বিদায় মাহুত বন্ধু

ভবানীপুর স্কুল রো এলাকায় আর পাঁচটা বৃহৎ অট্টালিকার ভিড়ে বাইরে থেকে সেই বাড়িটিকে এখন আর আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় না। কিন্তু একটু কষ্ট হয় সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলেই যে কেউ বুঝতে পারবেন যে, সেখানে একটা ভিন্ন পরিমণ্ডল বিরাজ করছে। সাত ফুটের ওপরে লম্বা হাতির শুঁড়, চিতাবাঘের ছাল, হরিণের মাথার খুলি ছড়িয়ে আছে গোটা বাড়িটিতে।
প্রথম দর্শনেই মনে হবে বাড়িটি বোধহয় কোনো নিষ্ঠুর বন্যপ্রাণী শিকারির আস্তানা। কিন্তু সেই ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগবে না যদি বাড়ির মালিকের আসল পরিচয় পাওয়া যায়। ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী। অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার কালিপুরে তাঁদের জমিদারি ছিল। ধনগৌরবের তুলনায় তাঁদের পারিবারিক ঐতিহ্যের মধ্যে অনেক বড়ো স্থান ছিল বিদ্যাচর্চার এবং উচ্চাঙ্গ সংগীত সাধনায়।
সেই ধারা অব্যাহত রাখতেই ধৃতিকান্ত প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে সাম্মানিক স্নাতক হন। ইংল্যান্ডের লিড্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পিএইচডি করেন। আজীবন অধ্যাপনা করেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর স্ত্রী শীলাও অধ্যাপনা করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সারাজীবনের অক্লান্ত সাধনায় তিনি যে বিশেষ পরিচয়ে চিহ্নিত হয়েছেন তা হল- তিনি একজন হস্তী বিশারদ।
হাতির প্রতি টানও এসেছে পারিবারিক সূত্রেই। ময়মনসিংহে কালিপুরের হাতিশালে তাঁদের একসময় ২৭টি হাতি ছিল। সেই হাতিদের স্বাভাবিক মৃত্যু হলে তাদের দাঁত দিয়েই তৈরি হয়েছে নানারকম দেবদেবীর মূর্তি। পারিবারিক সূত্রে ধৃতিকান্ত যেমন পেয়েছেন সাহিত্য-সংগীত প্রীতি, তেমনি পেয়েছেন শিকারের আগ্রহ এবং আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে নিখুঁত নিশানা।
সেই কারণেই পঞ্চাশের দশকের গোড়ায়, যখন ধৃতিকান্তর বয়স ত্রিশ বছরও হয়নি, তাঁর ডাক পড়েছিল এক মত্ত হস্তীকে ধরাশালী করার জন্য। তারপর থেকে সাবধানী সাহসী শিকারি হিসাবে এই ১৩০০ কিলোগ্রাম ওজনের প্রাণীটিকে বাগে এনে নিরীহ মানুষদের শান্তি দেবার জন্য বারেবারে ধৃতিকান্তকে শিকারে যেতে হয়েছে। মনে রাখা দরকার তখনও দেশে হাতি হত্যা নিষিদ্ধ হয়নি।
কিন্তু এই হাতি চর্চা করতে করতেই ধৃতিকান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে হাতি আর মানুষের সহাবস্থানের সূত্র আবিষ্কার করার দায় মানুষেরই। তাঁর গ্রেট ইন্ডিয়ান এলিফ্যান্ট বুক- এই বিষয়ে একটি প্রামাণিক গ্রন্থ। ভারত সরকার প্রথম যখন প্রোজেক্ট এলিফ্যান্ট গঠন করে তখনই ধৃতিকান্তকে তার সম্মানিত সদস্য করা হয়। হাতি নিয়ে তাঁর গবেষণা পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। তিনি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার-এ বিশেষজ্ঞ হিসাবে নিয়োজিত হন।
কিন্তু ধৃতিকান্ত সারা জীবনে মানুষ নিয়ে কিছু ভাবেননি তা নয়। দেশ স্বাধীন হবার আগে থেকেই শিক্ষিত উচ্চবিত্ত বাঙালি পরিবারে সাম্যবাদের হাওয়া বইতে শুরু করে। সেই জীবনদর্শনকে ধৃতিকান্ত উপেক্ষা করতে পারেননি। তিনিও একসময় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। দলীয় রাজনীতি থেকে কিছুটা দূরে সরে গেলেও তিনি আজীবন সেই রাজনৈতিক বিশ্বাসে অবিচল ছিলেন।
গত ১ মার্চ ৮৮ বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণ এক বৈদগ্ধের বিদায় বলেই চিহ্নিত হবে।