাবেক কলকাতার সাইকেল-কথা

    Story image

    ১৮৮৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। বর্ষার মেঘ তখনো পুরোপুরি কাটেনি। তবে, ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি মারছে সোনালি রোদ্দুর। আবহাওয়া মোদ্দায় শীতল। কলকাতায় সেদিন সকাল থেকেই বেশ সাজো সাজো রব। ময়দানে ছেলে-ছোকরার দল জড়ো হয়েছে। সাহেবসুবোরা তো আছেই। কে যেন আসবে সেদিন! অবশ্যই স্বনামধন্য মানুষ। কিন্তু কে সে? 

    গুঞ্জন শুরু হতে না হতেই এসে পৌঁছালেন টমাস স্টিভেন্স। বাইসাইকেলে চড়ে প্রথম বিশ্বভ্রমণ করছেন যিনি। তাঁকে ঘিরে জমকালো মিছিল বেরোল। আর কলকাতাবাসী বিস্ময়ে দেখতে থাকল। ১৮৮৪-র ২২ এপ্রিল, সকাল আটটায় সানফ্রানসিসকো থেকে রওনা হয়েছিলেন মানুষটি। তারপর দুচাকার যানটিতে চেপে গোটা দুনিয়ায় বনবন পাক।

    সারা পৃথিবীর কাছেই কিন্তু সাইকেল একটা বিস্ময়। বা বলা ভালো, পৃথিবী ঋণী এই যানটির কাছে। নিজের চালক নিজেই। অন্যের ওপর জুলুম নেই। দাম মারাত্মক কিছু নয়। ধনী-গরিবের ভেদাভেদ মুছে দিতে সক্ষম। আবার দূষণ ঘটায় না। তেল বা গ্যাস কিস্‌সুর ধার ধারে না। চলার জন্য শান বাঁধানো রাস্তাও লাগে না। এমন মানুষ পাওয়া কঠিন, যে সাইকেলের প্রেমে পড়েনি।

    কলকাতাও পড়েছিল সেদিন। সে প্রেম আজও ফিকে হয়নি।

    কলকাতার বিবর্তনের ইতিহাসে অনেক যানবাহনের কথাই বেশ আলোচনা হয়। পালকি, ঘোড়ার গাড়ি। তাদের হাজারো রকমফের। ঘোড়ায় টানা ট্রাম, ইলেকট্রিক ট্রাম, দোতলা বাস, রেলগাড়ি তো বটেই। কিন্তু, এই কাব্যে সাইকেল চির উপেক্ষিতা। 

    হয়তো ছিঁচকে চেহারার জন্য। দুটো চাকা, ছোটো একখান সিট, নিজে খাঁড়া হয়ে দাঁড়াতে পারে না। তাকে নিয়ে অত আলোচনার কী আছে? অন্যান্য গাড়ির মতো ঢাউস চেহারা নিয়ে রাস্তা জুড়ে সে থাকে না। লোকেও মনে রাখে না তাই। 

    অথচ, সত্যিই একসময় সাইকেলকে ঘিরে প্রচণ্ড রোমান্টিকতা কলকাতার আকাশবাতাস ঘিরে ভালোই ছিল।
    শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ সাইকেল চেপে হাওয়া খেতে যেতেন চৌরঙ্গী অঞ্চলে। সে ছিল প্রথম যুগের ট্রাইসাইকেল। তিনচাকাওয়ালা। তারও আগে ছিল ট্যান্ডেম। একসাথে অনেকে মিলে চালানো যায় যা। বেশ বেঁধে-বেঁধে থাকার মতো। এই ট্যান্ডেম বানিয়েছিলেন সাঁতরাগাছির বাসিন্দা প্রসন্নকুমার ঘোষ। ভারতে তাঁর তৈরি সাইকেলটিই হল প্রথম সাইকেল। অবস্থাপন্ন লোকজন অবশ্য তারও আগে বিলাত থেকে আনাতেন ভেলোসিপেড সাইকেল। যাতে প্যাডেল নেই। পা দিয়ে ঠেলে যেতে হত।

    আর সাইকেলের জগতে অতি জনপ্রিয় ছিল পেনিফার্দিং। ব্রিটিস পেনি আর ফার্দিং-এর মতোই তার চাকাদুটো। সামনেরটা বিশাল বড়ো। পিছনেরটি পুঁচকে। ইন্দিরা দেবীর লেখায় কলকাতার রাস্তায় পেনিফার্দিং-এর চলাচলের বর্ণনা মেলে।

    উনিশ শতকের শেষ দশকে তো সাইকেল চালানো ছিল রীতিমতো ফ্যাশান। সাহেবরা ক্লাবে আড্ডা দিতে যেত সাইকেল চেপে। ডাক্তার রোগী দেখতে আসত। সুন্দরী বিদেশিনী সাইকেল চালিয়ে তাক লাগিয়ে দিত কলকাতাকে। সাইকেল নিয়ে মাতামাতি এমন জায়গায় পৌঁছল যে ১৮৯৭ সালে বেঙ্গল সাইক্লিস্ট অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়। ভাবা যায়? সাইকেল এতই মগ্ন করে তুলতে পারে, যে তাকে ঘিরে অ্যাসোসিয়েশন! দু চাকার ভেল্কি কম নয়।  

    জগদীশ বোস, তাঁর স্ত্রী অবলা বোস, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নীলরতন সরকার ও পত্নী নির্মলা দেবী সম্মিলিতভাবে ভোরবেলায় মেছুয়াবাজার স্ট্রিটে সাইকেল চালাতেন। জগদীশ বসু বলেছিলেন, “...আজকাল বাইসিকেল আমাদের পুষ্পক রথ।” কলকাতার বুকে বাঙালির প্রথম সাইকেলের দোকানটি ছিল হ্যারিসন রোডে। আজকের কলেজ স্ট্রিট। প্রেসিডেন্সি কলেজের পাশেই ছিল নাকি সেই দোকান। দোকানের মালিক হেমেন্দ্রমোহন বসু। নামজাদা মানুষেরও ভিড় জমত সেই দোকানে।

    এই সাইকেল কলকাতার ওতপ্রোত অংশ ছিল। ডাকপিয়নের বাহন সাইকেল। গোয়ালা দুধ বিক্রি করতে যায় সাইকেলে। সাইকেলবিহীন খবরের কাগজওয়ালা প্রায় অসম্ভব। মাস্টারমশাই-এর সাইকেল, ছাত্রের সাইকেল, পালানোর জন্য সাইকেল। বাংলা উপন্যাসে, সিনেমাতেও সাইকেলের অবাধ ব্যবহার।

    কেমন একটা মনে হয়, ‘বোতাম আঁটা জামার নিচে শান্তিতে শয়ান...’ বাঙালির এই প্রোটোটাইপটি ভাঙার পিছনে সাইকেলের গভীর অবদান ছিল। ‘দেখব এবার জগৎটাকে...’ এই নেশাটা উসকে দিয়েছিল বাইসাইকেল। দু-চাকায় যেন কত রঙিন স্বপ্ন। আমাদের মনে পড়ে যাবে ‘ধাত্রীদেবতা’র শিবনাথের কথা। ঘোড়ার থেকে সাইকেলটাই যেন সে নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়েছিল বেশি। 

    মফস্বলে সাইকেল আজও অপরিহার্য। অমর্ত্য সেন ক্লাস নিতে যেতেন সাইকেল চেপে। শহর কলকাতাতেও সে আছে। তবে কী, মোটরবাইকের হুড়ুমতাল চোটপাটের কাছে বাইসাইকেল গুটিয়ে গিয়েছে। প্রচণ্ড শব্দে ভোঁ তুলে পাড়া কাঁপিয়ে, রাস্তা ভেদ করে চলা মোটর বাইক আজকের যুগের হিরো। বা হিরোর ধারণার সঙ্গে মিলেমিশে গেছে। ক্রিংক্রিং বেলের সাইকেল নেহাৎই ছাপোষা। বা ধর্তব্যে না আসা ছোটো মানুষদের। অথচ একসময় এই সাইকেল থাকাটাই ছিল অসামান্যতার পরিচয়। তারুণ্যের, তার দুরন্ত গতির প্রতীক। বর্তমান কলকাতায় দূষণ বেড়েছে যত, সাইকেল কোণঠাসা হয়েছে ততবেশি। একদা ভূ-পর্যটনের নেশা লাগাত যা, কলকাতার যৌবন যার পিঠে চেপে ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন অমুক ডেজ, তমুক ডেজ’ ইত্যাদি স্বপ্ন দেখত, আজ তার গতিবিধি শুধুই গলিপথে। মেইন রোডের ছাড়পত্র তার নেই।

    Tags:

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @